আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিরে দেখা ঃ ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি দিনটি সে অর্থে মোটা দাগে মনে রাখার মতো নয়। এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। এই দিন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে স্বীকৃত নরঘাতক গোলাম আযম বায়তুল মোকাররম মসজিদে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ দু’জন বাংলাদেশী নাগরিকের জানাজায় অংশ নেয়ার পর জনতা কতর্ৃক জুতো পেটার শিকার হন। সে যাত্রায় কোন মতে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান গোলাম আযম।

এখনও তিনি বহাল তবিয়তেই আছেন। ভালই আছেন। ভাল নেই শুধু মুক্তিযোদ্ধারা, যাঁরা গোলাম আযমকে এদেশের নাগরিকত্ব হারাতে দেখেছেন। আবার দেখেছেন তা ফিরে পেতে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে বদর বাহিনী সার্বিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো।

এর প্রকাশ্য নেতৃত্বের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ২১ জুন জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম সংবাদ প্রকাশ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রধান (গোলাম আযম) বলেন, দেশের সংহতি ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তপে ছাড়া আর উপায় ছিল না’। এর আগে রাওয়ালপিন্ডিতে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম বলেন, দেশের পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ২৯ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী উল্লেখ করে ও ২৫ মার্চে শুরু হওয়া গণহত্যার প েসাফাই গেয়ে বলেন, ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে পদপে গ্রহণ করে তা ছিল এদেশের মাটি রার জন্য। গোলাম আযম বলেন, আমি আশঙ্কা করছি যেখানে সেনাবাহিনী ও রাজাকার নেই সেখানে দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিযোদ্ধা) হত্যাযজ্ঞ চালাবে।

এ পরিস্থিতি থেকে উপকৃত হয়ে তারা আবার বলতে শুরু করেছে যে, তথাকথিত বাংলাদেশ নাকি শীঘ্রই একটি বাস্তব সত্যে পরিণত হবে। ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত গোলাম আযমের বক্তব্য সম্বলিত প্রতিবেদনে বলা হয়, কোন মুসলমানই তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না। এতে রাজাকাররা খুব ভাল কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে পাকিস্তানের গবর্নরের উপদেষ্টা জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে বৈঠককালে গোলাম আযম বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা পেশ করেছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে রাজাকার বাহিনীর প্রশিণ শিবির পরিদর্শনকালে এক সমাবেশে গোলাম আযম বলেন, রাজাকার বাহিনী কোন দলের নয়, তারা পাকিস্তানে বিশ্বাসী সকল দলের সম্পদ।

তিনি বলেন, তোমরা দলমতের উর্ধে উঠে পাকিস্তানে বিশ্বাসী সকল দলকে আপন মনে করবে। বিছিন্নতাবাদীরা জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখেনি বরং তারা ঢালাওভাবে আলেম ও ইসলামী দলের লোকদের খতম করেছে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠক শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবে। তথাকথিত মুক্তিবাহিনীকে শত্রুবাহিনী হিসেবে আখ্যায়িত করে গোলাম আযম বলেন, তাহাদের মোকাবেলা করার জন্য রাজাকাররাই যথেষ্ট। এ প্রসঙ্গে তিনি রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য আহ্বান জানান।

দৈনিক ইত্তেফাক ২ ডিসেম্বর ১৯৭১ এভাবেই পাকিস্তানের অন্যতম সহযোগী, পরম আস্থাভাজন বন্ধু গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারপরনাই কাজ করে গেছেন। তার কাজের এই ধারাটি পরবতর্ী সময় স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি করে দেখিয়েছেন। ‘৭২ সালে পাকিস্তানে গোলাম আযমের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ পালন করা হয়। এ সময় গোলাম আযম বলেন, বাংলাদেশ একটি জমি। একটি মাটি ছাড়া আর কিছুই নয়।

মাটির জন্য কারও কোন আদর্শ থাকতে পারে না (সাপ্তাহিক বিচিত্রা)। ওই বছরেরই এপ্রিলে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। এরপর তিনি তিনবার নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন। কিন্তু ‘৭৫-এর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ‘৭৮ সালের ১১ জুলাই অসুস্থ মাকে দেখার ছুঁতোয় তিন মাসের ভিসায় বাংলাদেশে আসেন গোলাম আযম। প্রথম দিকে অতিথি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকটি পুনর্মিলনী সভায় যোগ দেন।

তবে বিভিন্ন সময় জনতার রুদ্ররোষের কবলে পড়ে তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম মসজিদে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ দু’জন বাংলাদেশী নাগরিকের জানাজায় অংশ নেন। জানাজা শেষে তাকে দেখা মাত্রই উপস্থিত মুসুলি্লরা জুতো পেটাতে শুরু করে। কোন মতে পালিয়ে তখন প্রাণ বাঁচান গোলাম আযম। এর পর স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহলের সুনিবিড়ি ছায়ায় ক্রমেই ডালপালা ছড়াতে থাকে ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে ঘৃণিত এই মানুষটি।

নানা ফন্দিফিকিরে ‘৭১-এর সহযোগী ঘাতকদের নিয়ে আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করা শুরু করেন গোলাম আযম। ‘৯২ সালের ২৬ মার্চ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে প্রতীকী আদালত গঠন করে সে আদালতে গোলাম আযমের ফাঁসি ঘোষণা করা হয়। এতে দেশের আপামর মানুষের বিবেক জাগ্রত হলেও কাজটির জন্য শহীদ জননীসহ ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটির আরও ২৪ জনের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিএনপি সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। এই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ নিয়েই মারা যান ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সন্তান হারানো শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। আর বাংলাদেশের কলঙ্কের তিলক রাজনৈতিক উচ্ছিষ্ট গোলাম আযম থেকে যান নিরাপদ আশ্রয়ে।

শাপদের আশ্রয়ে থেকেই কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায় নির্বিঘ্নে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘৯৯ সালের ৩ মে বঙ্গবন্ধুকে কটা করে গোলাম আযম বলেন, ১৫ আগস্টের পরিবর্তনে জনগণ কাদেনি বরং হেসেছিল। শেখ হাসিনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আবারও এমন ঘটনা ঘটলে মানুষ খুশিই হবে। javascript:void(1); বাঙালী বঙ্গবন্ধুর মতো অকৃত্রিম বন্ধু আর গোলাম আযমের মতো নরঘাতক শত্রু চিনতে ভুল করে না। কেবল স্বার্থান্বেষী রাজনীতির অন্ধ রাজনীতিকদের কারণে সব হিসেব পাল্টে যায়।

দেশদ্রোহীই তাদের কাছে হয়ে ওঠে পরম বন্ধু। ‘৭২ এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিতে বাঙালী যেমন নিঘর্ুম রাত কাটিয়েছে, তেমনি ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে জুতোপেটা করতে ভুল করেনি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.