"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এক
পাইলট। তাকে কিশোরও বলা চলে না আবার যুবক বললেও ঠিক হবে না, এই দুইয়ের মাঝামাঝি। বাবা মা শখ করে নাম রেখেছিল পাইলট, ছেলে একদিন বড় হয়ে বৈমানিক হবে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে ঠিকই পাইলট তবে তিনচাকার যান রিকশার। প্রতিদিন ভার্সিটির বাইরে রিকশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যেতো পাইলটকে।
প্রায় প্রতিদিনি পাইলটের রিকশায় বাড়ি ফেরা হতো। আমি ওর কোন কালের মামা সেইটা আমিও জানি না, ও নিজেও জানেনা। প্রথম দিন থেকেই আমাকে মামা বলে সম্বোধন করে আসছে। পাইলটের সাথে ভাড়া নিয়ে কখনো দরদাম করতে হয়নি, ওর একটাই কথা, “ মামা, আপনে যা খুশি দিয়েন, না দিলে নাই, আপনে আমার রিকশায় উঠেন এইটাই আমার জন্যে অনেক। “ নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই ওকে ন্যায্য ভাড়ার থেকে বেশী দেয়া হতো।
পাইলটের সাথে রিকশায় ভ্রমনে দারুন মজার সব অভিজ্ঞতা ছিল। দুইজন দেশ-বিদেশ, রাজনীতি, প্রেম ভালোবাসা এসব নিয়ে গল্প করতে করতে সময় পার করতাম। আমি যাই বলাতাম পাইলট তাতেই নির্দ্বিধায় সমর্থন দিত। ছোট বেলায় ক্লাস ফাইভ পাশ করেছে পাইলট। একদিন পাশের বাড়ির আমিনাকে থাপ্পর দিয়ে একটা দাঁত ফেলে দেয়।
বাবার কাছে বিচার আসবে সেই ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসে ঢাকা শহরে। দক্ষিন কমলাপুরের রশিদ মিস্ত্রির কাছ থেকে আশি টাকা রোজ রিকশা নিয়ে কর্মজীবন শুরু করে। এখন রিকশা নিজের। যখন খুশি রিকশা চালায়, যখন খুশি ঘুরে বেড়ায়।
দুই
সপ্তাহে চার দিন আমার ভার্সিটির সামনে দাড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে পাইলট।
আমার প্রতি এত টান কিসের সেটা আমার মাথায় ঢুকত না। শুধু বলতো, “মামা শিক্ষিত মানুষ ছারা কাউরে রিকশায় উঠাইতে মন চায় না, একজন শিক্ষিত মানুষ পেছনে বইসা থাকলে আমারও দুই একটু জ্ঞান আসবে। “ মুগ্ধ হতাম পাইলটের কথায়। মানুষের জ্ঞান আহরণের তেষ্টা কতখানি প্রখর হলে এসব কথা বলে, পাইলট সত্যিই একটা চিজ। মাঝে মাঝে আমি আর পাইলট রাজনীতি নিয়ে ভীষণ আলোচনা জমিয়ে দিতাম।
আমি মন্ত্রী এমপিদের টেনে রাস্তায় নামাতাম আর পাইলট কিল ঘুষি লাথি শুরু করতো। ব্যাপক মজার এক অভিজ্ঞতা। কখনো মন খারাপ থাকলে ঠিকই পাইলট বুঝে নিত। আমার মন ভালো করার জন্যে রসাত্মক কথা বলতো। পাইলটের একটা বদঅভ্যেস ছিল খুব জোড়ে রিকশা টানতো।
এত বারন করতাম শুনতই না। একদিনের কথা না বললেই নয়, আমি বাসায় ফিরছিলাম পাইলটের রিকশায়। সেদিনও জোড়ে রিকশা চালাচ্ছে, আমি বললাম,” পাইলট আসতে টানো, সামনে দেইখা চালাও। “ পাইলট সবগুলা দাত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ মামা টেনশন নিয়েন না, আমি আছি না”; সেই মুহূর্তে সামনে এক ক্যাবের সাথে দিলো বাঁধিয়ে। আমি উপুর হয়ে পরে গেলাম রিকশা থেকে।
তিন
ক্লাসের ফারিয়া কে নিয়ে একদিন পাইলটের রিকশায় গেলাম নীলক্ষেত। এই ফারিয়া মেয়েটা এমন সব রোম্যান্টিক বিরক্তিকর কথা বলে যে মাঝে মাঝে মাথা ধরে যায়। রিকশায় বসে সে হাওয়ায় ভাসতে চায়। পাইলট আবার মুচকি মুচকি হাসে। ফারিয়াকে নীলক্ষেতে নামিয়ে দিয়ে বাসায় রওনা হলাম।
পাইলট বলে,” মামা, এই আপা আপনের উপরে পাল্টি খাইছে মনে হয়। আমি সিউর। “ পাইলট কে বুঝিয়ে বললাম তেমন কিছু নয়, ও শুধুই আমার ব্যাচমেট। পাইলট মানতে নারাজ, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে নাকি বন্ধু হতে পারে না। কিছু একটা থাকে।
শীলাও নাকি পাইলটকে এমন সব কথা বলে। শীলা নাকি ওর জানে জিগার, প্রান পরান, কইজার টুকরা । ওর আর শীলার গল্প শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেতো। শীলাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুলে পাইলট নিজের রিকশা চালায় না, অন্যের রিকশায় চড়ে দুজনে ঘুরে বেড়ায়। একদিন নাকি পাইলট শীলাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।
রিকশা ঠিক করতে যেয়ে দেখে পেছনে শীলা নাই। পরে জানতে পারে সেই রিকশাওয়ালা ছিল শীলার বাবা। পাইলটের নাকি মেয়ে প্যাসেঞ্জার বেশী। কলেজ ভার্সিটির আপাদের নিয়ে রিকশা টানা নাকি রিকশাওয়ালাদের অন্যরকম রেপুটেশনের ব্যাপার। একবার ইডেনের এক আপা নাকি ভ্যালেন্টাইনস ডে তে ওকে একটা লাল গোলাপ দিয়েছিল।
মেয়েটাকে গোলাপ দিয়েছিল তার এক প্রেমিক, সেটা পাইলটের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নাকি দেখা করতে গেছে আরেক প্রেমিকের সাথে। এই নিয়ে হাসাহাসি চলতো আমাদের। মাঝে মাঝে পাশের রিকশার মেয়ে যাত্রী দেখলে বলে উঠত,” মামা, সাইজ দেখছেন? কি বানাইছে!” আমি যখন কড়া দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতাম বেক্কেলের মত একটা হাসি দিয়ে বলত, “ আমিতো রিকশাটার কথা বলছি, নতুন নামাইছে। “
চার
একবার দুই দিন পাইলটের কোন দেখা নেই। ভাবলাম অসুখ করেছে হয়ত।
তৃতীয় দিনে দেখলাম মন খারাপ করে ভার্সিটির গেইটে বসে আছে। “ কিরে পাইলট, তোর মন খারাপ কেন?”
- আর কইয়েন না মামা, এই মাইয়া মানুষ জীবনে বিশ্বাস কইরেন না
- কেন? ছ্যকা খাইছিস নাকি?
- কি কমু কন, এই ছেমরির লাইগা কত কি করলাম, ছেমরি শেষে যাইয়া বিয়া বসছে হারুইন্নার লগে। হারুইন্না কি করে জানেন মামা?
- না জানি না, কি করে?
- হালায় মাইনষের রিকশা ভাড়ায় চালায়। কয় টেকা থাকে কন? আর আমার নিজের রিকশা, সবই আমার। এই ছেমরি কি বুইঝা বুইড়া ছাগলটারে বিয়া করলো?
- ওহ, এই কথা, এতে মন খারাপের কি আছে, আরেকটা আসবে।
- আর কইয়েন না মামা, এই চাপ্টার খতম, দুইদিন নাখালপাড়ায় গাঁজা টানছি। সব দুঃখ শেষ। ভাবতাছি এইবার বিলকিসের লগে চান্স লমু। বিলকিস বড় ভালো মাইয়া। আমারে আবার লাইক করে।
এইবার প্রেম পিরিতি না, ডাইরেক্ট একশন বিয়া কইরা ফালামু ভাবতাছি। মামা, একটা কথা কমু?
- হুম বলো।
- এই দুইদিন আপনেরে অনেক মিস করছি।
এই যাবত তিনটা প্রেমের প্রত্নতাত্নিক রহস্য পেয়েছি পাইলটের। বিলকিস চতুর্থ হতে যাচ্ছে।
নিন্মবিত্ত প্রেমকথা শুনতে খারাপ লাগতো না। প্রতিটা মানুষের জীবনে নিজের কিছু স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা থাকে। নিন্মবিত্ত এসব মানুষের সাথে খুব আপন হয়ে না মিশলে বুঝাই যায়না জীবনের কত রূপ কত রঙ।
পাঁচ
প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলো পাইলটের কোন দেখা নেই। ভাবলাম বিলকিসের সাথে হয়ত কোন কাহিনী হয়েছে আবার, তাই হয়ত গাঁজা খেয়ে নাখালপাড়ায় পরে আছে।
আরো এক সপ্তাহ কেটে গেলো। বুঝতে পারছিলাম না কি হলো পাইলটের। যে ছেলে দুইদিন আমাকে না দেখলে তৃতীয়দিন ছুটে আসে, সেই ছেলের দুই সপ্তাহ কোন খবর নেই। একবার টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে সপ্তাহখানেক ঘরে পরে ছিলাম। পাইলট ভার্সিটিতে আমাকে না পেয়ে চলে এসেছিল বাসায়।
এই ছেলের তো এমন করার কথা না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছিল পাইলটের জন্য, চলে গেলাম নাখালপাড়া রেললাইনের বস্তিতে। সরোয়ার মিয়ার কাছে জানলাম পাইলট আর নেই। দুই সপ্তাহ আগে বাসের নিচে রিকশা সহ চাপা পরে স্পটেই মারা গেছে। সহ্য করতে পারছিলাম না।
এমন হাস্যোজ্বল একটা ছেলে এভাবে চলে গেলো? এমন করুণ মৃত্যু কেন পাইলটের হবে?
যখনি কোন রিকশাওয়ালা মামা বলে ডাকতো কেমন যেন অপরিচিত মনে হতো। পাইলটের মত করে কেউ কেন ডাকে না? ঢাকা শহরের হাজারো রিকশা চালকের মাঝে খুজতাম পাইলটকে। হয়ত দেখা যাবে পেছন থেকে এসে চমকে দিয়ে বলবে, “ মামা রিকশায় উঠেন” , কিন্তু কখনো হয়নি এমন। তবুও আমি আশায় থাকতাম পাইলট আসবে। আমার স্বপ্নে প্রায়ই পাইলট এসে দেখা দিয়ে যেতো।
বলতো,
“ মামা, ঘুম থেকে উঠেন। রিকশা নিচে রাইখা আসছি। “
ছবিঃ নিজের এ্যালবাম থেকে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।