লেখক দিশেহারা হয়ে বেপরোয়া ছুটে চলা
ফারুক আহমেদ
বাংলাদেশের সমাজ চিত্র এমন হয়েছে যে , যে স্তরের মানুষের দিকেই তাকানো যাক না কেন দেখা যাবে প্রতিটি মানুষ দিশেহারার মত বেপরোয়া ছুটে চলেছে । এ লক্ষ্যহীন ছোটা অথবা হতে পারে অসম্ভব লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলার যেন কোন শেষ নেই । এ ছুটে চলার যেন কোন ক্লান্তি নেই অথবা সবসময়ের জন্য ক্লান্তির মধ্যে থাকা মানুষের ক্লান্তির অনুভুতি বা বোধটুকুও হারিয়ে গিয়েছে । দিশেহারা ছোটার সময় কেউ কারো কথা শুনছেন না ,কেউ কারো নিষেধ মানছেন না অথবা কথা বলার মত বা নিষেধ করার মত যেন কেউ নেই । দিশেহারা মানুষ কিছুই ভাবতে পারেন না, তাঁরা অপরিণামদর্শী ।
বেপরোয়া ছুটে চলা তাঁর আগের ছুটে চলা মানুষটির বিভৎস পরিণাম দেখেও আবার সে দিকেই ছুটে চলেছেন । ছুটে চলতে চলতে এলোমেলো বিক্ষিপ্তভাবে ভাবছেন আগেরজন বোকা ছিল কিন্তু তিনি তো আর আগেরজনের মত বোকা নন তাই বিভৎস পরিণাম তাঁর জন্য নয় । তিনিও যখন বিভৎস পরিণামের শিকার হচ্ছেন তখন তাঁর পিছের জনও একইভাবে ভাবছেন । এমনই বেপরোয়া আর দিশেহারা অবস্থা যে , পথটাই যে বিভৎস ওপথে বিভৎসতা অনিবার্য এবং এ ছাড়া আর কিছু ঘটতে পারে না এ কথা কেউ ভাবছেন না । মানুষের এই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ছুটা দেখে মনে হয় যেন সমাজে আগুন লেগেছে ।
অগ্নিতাড়িত মানুষ বেপরোয়া দিশেহারা হয়ে ছুটছেন । কেউ ছুটছেন সর্বস্ব হারিয়ে শুধু বাঁচার তাগিদে , কেউ ছুটছেন নিজের আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে আবার কেউ ছুটছেন এই সুযোগে নিজের আশ্রয়টুকু আরো মজবুত করতে । মানুষের সমাজ জীবনে অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতার আগুন এখন চারদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে ,মানুষের বিচারবোধ ,যুক্তি , বিবেক বিবেচনা কোন কিছুই আর কাজ করছে না । গোটা সমাজ হয়ে পাড়েছে নীতিহীন , সামনে এগুনোর পরিচালনা শক্তিহীন , অভিভাবকহীন । একজন মানুষ এক হিসাব থেকে বেপরোয়াভাবে যা করছেন অন্য হিসাবে দাঁড়িয়ে আবার সেই কাজ করার জন্য বিলাপ করে কাঁদছেন ।
অন্যজন আবার সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন তেমন নয় ।
সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রে দিশেহারা বেপরোয়া অবস্থা থাকলেও সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে মধ্যশ্রেণীর বেপরোয়া অবস্থা যেন সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে । শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এবং সরকারের নিদারুন আবহেলা ,উদাসীনতা , পরিকল্পনাহীনতা এবং সকল ক্ষেত্রে পরীক্ষা আর প্রতিযোগিতার নীতির কারণে প্রতিটি মানুষ আজ তাঁর সন্তানের শিক্ষাজীবন , পরবর্তী কর্মজীবন নিয়ে ভীষনভাবে উদ্বিগ্ন এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত । এই উদ্বিগ্নতা এবং শংকা বাড়তে বাড়তে মানুষ এখন দিশেহারা ও বেপরোয়া । এই দিশেহারা এবং বেপরোয়া অবস্থার মধ্যে মানুষ তাঁর সন্তানকে শিশু অবস্থা থেকে শুরু করে তার শিক্ষা জীবণের শেষ পর্যন্ত যেভাবে রেসের ঘোড়ার মত প্রতিযোগিতার ময়দানে নিক্ষেপ করছেন তা শুধু বর্তমানের জন্যই নয় সুদুর ভবিষ্যতের জন্যও আতংকের এবং ভীতিকর ।
মানুষের এ অবস্থা নিয়ে সরকারের শীর্ষ ব্যাক্তিরা মাঝে মধ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ , ঠাট্টা-মষ্করা আর তামাশার মত করে কিছু কথা বার্তা বললেও এ ব্যাপারে যেন তাদেঁর কোন দায়ীত্ব নেই এবং এ অবস্থা বদলানোর জন্য তাদেঁর করণীয়ও যেন কিছু নেই ।
সকল শিশুর পক্ষে একই বিষয়ে সমান পরদর্শী বা সমান মেধাবী হওয়া যে সম্ভব নয় মধ্যশ্রেণীর মানুষের মাথা থেকে এই সহজ সত্যটি যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। আইজ্যাক নিউটন বা অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মত বিশেষ কিছু হওয়ার বিষয় যদি বাদ দেওয়া যায়, তবে যে কোন পেশাজীবি বা সাধারণভাবে একজন শিক্ষিত মানুষ হওয়ার সাথে আর তাদের পরবর্তী কর্মজীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারার সাথে তথাকথিত বিরাট মাপের মেধাবী হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই । অতীত তো বটেই এমনকি বর্তমানেও যাঁরা জীবিত আছেন এমন সফল মানুষদের দিকে তাকালে এই সহজ সত্যটির প্রমাণ পাওয়া যাবে । এই সহজ সত্যটিকে ভুলে গিয়ে শিক্ষিত , অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রায় সকল অভিভাবক তাঁর শিশু সন্তানটিকে নিয়ে যেভাবে রেসের ময়দানে হাজির হচ্ছেন তা রীতিমত আতংকজনক ।
শিশুর প্রথম স্কুল ভর্তি নিয়ে এ রেস শুরু হয়ে যায় । জনগণের জন্য অপরিকল্পিত শিক্ষানীতির কারণে অথবা সরকারের দিক থেকে বিশেষ পরিকল্পনার কারণে হাতে গোনা কয়েকটি বিদ্যালয়ের গায়ে সরকারের তরফ থেকেই ‘ভালো’র সিল মেরে দেওয়া হয় । এসব ‘ভালো’ স্কুলে ভর্তির জন্য শিশুদেরকে দিয়ে প্রথম রেস দেওয়ানো শুরু হয়ে যায় । অক্ষর জ্ঞান লাভের আগেই অসংখ্য শিশু ‘অযোগ্য’ প্রমাণ হয়ে যায় । তার স্বাভাবিক বিকাশে প্রথম ধাক্কা লাগে ।
এ অবস্থা শুধুমাত্র ঢাকা শহরের জন্যই সীমাবদ্ধ নয় অন্যান্য সকল শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত মধ্যশ্রেণীর মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে । একবার অযোগ্য প্রমাণ হলেই নিস্তার নেই এ রেস শিশুর জীবনে প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে আসে । আগেকার দিনে যা’ কল্পনা করা যেত না এখন তাই হচ্ছে । বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগেই শিশুদের কোচিং করতে হচ্ছে । পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সের শিশুদের পড়ালেখার কথা জিজ্ঞাসা করলে ব্যাপক অধিকাংশ অভিভাবকের নিকট থেকে জবাব পাওয়া যায় যে, তাঁর সন্তান কোন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না , ভর্তির জন্য কোচিং করছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব কোচিং করাচ্ছেন কথিত ‘ভালো’ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা । কথিত ‘ভালো’ বিদ্যালয়গুলো এবং সেসবের নানা অঞ্চলের শাখাগুলো সেখানে সরাসরি ভর্তির জন্য মোটা অংকের টাকা নির্ধারন করে দিচ্ছে । এসব টাকার অংক এক লক্ষ থেকে কয়েক লক্ষ পর্যন্ত হয়ে থাকে । সুষ্ঠু –সাধারণ চিন্তা এবং বিচারবোধের কাছে অবাক করার মত ব্যাপার হলেও এত টাকা দেনেওয়ালাদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা হতে দেখা যাচ্ছে ।
এসব রেস এবং স্বাভাবিক বিচারবোধের বাইরের কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে যারা ‘ভালো’ স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল তাদের যে রেস থেমে গেল তা নয় ।
তখন আবার শুরু হয় পরীক্ষায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের রেস । সন্তান কতখানি শিখলো , কতখানি চিন্তা করতে শিখলো এসব কোন কথা নয় কাড়িঁ কাঁড়ি নম্বর চাই , প্রথম হওয়া চাই । এই কাড়িঁ কাড়িঁ নম্বর পেতে গিয়ে যদি সন্তানের সাধারণ বিচারবোধও লোপ পায় তবে তাই পাক তবুও নম্বর চাই । এই হলো আজকের দিনের অভিভাবকদের বেপরোয়া চাওয়া । আর এই চাওয়ার সুযোগ নিয়ে শুরু হয়েছে পরীক্ষার ছড়াছড়ি ।
যত ‘ভালো’ স্কুল তত সেখানে পরীক্ষার বাড়াবাড়ি । তাৎক্ষণিক পরীক্ষা , সাপ্তাহিক পরীক্ষা , মাসিক পরীক্ষা নামে নানা পরীক্ষাতো আছেই তাছাড়াও বছরে বড় পরীক্ষা আছে কমপক্ষে তিনটি এবং ‘ভালো’ স্কুলে তার সংখ্যা চারটি । এসব পরীক্ষাতো আছেই আর এসব পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য প্রাইভেটে পরীক্ষার কোন হিসাব নেই । সেসব প্রাইভেট পরীক্ষা আবার এককভাবে মূল্যায়নের জন্য কোন পরীক্ষা নয় । এসব পরীক্ষাও আবার বহুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক ।
বহুক্ষেত্রে এসব পরীক্ষায় আবার কোচিং সেন্টারগুলো আকর্ষনীয় পুরষ্কার ঘোষনা করে থাকে । এসব পুরষ্কার প্রাপ্তির আশায় অভিভাবকেরা আকৃষ্ট হয়ে সন্তানদের প্রচন্ড শক্তিতে এর মধ্যে নিক্ষেপ করে । অসংখ্য পরীক্ষার চাপে কুঁজো হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সাধারণ বিচারবোধ পর্যন্ত লোপ পেতে থাকে । এই বেপরোয়া রেসের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা এক একজন শিক্ষার্থী যেন এক একটি রোবট ।
এখন যাঁরা দেশ পরিচালনা করছেন তাঁরা সহ দেশের যাঁরা চিন্তাশীল মানুষ আছেন , দেশের যাঁরা বুদ্ধিজীবি তাদেঁর স্কুল জীবনে ,কলেজ জীবনে কি এত পরীক্ষার বাড়াবাড়ি ছিল ? তাহলে তাঁদের শিক্ষা কি অপূর্ণ ছিল ? তাঁরা কি আজকের তুলনায় কম শিখেছেন ? তাঁদের কি সাধারণ বিচার বোধ আজকের শিক্ষার্থীদের মতই শূন্যের কোঠায় ছিল ?রেস থামিয়ে একটু চিন্তা করলে এসব প্রশ্নের জবাব সবারই জানা ।
কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হলো এই যে , পরীক্ষার নামে শিক্ষা নিয়ে যে রমরমা ব্যবসা চলছে সে ব্যাপারে কোন বুদ্ধিজীবিরই কোন উৎকণ্ঠা নেই এবং কাউকেই এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে শোনা যাচ্ছে না । শিশু অবষ্থা থেকেই পরীক্ষার এই রেস শুরু হয় । দীর্ঘস্থায়ী এ রেসের মধ্য থেকে ছিটকে কতজন বিপথগামী হচ্ছে তার কোন হিসাব নেই । তবে সমাজের মধ্যে চারদিকের নানা নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলার পরিমাণ থেকেই এর একটি পরিমাণগত হিসাব পাওয়া যেতে পারে । একজন শিক্ষার্থীর ভিতরের চাহিদা আর চাপের ফলে বাহ্যিক চাওয়ার অসংগতি তার মনো জগতে কিভাবে বিপথগামী হওয়ার বীজ বপন করে তার ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞানীরা দিতে পারবেন ।
এখানে একটি কথা বলা খুবই জরূরী তা হলো , জানার জন্য, শেখার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা আর রেস দিয়ে ছুটে চলা এক কাথা নয় । একজন শিক্ষার্থী পাঠ করে না সে করে অধ্যয়ন । অধ্যয়ন মানে গভীর মনোসংযোগের ব্যাপার । শেখার প্রবল টানে শিক্ষার্থীর মনে কারো সাথে প্রতিযোগিতার ভাব উদয় হয়না । জানার তীব্র নেশায় সে লেগে থাকে ।
সেখানে তথাকথিত মেধাবী অমেধাবীর কোন প্রশ্ন নয় শেখার প্রশ্ন,জানার প্রশ্ন । শেখার দুর্বার আকাঙ্খার নেশা ধরিয়ে দেয় যে প্রতিষ্ঠান তার নাম বিদ্যালয় । বিদ্যালয় হলো শেখানোর জায়গা । বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিবে নিজের দায়ীত্বের হিসাব নেওয়ার জন্য । না শিখিয়ে অসংখ্য পরীক্ষার আযোজন করে শিক্ষার্থীদের অযোগ্য প্রমাণ করার জন্য নয় এবং অভিবাবকদের ডেকে নাজেহাল করার জন্য নয় ।
স্কুল এং কলেজগুলোতে অধিক পরীক্ষার আয়োজন করতে গিয়ে নির্ধারিত সিলেবাসের জন্য বরাদ্দ ক্লাশে পড়ানোর সময় সংকুচিত করা হচ্ছে । শুধূ তাই নয় নির্ধারিত সিলেবাস পড়ানোর ক্ষেত্রে কোন ধারাবাহিকতা না রাখার কারণে বিশেষ করে কলেজের শিক্ষার্থীরা কোন কিছুই ক্লাশে বুঝে উঠতে পারে না । সে কারণে বর্তমানে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা হল বিদ্যালয় হচ্ছে সরকারী সনদ প্রাপ্ত পরীক্ষা নেওয়ার প্রতিষ্টান আর কোচিং সেন্টারগুলো হচ্ছে শেখার যায়গা । প্রতিষ্টানগুলোর এসব কেৌশলের কারণ হলো সেখানকার প্রায় সকল শিক্ষকেরই কোচিং সেন্টার আছে । বিদ্যালয়ের এসব আচরণ , সমাজে সন্তানের কর্মের নিদারুন অনিশ্চয়তা ,অভিভাবকদের নিজেদের অস্থিরতা এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ,শিক্ষা নিয়ে সরকারগুলোর বাগড়ম্বড় অথচ চরম অবহেলা , দুর্নীতিসহ অসংখ্য সংকটের মধ্যদিয়ে অভিাববকদের মধ্যে আজকে যে দিশেহারা বেপরোয়া অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু সমাজতো দুরে থাক একটি চরম বিশৃঙ্খল এবং বিবেক-বুদ্ধিহীন সমাজের প্রতিচ্ছবিই ফুটে ওঠে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।