আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাপ্তাহিক (অনিয়মিত) খাবার পত্র, সংখ্যা-৬

কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবারই সমান রাঙা যাহা খাইব সত্য খাইব ‘কি বললি!!!’ বন্ধুর আর্তচিৎকার হিন্দি সিরিয়ালের মত দূরে কাছে করে দুই তিনবার শুনিতে পাইলাম। কানের মধ্যে বিটিভির টিউনিং এর মত নিচু এবং তীক্ষ্ণ আওয়াজ বাজিতে থাকিলো। মাথা ঝাঁকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম- ‘কি হইয়াছে?’ বন্ধু আগের মত রাগতস্বরে বলিলো- তুই লক্ষ্মীপুরের নাতনি এবং আমার বন্ধু হইয়াও সত্যনারায়ণের মিষ্টি খাস নাই? ব্লগে রসগোল্লার কথা লিখিতে লজ্জা করেনা? আমি সানন্দে বন্ধুর কথা উড়াইয়া দিলাম কিন্তু মনের মধ্যে ভাঙা রেকর্ডের মত বাজিতে থাকিলো- সত্যনারায়ণের মিষ্টি……সত্য মিষ্টি………মিষ্টি!! কালক্রমে আমি সত্যনারায়ণের নাম ভুলিয়া গেলেও লক্ষ্মীপুরে গেলে যে আমাকে কোন এক বিখ্যাত দোকানের মিষ্টি খাইতে হবে এই কর্তব্য ভুলিলাম না। (আহা! বাংলাদেশের সকলেই যদি আমার মতন কর্তব্যপরায়ণ হইতো!!) অসহিষ্ণু পাঠক, আইসো তোমাকে ঘটনার আদি, বর্তমান সম্পর্কে ওয়াকেফহাল করি। আমার নানাবাড়ি এবং আমার বন্ধুর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়।

বন্ধু তখন লক্ষ্মীপুর ছুটি কাটাইতে গিয়াছিল আর আমাকে ফোন করিয়া আহ্লাদে আটখানা হইয়া সত্যনারায়ণের মিষ্টি খাওয়ার কথা শুনাইতেছিল। আমার উৎসাহের কমতি দেখিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল- আমি যে একলা একলা সত্যনারায়ণের মিষ্টি খাইতেছি তোর হিংসা লাগিতেছেনা? আমি উত্তর করিলাম- এ আর কি এমন মিষ্টি হইবে! তখনই বন্ধুর আর্তচিৎকার এবং উক্ত কথোপকথন। তার অনেককাল পর আমি বাপজানের সহিত নানাবাড়ি যাইতেছিলাম। বাপজানকে জিজ্ঞাস করিলাম লক্ষ্মীপুরের কোন বিখ্যাত মিষ্টান্নভান্ডার চেনা আছে কিনা। বাপজান বিভিন্ন নাম বলিলেন কিন্তু একটাও বন্ধুর বলা নামের সাথে মিলিলো না।

বন্ধু আবার তখন খুলনায় বন্য বাঘ না থুক্কু সিনিয়রদের সহিত খাতির করিবার চেষ্টা করিতেছিল। তাই আমার বারংবার মুঠোফোনে ডাকাডাকি করা স্বত্বেও কোন তথ্য মিলিলো না। আমি মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া নানাবাড়িতে পৌঁছাইলাম। বাপজান আমাকে পৌঁছাইয়া দিয়া যাইবার সময় পই পই করিয়া বলিয়া গেলেন, এলাকা চিনিবো না এবং আরো নানাবিধ সমস্যার কারণে আমি যাতে বাড়ির বাইরে বেশি না যাই। নানাবাড়িতে ছিল আমার প্রিয় মামাতো বোন।

আমি করুণ স্বরে তাহাকে ঘটনা বর্ণনা করিলাম। সে বলিলো- ও আচ্ছা সত্যনারায়ণের মিষ্টি! তোকে কালকেই নিয়া যাব। আহা কি আনন্দ! সেদিন রাত্রে মিষ্টি মিষ্টি স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে ঘুমাইলাম। সকালে তড়িঘড়ি করিয়া উঠিয়া আপুকে ঝাঁকাইতে থাকিলাম। আপু ভূমিকম্পের আশংকায় লাফাইয়া উঠিল এবং বুঝিতে পারিল কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নহে বরং আমার মধ্যে মিষ্টি খাওয়ার প্রবল উৎসাহের দরুণ এই ঝাঁকাঝাঁকি।

মামাবাড়িতে আসিলেই যে মামী লাঠি নিয়া আসিবে এই কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করিয়া (অবশ্য যতদিন থাকিলে মামীর লাঠি নিয়া আসার সম্ভাবনা তত দীর্ঘদিন আমি কখনোই নানাবাড়িতে কাটাইনাই) মামী গরম গরম পরোটা আনিয়া দিলেন। পরোটার সদ্ব্যবহার করিয়া আমি আর আপু লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হইলাম। প্রায় একশো টাকার রিকশা ও সিএনজি ভাড়া ব্যয় করিয়া কেন আমাদের মিষ্টি খাইতে যাওয়া প্রয়োজন তাহা মামীকে বুঝাইতে অবশ্য একটু বেগ পাইতে হইয়াছিল। আমি ‘মিষ্টি...মিষ্টি...’ আর আপু ‘আসিতেছে……আসিতেছে’ জপিতে জপিতে লক্ষ্মীপুর সদরে উপস্থিত হইলাম। রিকশায় করিয়া নানা গলি ঘুপচি পার হইয়া, তিন চারবার পথ হারাইয়া অবশেষে সত্যনারায়ণে উপস্থিত হইলাম।

এতকাল পরে বুঝিতে পারিলাম আর্কিমিডিস কেন ইউরেকা বলিয়া চেঁচাইয়া উঠিয়াছিলেন। আমরা অবশ্য সেদিকে না গিয়া সত্যনারায়ণের ছোট্ট দোকানের ভিতর পদার্পণ করিলাম এবং একখানা টেবিলে জাঁকাইয়া বসিলাম। হঠাৎ মনে পড়াতে ফিসফিস করিয়া আপুকে বলিলাম, ‘আপু আমি তো মিষ্টি বেশি খাইতে পারিনা। তীব্র মিষ্টি খাইলে একটু কেমন কেমন যেন লাগে। (পাঠক, এইবেলা তোমার অবিশ্বাসে কপালে তোলা চোখ নিচে নামাইয়া আনো।

আমি একটু খাদক প্রকৃতির বলিয়া যে সকল জিনিস বেশি বেশি খাইবো তাহা কোনো শাস্ত্রে লেখা নাই) যত যাই হোক আমারই তো বোন! সেও মাথা নাড়িয়া সম্মতি জ্ঞাপন করিল। আহা এই দুর্দিনে যদি বন্ধু থাকিত!! সে দেখাইয়া দিত মিষ্টি খাওয়া কাহাকে বলে! বন্ধুকে মুঠোফোনে ডাকিলাম। বন্ধু সত্যনারায়ণে আসিয়াছি, কি মিষ্টি খাইবো বল তো। বন্ধু তখন খুবই কষ্টকর ভ্রমণ করিয়া খুলনা থেকে ঢাকা আসিতেছিল। আমার কথা শুনে তার মেজাজ বিগড়াইয়া গেল।

যা ইচ্ছা তা খা, আমার মাথা খা ইত্যাদি বিবিধ উপদেশ দেয়া শুরু করিল। অনেক কষ্টে তাহাকে ঠান্ডা করিবার পর এক শব্দে বলিলো- ‘ক্ষীরভোগ’। বলিয়াই লাপাত্তা। মুঠোফোন হইতে আজব আজব শব্দ শোনা যাইতে থাকিল। এরই মধ্যে দোকানের পিচ্চি আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল ‘আপা কি খাইবেন?’ আমি বলিলাম- যা যা আছে নিয়া আসো।

পিচ্চি অবাক হইয়া বলিল- পরোটার সহিত খাইবেন? আমি মনে মনে বলিলাম- do i look like আমি পরোটার সহিত মিষ্টি খাইবো!! মুখে বলিলাম- না না। খালি মিষ্টি আনো। পিচ্চি প্রথমে বিরাট বড় দুইটা রসগোল্লা নিয়া আসিলো। আমি ভাবিলাম, এতদিন কোথায় ছিলে গো!! আস্তে আস্তে বড় রসগোল্লা সাবাড় করিলাম। এখনো মুখে সেই প্রথম স্বাদ পাইতেছি।

মিষ্টির একেবারে সঠিক পরিমাণ। আহা, একেই বুঝি অমৃত বলে! পাঠক জানো তো? মুজতবা আলী বলিয়াছিলেন, স্বর্গে যদি ইলিশ মাছের ব্যবস্থা থাকে তবে তিনি নিশ্চিন্তে স্বর্গে যাইতে রাজি আছেন। তাহার ভাবশিষ্য হিসাবে আমি আরেকটু যোগ করিলাম, ইলিশ মাছ আর এই রসগোল্লা থাকিলে এতদিনের পুঞ্জিত পাপ কাটান দেয়ার চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারি। তারপর আসিলো সন্দেশ। এইটাও আমার অতি পছন্দের মিষ্টি।

খাইতে খাইতে আপুর সহিত গালগল্প করিতে থাকিলাম। আপু দুঃখ করিতেছিল, তাহার জন্য কেহ কোনদিন ফুল নিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলো না!! আমি তাহাকে সান্ত্বনা দিলাম- আপু কোন চিন্তা করিও না। আমি তোমার জন্য এমন দোয়া করিতেছি যে বাবাজী একেবারে ফুলকপি নিয়া হাজির হইবে। আপু কিছুক্ষণ হাসাহাসি করিয়া সেই অদেখা বাবাজীর কথা মনে করিয়া উদাস হইয়া পড়িল। আমি ক্ষীরভোগ ভোগে মনোযোগী হইলাম।

চামচে করিয়া একটুখানি মুখে দিতেই আমার সমস্ত শরীর ঝনঝন করিয়া উঠিলো। এমন তীব্র মিষ্টি আমি কখনোই খাইনাই। প্রতি কামড়ে কেমন নেশা ধরিতে থাকিল। গুনগুন করিয়া গান ধরিলাম, নেশা লাগিলো রে...... আপুর অবস্থাও তদ্বৎ। পিচ্চিকে আর মিষ্টি আনিতে মানা করিলাম।

একেকখানা মিষ্টান্নতে মিষ্টির পরিমাণ যে হারে বাড়িতেছে তাতে ক্ষীরভোগের পর কি আসিবে তাহা চিন্তা করিয়াও ভয়ে জড়োসড়ো হইলাম। তাই মিষ্টি খাওয়ার এইখানেই সমাপ্তি। ফিরিবার সময় আপুকে জিজ্ঞাসা করিলাম- আপু কেমন লাগিয়াছে বলো? আপু বলিল- দাঁড়া মাথা ঘুরাঘুরি বন্ধ করিলে বলবো নে। আমার আর আপুর সেই মাথা ঘুরাঘুরি কবে বন্ধ হইয়াছিল তাহা আর এতদিন পর মনে নাই। শুধু মনে আছে এই যে, রাতের বেলা বন্ধু জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, সত্যনারায়ণে কি কি খাইলি? আমার বর্ণনা শুনিয়া বন্ধু বিশ্রী গলায় খ্যাক খ্যাক করিয়া হাসিয়া উঠিল।

এই খাইয়া তুমি খাবার পত্র লিখিবা!!! আমি অভিমান করিয়া বলিলাম, তাহা আর তোমাকে বলিতে হইবে না। আমার খাদক পাঠকেরাই ইহার বিচার করিবে। প্রিয় পাঠক, এইবার বিচার করো তো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।