‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে একই খুনি চক্র। এরই ধারাবাহিকতায় গায়ে ভারতপন্থী লেবাস পড়িয়ে হত্যা করা হয় খালেদ মোশাররফ, হায়দারসহ সেনা কর্মকর্তাদের। ৭ নভেম্বর মূলতঃ সেনা সদস্যদের এক বিশৃঙ্খল অভ্যূত্থানে জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে গণবাহিনী তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। তাহেরসহ জাসদ নেতারা মনে করেছিলেন, জিয়া তাদের বিপ্লবী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন।
কিন্তু ক্ষমতায় বসেই জিয়া তার মুক্তিদাতাদের উপর খড়গহস্ত হন।
‘৭৬ সালের শুরু থেকেই জিয়াউর রহমান ক্ষমতার ওপর নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করলেন। বিচারপতি সায়েমকে সামনে রেখে প্রথমে, তারপর তাকে হটিয়ে নিজেই পুরো ক্ষমতা হাতে নেন জিয়া। ছোট-খাট আকারের স্লিম, প্রকাশ্যে প্রায় সব সময় কালো সানগ্লাস চোখে পড়া এই মানুষটা আওয়ামী লীগ বিরোধী জনমত আর রাজনৈতিক শক্তির কাছে মুজিবের বিকল্প নেতা হিসাবে আবির্ভূত হলেন। এ ব্যাপারে অনেকের মতো আমারো একটা বিশ্লেষন আছে।
‘৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানের ভূমিকাই ছিল প্রধান। “কান মে বিড়ি, মু মে পান, লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” আন্দোলন বাঙালি মুসলমানকে যতোটা নাড়া দিয়েছিল, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশকে ততোটা নয়। এটা ইতিহাসের কথা। সেই বাঙালির মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে মোহভঙ্গের ঘটনা, অবিশ্বাস্যই বটে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ অকল্পনীয় সংখ্যাগরিষ্টতা পেলেও আওয়ামী লীগ বিরোধীরা কিন্তু ভোট কম পায়নি।
গণতন্ত্রের এই সংখ্যার খেলাটা আমরা এখন নিশ্চয়ই জানি। এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে ভোটের পার্থক্য ৫ থেকে ৭ শতাংশ বা ১০ শতাংশ হলে সংসদে আসনের পার্থক্য দেড়শ থেকে প্রায় আড়াইশ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশবিরোধী এই রাজনৈতিক শক্তি মুক্তিযুদ্ধে পরাস্ত হলেও হারিয়ে যায়নি। তারা মঞ্চ খুঁজছিল, জায়গা খুঁজছিল, নেতা চাইছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগের দুর্বলতা, দলের ভেতর অনৈক্য-দলাদলি, দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ, জনপ্রিয়তায় ধ্বস এই শক্তিকে উত্থানের সুযোগ করে দেয়।
মুসলিম লীগ, জামায়াতের রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ ছিল। বাংলাদেশবিরোধী এই রাজনৈতিক শক্তি যেমন আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়ে, তেমনি জাসদসহ আওয়ামী লীগবিরোধী শিবিরেও আশ্রয় নেয়। কর্নেল তাহের ও জাসদের অদূরদর্শী এবং সিপাহী জনতার অভ্যূত্থানের নামে বিপ্লবের তথাকথিত বালখিল্য রাজনীতি জিয়াউর রহমানকে নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।
জিয়ার মতো খালেদ মোশাররফও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই দুজনের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ইতিহাসও ভিন্ন।
জিয়া অনেকটা পরিস্থিতির চাপে আর খালেদ মোশাররফ পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খালেদ মোশাররফের যতো বীরত্বগাঁথা পাওয়া যায়, জিয়ার ততোটা নয়। খালেদ ছিলেন মনেপ্রাণেই একজন বিপ্লবী। ‘৭৫-এর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থান সফল হলে হয়তো ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো বলে আমার মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে খালেদ মোশাররফকে আমার সময়ের সবচেয়ে “মিসআন্ডারস্টুড” (এই শব্দটার যথার্থ বাংলা পাচ্ছি না) চরিত্র মনে হয়।
মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা, বিশেষ করে সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে খালেদ মোশাররফ সম্ভবত ছিলেন সবচেয়ে মেধাবী। তার সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে শোনা তার একটা উদ্ধৃতি আমি কখনোই ভুলতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধে মূলতঃ গেরিলা যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন সেক্টর দুই-এর এই প্রধান। এক সম্মোহনী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। অনেকটা চেগুয়েভারার মতো।
তার ভাষণ শুনে গেরিলারা পতঙ্গের মতো মরনপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো। খালেদ মোশাররফ সে সময় প্রায়ই বলতেন, “স্বাধীন দেশের সরকার জীবিত গেরিলাদের চায় না, নো গভর্নমেন্ট ওয়ান্টস অ্যান অ্যালাইভ গেরিলা, নিতে পারে না………”।
কিন্তু ৭ নভেম্বর পরিকল্পিতভাবে খালেদ মোশাররফ ও হায়দার- মুক্তিযুদ্ধের দুই সহযোদ্ধাকে ‘৭৫-এর খুনি বাহিনী হত্যা করে। নাকি এ কাজ করেছিল গণবাহিনী? জিয়া সফল হলেন, বিভ্রান্ত বিপ্লবী তাহের কোলে তুলে জিয়াকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেন। ইতিহাস বলে তাহের যতোটা জিয়াকে বিশ্বাস করেছিলেন, জিয়া ততোটাই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।
এর অর্থ জিয়ার একটা লুকোনো রাজনীতি ছিল। তাহের তার সব কার্ডই জিয়াকে দেখিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে প্রথম সুযোগেই তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে জিয়াউর রহমান ‘৭৫-এর ৭ নভেম্বর তাকে বাঁচানোর প্রতিদান দিয়েছিলেন! জাসদের রাজনীতি দেশকে কতোটা পেছনে ঠেলে দিয়েছিল তা আজ আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
জিয়ার ক্ষমতা দখল দেশকে স্বাধীনতার উল্টো পথে নিয়ে গেল। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের আশ্রয়দাতা হয়ে উঠলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি দালাল শাহ আজিজ, খান এ সবুরকে রক্ষা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর তাদের পূনর্বাসন করেন জিয়া। এরকম আরো অনেক নাম বলা যায়। জিয়া সেনাপ্রধানও করেছিলেন পাকিন্তানপন্থী এক বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা এইচ এম এরশাদকে। কিন্তু জিয়া শান্তিতে ছিলেন না।
বলা হয়, তার ৫ বছরের শাসনামলে কমপক্ষে ১৯ থেকে ২১টি সেনা অভ্যূত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। এরই একটায় ১৯৮১ সালে ৩০ মে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন।
জিয়ার শাসনামলে একটি ঘটনা আমাদের পরিবারকে নাড়া দিয়েছিল। যা আমার পরবর্তী রাজনৈতিক চিন্তায় অজান্তেই অনেকটা প্রভাব ফেলে। ১৯৭৭ সালে সেপ্টেম্বরের শেষে জাপানের একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন “রেড আর্মি” জাপান এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ অপহরণ করে এনে ঢাকা বিমানবন্দরে নামায়।
সেটা ছিল বর্তমানের পুরনো বিমানবন্দর। একই সময়ে অর্থাৎ ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে একটা ব্যর্থ অভ্যূত্থান হয়। এই অভ্যূত্থান চেষ্টাটা আসলে কেন হয়েছিল, আদৌ এর পেছনে বিমানবাহিনীর নিচের পর্যায়ের লোকজন জড়িত ছিল কিনা- সেটা একটা বড় রহস্যই রয়ে গেছে এখনো। ঠিক এর আগে আগে ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ বগুড়া সেনানিবাসে ২২ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা অভ্যূত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
আমরা কলেজে বসে ওই জাপানি উড়ে[জাহাজ অপহরণের খবর পেয়েছিলাম।
অভ্যূত্থানের খবর পেলাম ছুটিতে বাসায় এসে। তখন শুনেছিলাম আমাদের বাকী মামার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাকী মামা আমার মায়ের চাচাতো ভাই। তিনি ছিলেন কুমিল্লা সদর থেকে এবার নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাংসদ এ কে এম বাহাউদ্দিন বাহারের মেঝ ভাই। বাকী মামা বিমানবাহিনীতে ছিলেন।
দারুণ স্মার্ট, নায়ক নায়ক চেহারা ছিল তার। আমি ভীষণ পছন্দ করতাম তাকে।
আমার জন্মের এক বছর পর ১৯৬৩ সালে বাকী মামা এয়ারম্যান হিসাবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। জাপানি এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটি অপহরণের সময় ফ্লাইট সার্জেন্ট এ কে এম মাঈনউদ্দিন (বাকী মামা) বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
তিনি তখন এয়ার কমান্ডোতে কর্মরত ছিলেন। ২ অক্টোবরের অভ্যূত্থানের পর বাকী মামার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তার ভাইয়েরা মামার খোঁজে সব স্থানে গেছেন। গিয়েছিলেন তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এম এ জি তওয়াবের কাছেও। এর বেশ কিছুদিন পর কুমিল্লার মুন্সেফবাড়িতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি চিঠি আসে।
এতে লেখা ছিল অভ্যূত্থান চেষ্টায় জড়িত থাকায় তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফাঁসি হলেও তার মরদেহটা তো পরিবার পাবে! কিসের কি? আজো আমাদের মামারা, বাকী মামার ভাইয়েরা জানেন না কোথায় তাদের ভাইকে কবর দেওয়া হয়েছে। কি ভয়ংকর বর্বরতা! কি অকল্পনীয় নৃশংসতা!
জিয়াউর রহমানের শাসনকালটা সামরিক বাহিনী ভীষণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। একের পর এক অভ্যূত্থান চেষ্টা, নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ, ভয়াবহ নৃশংসতা ছিল তার শাসনামলের প্রায় অনালোচিত এক কালো অধ্যায়। ১৯৭৭-এর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের ওই ব্যর্থ অভ্যূত্থানের বলি হয়েছিল মোট ১ হাজার ১৪৩ জন সেনা সদস্য ও বিমান সেনা।
তাদের গোপন বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। বিচারের নামে তখন রীতিমতো প্রহসন হয়েছিল। শুধু বিমান সেনাই হত্যা করা হয়েছিল ৫৬১ জন।
সময়টা মনে নেই, আমরা কলেজে ঢোকার পর জিয়াউর রহমান ও বেরোনোর আগে এইচ এম এরশাদকে ক্যাডেট কলেজ গভার্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসাবে পেয়েছিলাম। দুজনই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ সফরে এসেছিলেন।
তবে এই দুই চরিত্রের কেউ আমাকে কখনো আকৃষ্ট করতে পারেননি।
লেখক: সানাউল্লাহ । সাংবাদিক। বার্তা ও অনুষ্ঠান প্রধান,এবিসি রেডিও ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।