লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু। এক জাতীয় বীরের প্রতি শ্রদ্ধা
হামিদ মীর
তিনি ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় বীর। তার মৃত্যুতে দেশপ্রেমিক প্রতিটি পাকিস্তানিই শোকাহত। কিন্তু তাদের এই বীরের সাথে কতটা অন্যায্য আচরণ করা হয়েছিল, এটা খুব কম পাকিস্তানিই এটা জানে।
এই মহান বীরের মহত্ত্ব এইখানে যে, তিনি মৃত্যু পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কৃত অন্যায্য আচরণের ব্যাপারে মুখ খুলেন নি। কারণ, তার আন্তরিকতার সম্পর্ক কোনো ব্যক্তির সঙ্গে নয়, ছিল দেশ ও জাতির সঙ্গে। আজ এই বীরের মৃত্যুর পর তার সুকীর্তিগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনা করা দরকার। তার সম্পর্কে যত গুণগানই করা হোক, তা হবে অতি নগণ্য। কিন্তু তার সঙ্গে কৃত অন্যায় আচরণের আলোচনাও একান্ত জরুরি, অনাকাক্সিক্ষত হলেও যার মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছিল।
এ আলোচনাটা এ জন্য, যেন আমরা নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারি এবং ভবিষ্যতে যেন কোনো বীরকে এমন আচরণের মুখোমুখি না হতে হয়, ততটুকু সতর্ক হতে পারি।
আজ যে বীরের প্রতি সম্মানের সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাতে চাই, তার নাম এয়ার-কমোডর মুহাম্মদ মাহমুদ আলম খান, যিনি এম.এম. আলম নামেই সমধিক পরিচিত। এম.এম. আলমের সঙ্গে কৃত অন্যায় আচরণের আলোচনার পূর্বে আপনাকে এটা বলে দেওয়াই যথেষ্ট যে, তিনি বাঙালি ছিলেন। মুসলমান এবং পাকিস্তানি হতে পেরে তিনি গর্বিত ছিলেন। যখনই বাঙালিদের আলোচনা হত, তখন তিনি বলতেন, পাকিস্তান মুসলিম লীগের সৃষ্টি, মুসলিম লীগের জন্ম ১৯০৬ সালে, ঢাকায়।
তিনি বেশ গর্বের সঙ্গেই দাবি করতেন, পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা হয় বাঙালিদের হাতে; ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চে লাহোরে পাকিস্তান-প্রস্তাব যিনি উত্থাপন করেন, সেই ফজলুল হকও ছিলেন একজন বাঙালি।
এম.এম. আলমের জন্ম ১৯৩৫ সালের ৬ জুলাই, কলকাতায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার পরিবার সেখান থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। এম.এম, আলম ঢাকা গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করার পর ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কমিশন রেঙ্কে নিয়োগ পান। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটিত হলে স্কোয়াড্রন এম.এম. আলমকে সারগোদায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
যুদ্ধের প্রথম দিনে এম.এম. আলম পাকিস্তান এয়ারফোর্সের এগার নাম্বার স্কোয়াড্রনের নেতৃত্বে শত্র“-অঞ্চলে প্রবেশ করে দুটি বিমান ভূপাতিত করেন এবং তিনজনকে বিশেষভাবে আহত করেন। এর জবাবে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স ৭ সেপ্টেম্বরে সারগোদায় পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ঘাঁটিটিকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
৭ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স সারগোদায় ছয়-ছয় বার আক্রমণ করে। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার ভেতর সারগোদায় চারটি আক্রমণ হয়। এম.এম. আলম শত্র“পক্ষের দুটি বিমানকে তাড়া করছিলেন, তখন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মাসুদ আখতার তাকে আরো একটি আক্রমণের সংবাদ দেন।
এরই সামান্য পরে শত্র“পক্ষের পাঁচটি বিমান এম.এম. আলমের চোখে পড়ে। মুহূর্তেই তিনি শত্র“পক্ষের পাঁচটি বিমান ধ্বংস করে দেন। শত্র“ পক্ষের চার জন পাইলট নিহত হয়, একজন ইন্ডিয়ান পাইলট স্কোয়াড্রন-লিডার ওঙ্কারনাথ কেকার প্যারাশুটের সাহায্যে লাফ দেয় এবং চেনাব নদীর কাছে এক গ্রামে নিরাপদে অবতরণ করে। সে তৎক্ষণাৎ নিজের ব্যাজ খুলে ফেলে। সরল গ্রামবাসীদের পাঞ্জাবি ভাষায় বলে যে, সে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পাইলট।
এই সময়ে এমদাদ হুসেন শাহ নামক এক বুদ্ধিমান ব্যক্তি শোরগোল করে ইন্ডিয়ান পাইলটকে গ্রেফতার করে এবং পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। কেকার কয়েক মাস পাকিস্তানে যুদ্ধবন্দি হিসাবে ছিল, পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফিরে গিয়ে সে দাবি করে, এম.এম. আলম তার বিমান ধ্বংস করতে পারে নি। বরং তার বিমানের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ততক্ষণে সারা বিশ্বই এম.এম. আলমের বীরত্ব স্বীকার করে নিয়েছে।
এম.এম. আলমের এই বীরত্বের জন্য ‘সিতারায়ে-জুরআত’ রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের বীর নায়ক, এয়ারফোর্সের তরুণদের মান্য আদর্শ। একারণেই তিনি সিনিয়র কতিপয় অফিসারের ঈর্ষার শিকার হন। ১৯৭১ সালে যখন পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়, তখন এম.এম. আলমসহ পাকিস্তান এয়ারফোর্সের সকল বাঙালি সদস্যের বিমান পারিচালনায়/ উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছিলেন সাইফুল আজম নামক আরো এক বৈমানিক, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে যিনি চরম বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন এবং ১৯৬৭ সালের আরব-ইজরাইল যুদ্ধে ইজরাইলি বিমান ভূপাতিত করেছিলেন।
সাইফুল আজমকে জর্দান ও ইরাক সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা দিয়েছিল। কিন্তু এই সাইফুল আজম এবং এম.এম. আলম বাঙালি হওয়ার দরুণ অপরাধী সাব্যস্ত হন। সাইফুল আজম এই অবিশ্বাসকে সহ্য করতে পারেন নি, পাকিস্তান ত্যাগ করে বাংলাদেশে চলে যান। কিন্তু এম.এম. আলম পাকিস্তান ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। তার পরিবারের সকল সদস্যই ঢাকায় ছিল, তখন তার ভাই-বোনসহ সবাইকে তিনি পাকিস্তান নিয়ে আসেন।
কারণ, পাকিস্তান ছিল তার বিশ্বাসের অংশ।
এম.এম. আলম শুধু সাহসীই ছিলেন না, ছিলেন নির্ভীক সত্যবাদী। সিনিয়র অফিসারদের মুখের ওপরে সত্য বলায় তার সামান্যতম কুণ্ঠা ছিল না। জুলফিকার আলী ভুট্টুর শাসনামলে এয়ারফোর্সের প্রধান এয়ারমার্শাল জফর চৌধুরী ১৯৬৫ সালের বীর এম.এম. আলমের প্রতি বিশেষ ক্ষুব্ধ ছিলেন। একদিন এম.এম. আলমকে রাষ্ট্রদোহী হিসাবে অভিযুক্ত করে এয়ারফোর্স মেসে বন্দি করে রাখে।
তার ভুল মাত্র এই ছিল যে, তিনি বাঙালি। তাকে অপবাদ দেওয়া অত্যন্ত সহজ। এই দিন এয়ারফোর্সের তরুণ অফিসারগণ নিজেদের বীরের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে। ফলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এই সংবাদ প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টু পর্যন্ত পৌঁছালে তিনি তদন্ত করান এবং জফর চৌধুরীকে অপসারন করে জুলফিকার আলী খানকে এয়ারফোর্সের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেন।
কিছু দিন পর এম.এম. আলমকে ডিপুটেশনে সিরিয়ায় পাঠানো হয় এবং তিনি সেখানে সিরিয়ান অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেন। ফিরে এসে দেখেন জুলফিকার আলী ভুট্টুর শাসনকাল শেষ এবং জেনারেল জিয়াইল হক তখন ক্ষমতায়। জেনারেল জিয়াউল হক এয়ারফোর্সে ব্যাপক বিশৃখলা তৈরি করেন এবং নিজের বন্ধুদের মাঝে খেয়ালখুশিমতো পদবিভাজন করেন। একদিন এম.এম. আলম জেনারেল জিয়াউল হকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন যে, তিনি ভুল লোকদেরকে সামনে নিয়ে আসছেন। এদের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
জেনারেল জিয়া তখন উত্তরে বলেন, বিশ্বস্ততা একটি আপেক্ষিক বিষয়। এ কথা শুনে এম.এম. আলম সবার সামনেই সজোরে বলেন, মূল বিশ্বস্ততা তো ব্যক্তিক কোনো বিষয় নয়, সেটা হল জাতীয় বিষয়।
জেনারেল জিয়া অভ্যাসমত এম.এম. আলমের কথার কোনো জবাব দেন নি বটে, কিন্তু নীরবভাবে তার প্রমোশন বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং শেষপর্যন্ত তাকে এয়ারফোর্স থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছিল। যেই বীর পাকিস্তান এয়ারফোর্সের প্রধান হওয়ার যোগ্য ছিল, তাকে ১৯৮২ সালে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। এম.এম. আলম অন্য সবার স্বার্থে ছিলেন ভীষণ প্রতিবাদী।
কিন্তু যখন তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হল, তিনি সামান্য প্রতিবাদও করেন নি। এম.এম. আলম এ ব্যাপারে ছিলেন একেবারে নীরব। তিনি চান নি ব্যক্তিক কোনো বিষয় নিয়ে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের বদনাম হোক। তিনি ছিলেন অকৃতদার মানুষ। ভাইবোনদের লালনপালন করতেন, তাদের পড়াশোনা করাতেন।
তার এক ঘনিষ্ট বন্ধু বলেছেন, এক আফগান নারীর সঙ্গে তার ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি বিয়ে করেন নি। অবসরপ্রাপ্তির পর নীরবে তিনি আফগানের আগ্রাসী শক্তি রুশ-বাহিনীর প্রতিরোধকামী মুজাহিদ বাহিনীকে সাহায্য করতেন। নিজের কোনো বাড়িও নির্মাণ করেন নি। কিছুদিন চাকালার অফিসার্স মেস এবং কিছু দিন করাচির ফয়সাল ঘাঁটিতে অতিবাহিত করেন।
নিজের প্রতি কৃত অন্যায়ের ব্যাপারে সবসময় নীরব ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ করাচির এক হাসপাতালে নীরবে যখন এই বীরের চিরবিদায় ঘটে, তখন পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষজনই জানে না, তাদের বীরের সঙ্গে কী রকম অন্যায় আচরণ করা হয়েছিল। কারো ভাবনার অবকাশ তৈরি হয় নি যে, বিশ্বরেকর্ডধারী একজন বৈমানিক শেষপর্যন্ত পাকিস্তানের এয়ার ভাইসমার্শাল হতে পারেন নি।
(লেখাটি পড়ে এম.এম. আলমের জন্য মনে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করতে থাকি। তখনই অনুবাদের ইচ্ছা জাগে।
পাঠক জানুক, বাঙালির নিষ্ঠা, বীরত্ব এবং পাকিস্তানিদের অকৃতজ্ঞতা। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।