আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেঘের খোঁজে মেঘের দেশ পাহাড় দানব কেওক্রাডং

বঙ্গাব্দ-১৪১৬ বর্ষাকাল, আষাঢ়ের শেষ দিনগুলোতে মেঘের আনাগুনা থাকলেও বৃষ্টির প্রকোপ তেমন নেই, সামনে শ্রাবণের হাতছানি তাই বোধহয় প্রকৃতি তার মেঘমালা সঞ্চিত করে রেখেছে বৃষ্টি রুপে অঝোর ধারায় ঝরবে বলে। প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্র্যের বর্ষা এভাবেই ষড়ঝতুর এই বাংলায় প্রাণ সঞ্চার করে, যার আতিথেয়তা গ্রহণে সদা উন্মুখ একদল ভ্রমনপিপাসু। লেট’স ট্রাভেল ভ্রমন দলটি এরকম সময়ে ভ্রমণে সদাপটু, প্রকৃতির পালাবদল এবং উৎসবের আমেজ পেলেই আমরা ছুটে বেড়াই বাংলার প্রকৃতির পথে-প্রান্তরে। শ্রাবণের আগমন ও পাহাড়-পর্বতে মেঘের আনাগুনা, তাইত লেট’স ট্রাভেলের বন্ধুরা মিলে এবারের লক্ষ ঠিক করলাম ঐ পাহাড় দানব কেওক্রাডং চূড়া। বাংলাদেশের মানচিত্রের দক্ষিন-পূর্বাংশে বান্দরবন জেলার রুমা উপজেলার তিন নং রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নে এর অবস্থান।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় শৃঙ্গসমূহের মাঝে কেওক্রাডং এর অবস্থান তৃতীয় যার শৃঙ্গের উচ্চতা তিন হাজার একশত বাহাত্তর ফুট, সাকাহাফং ও ডুম-লং পাহাড় শৃঙ্গ আবিষ্কারের পূর্বে এটিই ছিল এদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতম স্থান। ঊনত্রিশে আষাঢ় আজ রাতের বাসে করে রওনা হব বান্দরবনের উদ্দেশ্যে, সকল প্রস্ততি সম্পন্ন কিন্তু বিপত্তি একটাই বান্দরবনগামী যে সকল বাস সার্ভিস রয়েছে তাদের কোনটিতেই দুদিন আগে থেকে চেষ্টা করেও ছয়টি খালি সিট পেলাম না। অগত্যা ভিন্ন পথে যেতে হবে তাইত বিকাল পাঁচটায় বাসা থেকে বের হয়ে ঠিক করলাম আরামবাগ যাব কমালাপুর হয়ে ট্রেনে, সেখানে শেষ চেষ্টা করব সরাসরি বান্দরবনের বাসের জন্য। বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ট্রেনের টিকেট আনতে ফয়সাল, নোমান ও আনিস গেল কিন্তু এদিকে ট্রেন চলে এসেছে খুলনা থেকে চিত্রা এক্সপ্রেস, উঠে পরলাম আমরা অপেক্ষা করছি ওদের জন্য, এলো কিন্তু ট্রেনে দেখি ওরা তিনজন আমাদের বগিতে নেই সাক্ষর বলে উঠল ঐতো পাশের বগিতে, টিল ঠাই জায়গা নেই তারপরেও ওরা ভীর ঠেলে চলে এল আমাদের বগিতে টিকেট ছাড়া অগত্যা বিনা টিকেটে ভ্রমন। কমলাপুর নেমে চলে এলাম ইউনিক,এস আলম,শ্যামলী বাস কাউন্টারে না টিকেট পেলাম না, তাহলে উপায় এখন চট্টগ্রাম হয়ে বান্দরবন, কমলাপুর-আরামবাগ বাস কাউন্টার ঘুরে চট্টগ্রামের ছয়টি টিকেট পেলাম না, তখন আমাদের বোধগম্য হল আজ বৃহস্পতিবার রোববার পবিত্র শবে-বরাত সুতরাং ঢাকা আজ থেকেই হয়ে যাবে ফাঁকা।

আমাদের যেতেই হবে তাইত চললাম সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের পথে, রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে রাত আটটা তিরিশে পৌঁছলাম, এখানেও চট্টগ্রামের টিকিট পেলাম না হঠাৎ চোখে পড়ল শাহ আমানত নামের বাস সার্ভিসের দিকে ওদের টিকিট আছে কিন্তু গাড়ির দশা বেহাল, উপায় নেই সবাই বলে উঠল তাই টিকেট নিয়ে উঠে পড়লাম। নয়টার বাস ছাড়ল সারে নয়টায়, একে একে ঢাকা পেরিয়ে নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী পারি দিয়ে ভোর চারটায় পৌঁছলাম চট্টগ্রাম। ত্রিশে আষাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন চট্টগ্রাম শহর ভোর না রাত বুঝতে পারছিলাম না তাইত নেমে পরলাম জি,ই,সি মোড়ে অপেক্ষা করছি ভোরের আলোর, পাশেই একটা রাতের টং দোকান চা-বিস্কিট খেয়ে রওনা হলাম রাইডারে করে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের উদ্দেশ্যে। ভোর পাঁচটায় পৌঁছলাম কিন্ত টার্মিনাল তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন, এখান থেকেই বান্দরবনের লোকাল বাস প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে যাতায়াত করে। পূরবী-পুর্বাণী বাস কাউন্টার, সকাল ছয়টায় বাস ছাড়ার সময় কিন্তু ছাড়ল সাতটায় আবার ছুটে চলা সারারাত কেউ ঘুমায়নি তার স্পষ্ট জলছাপ সবার চোখেমুখে দুইঘণ্টা বিশ মিনিট পরে পৌঁছে গেলাম বান্দরবন বাস টার্মিনালে।

বান্দরবনে এর আগেও আমরা এসেছি তাই শহরটাকে অপরিচিত মনে হচ্ছে না। আমাদের পরিকল্পনা মতো এখন আমরা বান্দরবন শহর হতে রুমা বাজার যাব, না চান্দের গাড়িতে নয় আমরা যাব রোমাঞ্চকর এক নৌ-যাত্রায় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সাঙ্গু নদ দিয়ে, এরকম রোমাঞ্চকর ভ্রমণ সাধারনত কেউ করে না কিন্তু আমাদের চিন্তা চেতনায় ছিল সাঙ্গু নদ-সাথে পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে নৌ-পথে যাব রুমা। আমরা একটা অটো নিয়ে রওনা হলাম বালাঘাটের উদ্দেশ্যে, কিন্তু চালক জানালো ঘাটে এখন নৌকা পাওয়া যায় কম তবে শহরের সাঙ্গু ব্রিজের পাশে হোটেল পাহাড়িকা এর পিছন থেকে সহজেই পাওয়া যাবে, তিনি আমাদের সেখানে নামিয়ে দিলেন ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই নৌকা পেয়ে গেলাম। এখান থেকেই নৌকা ভাড়া করে আমাদের যেতে হবে রুমা, ইঞ্জিন চালিত নৌকা রির্জাভ ভাড়া চাইল সারে তিনহাজার টাকা দু’হাজারে যেত কিন্তু অন্য নৌকার মাঝি জনপ্রতি একশত টাকা চাইল ছাড়বে বারটায় ঘড়ির কাঁটায় তখন সোয়া এগারটা, আর্থিক ভাবেও সাশ্রয় তাইত সবাই রাজি হয়ে গেলাম। পথের ক্লান্তি দূর করে ভ্রমণের নব উদ্দীপনায় আমদের চিত্রগ্রাহক নোমান, আনিস ও সাক্ষর তাদের ডি,এস,এল,আর ক্যামেরায় ক্লিক করতে লাগল।

মাঝি ইলিয়াস ভাই জানাল এখান থেকে রুমা যেতে চার ঘণ্টার বেশী লাগবে এবং তারা যাত্রীর সাথে দৈনন্দিন পন্য সামগ্রী পরিবহন করে যা বান্দরবনের দুর্গম পাহাড়ি জনপথে নৌ-পথে সহজেই নেয়া যায়। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর একটা, কয়েকজন আদিবাসী এবং আমরা সাথে কিছু মালামাল নিয়ে ইলিয়াস ভাই নৌকা ছেড়ে দিলেন রুমা বাজারের পথে। মাসুম যার কথা না বললেই নয় আরামপ্রিয় ও মিশুক একটা ছেলে এবারই প্রথম দুর্গম যাত্রায় কি যেন ভেবে আমাদের সাথে ভ্রমণে বেরিয়েছে, আমরা সবাই যখন নৌকার ছাউনির উপর সে তখন রোদের ভয়ে নীচে আদিবাসী যাত্রীদের সাথে গল্পে মশগুল। পাহাড়ের বুক চিরে সাঙ্গু বয়ে চলেছে সেই অনন্তকাল হতে আজ আমরাও চলেছি সেই পথে, সামনেই একটা ব্রিজ এপার হতে ওপার পর্যন্ত দুপাশে বাড়িঘর সাথে সবুজের সমারোহ। কর্মব্যাস্ত মানুষ কেউ মাছ ধরছে কেউবা গবাদি পশু গোসল করাচ্ছে, ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে মনের আনন্দে, কিছু দূর এগিয়ে দেখি একদল আদিবাসি মারমা মেয়ে একই রকম রঙিনসাজে সাঙ্গুর পাড়ে স্নান করছে।

আশপাশের ছোট টিলার আঁকাবাঁকা সাঙ্গুর পথ পেরিয়ে হঠাৎ সামনেই দেখি দুপাশে সারিসারি পাহাড় মাঝ দিয়ে বুক চিরে বয়ে চলেছে সাঙ্গু, প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে গেল তাইত অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম সবাই। আল্লাহু তা-আলার অপার সৃষ্টি যা গত বার দেখেছিলাম চিম্বুক পাহাড়ের উপর হতে এবার দেখছি সাঙ্গু নদ থেকে পার্থক্য বিশাল না দেখলে বিশ্বাস হবে না, ডান পাশের ঐ পাহাড় গুলোই নাকি চিম্বুক রেঞ্জ এর অংশ জানালেন ইলিয়াস ভাই, এভাবেই কেটে যাচ্ছে সময় কিছুদূরে সামনেই চোখে পরল একটা আদিবাসি অধ্যুষিত গ্রাম যার সর্ব উপরে সবুজের মাঝে আর্মি ক্যাম্প, কয়েকজন যাত্রি নেমে পরল তারপর আবার ছুটে চলা। নৌকার ছাউনির উপরে তীক্ষ্ণ রোদের সাথে দুপুরের ক্ষুধার উত্তাপ এখন চরম তারপরও প্রকৃতি যেন নীচে যেতে দিচ্ছে না। এভাবেই তিনঘণ্টা পেরিয়ে যাবার পর ইলিয়াস ভাই জানালো সামনেই নৌকা থামবে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা রয়েছে, রুমা যেতে এখানেই যাত্রা বিরতি নেয়া হয়। আমরা চলে এসেছি ঘ্রাউ ঘাট, পাহাড় ঘনজঙ্গল এর মাঝে সুন্দর একটা গ্রাম্য বাজার সত্তিই দারুন, নৌ-ঘাটটিও বেশ পরিপাটি চারধাপের পাকা সিঁড়ি উপরের বাম পাশেই ছোট একটা হোটেল, সামনেই ইউপি নির্বাচন পাহাড়ি আদিবাসি একদল তাই নিয়ে আলাপ করছে।

আমরা খাচ্ছি ভাত, ডিম ও মুরগির মাংশ সাথে অসম্ভব ঝালের ছোট পাহাড়ি কাঁচা মরিচ, সবচেয়ে বেশী খেলাম আমি। নৌকা ছেড়ে দিল কিছুদূর যাবার পর বাতাসের গতিবেগ কেমন যেন মনে হল রোদ যেন কোথায় হারিয়ে গেল সাঙ্গুর পানিতে ঢেউয়ের গতিবেগ হঠাৎ বেরে গেল সামনে তাকাতেই দেখি ঝিরিঝিরি করে বর্ষার বারতা নিয়ে বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়ে দিল, সে এক দারুন অনুভূতি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি হচ্ছে। ইলিয়াস ভাই জানালো গত সপ্তাহ থেকে পাহাড়ে বৃষ্টির দেখা নেই তাইত পানি অনেকটা কম, আজ থেকে আবার শুরু হল পাহাড়ি ঢল না এলেই হল। নদীর মাঝে বৃষ্টি পাশে সুউচ্চ পাহাড় অট্টালিকা যার উপর সবুজের আবাসন দেখতে দেখতে আমরা পারি দিচ্ছি সাঙ্গু। বৃষ্টি এখন হচ্ছে না, এগিয়ে যাচ্ছি আমরা নদীর বাঁকের উপরে পাহাড় যার উপর হেলান দিয়ে রয়েছে একস্তুপ মেঘ, যার জন্য আমাদের সাঙ্গু দিয়ে আসা এই বর্ষায়।

সাঙ্গু তার বাঁকে বাঁকে সৃষ্টি করেছে প্রাকৃতিক নৈস্ররগতা যার কিছুটা আমরা দেখছি এবং চেষ্টা করছি অন্তর থেকে অনুভব করার। পাহাড়ে বৃষ্টির পরে মেঘ দর্শন চমৎকার এক অনুভূতি কিছুদূর এগুলেই হয়ত পেয়ে যাব ঐ মেঘস্তুপকে, না পেলাম না চারিদিকে তখন মেঘের আনাগুনা কোথাও ভেসে যাচ্ছে না হলে স্তুপ হয়ে পাহাড়কে আঁকরে ধরে রয়েছে। এভাবেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম আমরা চলে এলাম সাঙ্গুর যেখানে তৈরি হচ্ছে সেতু, যার ফলে আগামী কয়েক বছর পর হতে রুমা যাওয়া যাবে সরাসরি সড়ক পথে। ঘড়ির কাঁটা তখন ছয়টার কাছাকাছি কিছুক্ষণ পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের গন্তব্য রুমা বাজার। বান্দরবন সদর থেকে আমাদের প্রায় ছয়ঘন্টা লাগল রুমা পৌছতে, ইলিয়াস ভাইয়ের সাথে দেনা-পাওনা পরিশোধ শেষে বিদায় নিয়ে নৌ-ঘাট থেকে উপরে উঠেই দেখি চারিদিকে মেঘের স্তুপ, ঠাণ্ডা শান্ত একটা পরিবেশ সন্ধা হয়ে পরছে তাই আমরা চলে এলাম হোটেল হিলটনের খোঁজে না বেশী দূরে নয় বাজারে প্রবেশের মুখে।

হোটেল হিলটন নাম যাই হোক থাকার জায়গা বলে কথা, দ্রুত দুটা রুম নিয়ে প্রাচীন জমিদারী কাঠের পেঁচানো সরু সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার ছাদের রুমে ঢুকেই বিছানায় পরে রইলাম। বেশীক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ নেই আগামীকালের যাত্রার কথা চিন্তা করে দ্রুত উঠে গোসল সেরে আধঘন্টার মধ্যেই ফয়সাল, সাক্ষর, আনিসকে সাথে নিয়ে বের হলাম বগালেক হয়ে কেওক্রাডং যাবার গাইডের খোঁজে কারন রুমা থেকে পরবর্তী যেকোন জায়গায় যেতে হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভ্রমনকারিদের জন্য গাইড বাধ্যতামূলক করেছে। হোটেল হিলটনের সামনেই গাইডের অফিস, গেলাম কথা বললাম কিন্তু সমস্যা একটাই বাঙ্গালি গাইড কিন্তু আমরা চাচ্ছি আদিবাসি, গাইড অফিসটি আসলে বাঙ্গালি একজনের মুদির দোকান তার উপর আমরা আবার চাচ্ছি আদিবাসি গাইড কেমন যেন একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম যার কারনে আমাদের রাত আটটায় আবার আসতে বলল কিন্তু আমরা পরিশ্রান্ত তাই খোঁজে বের করলাম ইয়ং বম এসোসিয়েশন নামের সংঘঠন। অফিসে তালা উপরে মোবাইল নাম্বার দেয়া ফোন দিলাম কথা হল আমাদের আসতে বললেন ঐ পথ ধরে সামনের এক ক্যারাম খেলার আড্ডায়, গেলাম কিন্তু পেলাম না ইতিমধ্যেই ফয়সালের সাথে দেখা হল এক আদিবাসির যিনি আমাদেরকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন কিন্তু একই সাথে আদিপথে এখন যাওয়া যাবে না কারন হাতি-জোঁক ঐ পথে অনেক বেশী যার এক কামড়ে সপ্তাহ পর্যন্ত রক্ত ঝরে একই সাথে আর্মিদের কোন অনুমতির দরকার নেই এইসব বকে চলেছে সেই তখন থেকে, বিরক্ত হয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখা পেলাম নৌকা যোগে আমাদের সাথে আসা একজনকে যিনি আমাদেরকে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা হল। ভাগ্যপ্রসুন্ন তাই এক মহাপাগলের পিছু ছুটিয়ে চলে এসেছি ধন্যবাদ দিয়ে বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে আবার ফোন দিলাম জানালাম আমরা অপেক্ষায় রইলাম আপনার অফিসের সামনে, মিনিট পাঁচেকের মাঝেই মোটরসাইকেল যোগে হাজির হল বিটু বম, সাধারন সম্পাদক, ইয়ং বম এসোসিয়েশন।

পরিচয় পর্ব শেষে অপেক্ষার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আন্তরিকতার সাথে তিনি আমাদের পরিকল্পনা শুনলেন এবং তাদের সংঘঠনের গাইড নেয়ার শর্তগুলো জানালেন দুপক্ষই রাজি সুতরাং কাল ভোর পাঁচটায় একজন বম গাইডকে সাথে নিয়ে আমরা রওনা দিব আদিপথে বগালেক। আমরা বিটুদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরছি পথে মাসুমের ফোন ভাই এখানে দুজন বন্ধু আমাদের সাথে যেতে চায়! হোটেলে ফিরে রুমে ঢুকে দেখি পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত মায়াবী চেহারায় দুজন সাথে মাসুম ও নোমান। কামরুল ও হুমায়ুন পরিচয় শেষে জানতে পারলাম বাড়ি থেকে তাদের পালিয়ে আসার গল্প, অসম্ভব ভালো দুজন মানুষ তাই ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম বিটুদাকে ওরাও যাচ্ছে আমাদের সাথে, রাতের খাবার খেয়ে ছাদে দেখা হল কিছুক্ষন আগে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামিউল-মাহিনদের সাথে কথা হল তারা পাঁচজন যাবে বগালেক হয়ে কেওক্রাডং। আমরা কজন জেগে আছি কিছু সময় ঠাণ্ডা এক নিভৃত পরিবেশে, অতপর রুমে এসে ঘুমিয়ে পরলাম খুব ভোরে উঠতে হবে। পহেলা শ্রাবণ আজ পহেলা শ্রাবণ, সারে চারটায় ঘুম থেকে উঠে সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে তৈরি হচ্ছি নতুন এক রোমাঞ্চকর দিনের প্রত্যাশায়, ভোরের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পরছে তাই তারাতারি সবাই নিচে নেমে হোটেলে চাবি জমা দিয়ে বেরিয়ে এলাম রুমা বাজারে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন পাঁচটা সামিউল-মাহিনরা বাঙ্গালি গাইড নিয়ে রওনা হয়ে গেল, আমরা সকালের নাস্তা খেয়ে অপেক্ষা করছি বিটুদার জন্য তিনি এলেন সাথে তরুণ একজন বম গাইড, আধঘণ্টা দেরি হল বলে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। বিটুদা ধ্রু ব্যাঙ্গ বম ওরফে রুবেল গাইডের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, দেখতে অনেকটা জ্যাকি চেং ক্ষিপ্র নকনকে শরীরের আদলে তৈরি তাই প্রথম দেখাতেই সকলের ভাল লেগে গেল। বিটুদা সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন আমাদের কাছ থেকে, রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্প থেকে আমাদের বগালেক হয়ে কেওক্রাডং যাবার অনুমতি নিতে হবে, তাই ইয়ং বম এসোসিয়েশনের ছাপা পাতায় প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করে আমরা চলে এলাম আর্মি ক্যাম্পে। আর্মি ক্যাম্পটি বাজারের সবচেয়ে উচু টিলার উপর স্থাপিত প্রবেশ মুখে বাঙ্কারে অস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম দেখে মনে হল যুদ্ধময়দানে চলে এসেছি, তাই দ্রুত অনুমতি নিয়ে আমরা সোজা রওনা হলাম আদিপথ ধরে, আমরা যাচ্ছি বগালেক না চান্দের গাড়িতে নয়, যাব আদিপথে ছয় ঘন্টা পায়ে হেঁটে উচুনিচু পাহাড়ি পথে সাথে রুমা ক্যানেলের ঘন নীল জলরাশি পেরিয়ে। রুমা বাজার পেরিয়ে আমরা আটজন চলে এসেছি বম আদিবাসিদের লাইরাম্পি গ্রামে ধ্রু বমের বাড়ি এখানেই তারপর প্রথম পাহাড়, চলে এলাম কিন্তু পাহাড়ের উপরে উঠেই মাসুমের বমি সাথে শ্বাসকষ্ট সবাই চিন্তিত কিন্তু লেট’স ট্র্যাভেলের আইনশর্ত মোতাবেক ওকে হোটেলে ফিরে যেতে বলা হয় এবং আমাদের ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়।

একজন বন্ধুকে হারিয়ে আমরা ছুটে চলেছি বগালেকের পথে সবার মনভারাক্রান্ত তারপরও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে তাই ছুটে চললাম, পাহাড়ের পাদদেশ থেকেই রুমা ক্যানেলের নীল জলরাশির দেখা পেয়ে গেলাম সবাই হঠাৎ মাসুমের আওয়াজ আমি চলে এসেছি, এখন অনেকটা ভাল বলে জানাল আমাদের তাই আমরা একসাথে রওনা হলাম। আমরা চলেছি আদিপথে বগালেক দুপাশে সারিসারি আঁকাবাঁকা পাহাড় সাথে বনাঞ্চল বন্যপ্রাণী রয়েছে হয়তবা কিছুদূর সামনেই চোখে পরল পাহাড়ের দুপাশ বেয়ে আদিবাসিদের জুম চাষ সাথে বিস্তির্ন ধানক্ষেত পাশের রুমা ক্যানেল থেকে জমিতে পানি দিচ্ছে কৃষক। রুমা ক্যানেলের স্বচ্ছ পানিতে পাথরের সাথে তীব্রস্রোত তাই পথ চলতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে তারপরও এগিয়ে চলেছি সবাই, কামরুল ও মাসুম ঠিক করেছে গণনা করবে কতবার আমাদের রুমা ক্যানেলের এপার হতে ওপার-পার হতে হবে বগামুখপাড়া পর্যন্ত পৌছতে। হঠাৎ আমার পাদুকা দুটোর একটা ছিঁড়ে গেল উপায় নেই ওটাকে ফেলে যাওয়া ছাড়া অগত্যা পানি-পাথুরে এই পথে খালি পায়ে যেতে হবে আমাকে পাহাড়ি মাটির স্পর্শ নিয়ে তাইত ছুটে চললাম। আমরা হাঁটছি রুমা ক্যানেলের পাশ দিয়ে এভাবেই দুঘণ্টা হাঁটার পরে ধ্রু বম জানালো সামনেই একটা উপজাতীয় বসতি সাথে বিকিকিনির দোকান পাওয়া যাবে পাহাড়ি কলা সাথে বিস্কিট পেয়েও গেলাম, পনের মিনিটের বিশ্রাম সাথে কলা ব্রেক।

চিত্রগ্রাহকরা পুরো আদিপথধরেই মনের মত করে ছবি তুলছিল এখানেও চলল আদিবাসি ছোট ছেলে-মেয়েদের বিষয় একটু আলাদা কিছু, দেখা হল আদা বয়ে নিয়ে যাওয়া কৃষকদের একটা দল যাদের দেহের পরিবহন শক্তির দ্বারা দূর গ্রাম থেকে বাজারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া। দোকানের মালিকের সাথে কথা হল দুভাষীর মাধ্যমে জানা গেল পাহাড়ে তাদের জীবন ধারন, পরিবর্তন, সমস্যা সম্পর্কে যার ছোঁয়া আমরা সামনের পথে পথে দেখব বলে জানালেন। পথের পানে আবার ছুটে চলেছি ছোট ছোট ঘনজঙ্গল, ক্যানেলের পানি পেরিয়ে সামনেই দেখা পেলাম সামিউল-মাহিনদের দলকে কথা হল সবার সাথে তারপর ওদের পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে দেখা পেলাম তিন পাথরের ধাপে সৃষ্ট এক ছোট ঝরনার। চারিদিকে সবুজের সমারোহ নিশ্চুপ শান্ত পরিবেশ বর্ষায় তাই পানির উৎস অফুরন্ত কামরুলকে তাই সারা পথ ভিজতে দেখলাম রুমা ক্যানেলে। রুমা ক্যানেলের পানি যাত্রা পথে আমাদের তৃষ্ণা মিটাবার প্রধান উৎস ছিল যার স্বাদ এককথায় অমিয়, চলার পথে রুমা ক্যানেলের পানির কলকল ধ্বনি সারাক্ষণ আমাদের কানে বাজতে লাগল।

এভাবে চলতে চলতে আমরা পৌঁছে গেলাম বগামুখপাড়া, ছোট আদিবাসি গ্রাম যার মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে রুমা ক্যানেল। আদিবাসি মানুষ গুলো কাজে-কর্মে মশগুল ছোট ছেলেটা মাছ ধরছে বড় এক পাথরে বসে, স্লান করছে বউ-ঝি, বাকিরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত। পার্বত্য বান্দরবন ও রাঙ্গামাটি জেলার সংযোগস্থল যার চারপাশে সবুজ অরণ্য ঘেরা পাহাড়ের মাঝে বগামুখপাড়ার অবস্থান। চিত্রগ্রাহকদের কাজ শেষে বগামুখপাড়া থেকে আমরা বিদায় নিলাম, পাহাড় থেকে নেমে সামনেই ঝিরিপথ দুদিকে চলে গেছে আমরা ডান দিকের পতংঝিরি ধরে এগিয়ে চললাম বালি পাথর, পানি, জঙ্গল পেরিয়ে আমরা ক্রমশ বড় পাথরের দিকে চলে এলাম। পাহাড় এখানে সঙ্কুচিত আঁকাবাঁকা উপর-নীচ পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ পেরিয়ে দেখি কাঁটা পাথর যার বুকে কাঁটা এক গুপ্ত পথ যার ভেতর দিয়ে আমি ও আনিস বাকিরা নীচ দিয়ে চলল সামনেই আরেকটা যাত্রা বিরতি সাথে আনা শুখনো খাবার ও অমৃত পানি দিয়ে চলল আমাদের ভোজন।

ঘড়িরকাঁটায় তখন বারটা তাই দ্রুত আমরা হেঁটে চললাম এভাবে আধঘণ্টা হাঁটার পর গাইড জানালো আমরা চলে এসেছি পতং বা নাসাং ঝরনায়। সামনে দেখলাম দুজন আদিবাসি যুবক মাছ ধরছে ইলেকট্রিক বরশি দিয়ে বড় এক পাথরের উপর বসে তার সামনেই পতংঝিরি পানি পরছে অবিরত কিন্তু ঝরনা দেখতে পেলাম না তাই সামনে এগিয়ে গেলাম হুমায়ুনকে সাথে নিয়ে হঠাৎ বা পাশে পানির গর্জন, অসম্ভব সুন্দর এক ঝরনা লুকিয়ে রয়েছে পাথরের গভীরে। পানির প্রবাহ স্ক্রু এর মত তাইত নোমান এর নাম দিল স্ক্রু ঝরনা, সামনেই বৃহৎ জলাধার কোন ভয় নেই বলে জানাল ধ্রু বম অমনি হুমায়ুন নেই চেয়ে দেখি লাফ দিয়েছে আমার আগে তারপর আনিস, নোমান, স্বাক্ষর সবাই গোসল করছি আমরা পতংঝরনায়। পানির প্রবাহ ও স্রোত অত্যাধিক তাইত পতংঝরনা ছোঁয়ার জন্য কাছে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারলাম না, একবার মাছের ঝাককে জোক ভেবে ভয়ই পেলাম। দুরন্তপনা শেষ হল ঘণ্টাখানেক পরে তাইত ছুটে চলতে হল আবার পতংঝরনার পাশে বয়ে চলা পতংঝিরির ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলের উপর দিয়ে উচু সমান পিচ্ছিল পানি পাথরের বুক চিরে।

পতংঝিরির উপরে উঠার সময় ফয়সাল বলল অসম্ভব কামরুলও মনে মনে সায় দিল যা তার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হল কিন্তু সামনে এগিয়ে যেতে হবে তাই ব্যাগ থেকে রশি দিলাম ফয়সালের জন্য কিন্তু হামাগুরি দিয়ে চলে এল কামরুল, ফয়সাল আনিসের সহযোগিতায় বাকিরা আগেই ধ্রু বমের সাথে উপরে চলে এসেছে। বগালেক যাবার শেষ পাহাড়ের শুরু এখান থেকেই ডানদিকের পিচ্ছিল খাঁড়াসরু আঁকাবাঁকা ঝোপঝাড়ের পথ বেয়ে আমরা চলেছি আলো-অন্ধকারের মাঝ দিয়ে পথে আলো রয়েছে কিন্তু আলোদাতাকে দেখা এখানে সম্ভব নয়, এভাবে অনেকদূর এগুবার পর দেখা পেলাম আলোদাতার মনে হল কোন এক ঝোপ থেকে বেরিয়ে সবুজ আলোর মাঝে চলে এসেছি। পতংঝরনায় অতিরিক্ত লাফালাফির কারনে আমাদের কিছুটা শারীরিক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যা কামরুলের মোটা দৈহিক গঠনকে বেশী আক্রান্ত করেছে, তাইত ওকে মাঝে মধ্যেই রশি দিয়ে টেনে তুলতে হল। আমরা সবাই পরিশ্রান্ত তাইত পাহাড়ের উপরে এসে বাতাসের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ, পথের বাকি এক পাহাড় এখন শুধু নিচে নামতে হবে তাইত পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরা চলেছি বগালেকের খোঁজে। পাহাড় পেরিয়ে স্বাক্ষর পৌঁছে গেল তারপর আমরা শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম বগালেক, চারিদিকে সবুজ পাহাড়ে বেষ্টিত মাঝে অথৈ পানির সমাহার এরই নাম বগালেক।

বগালেকের উত্তরপারে বগালেকপাড়া যেখানে বম আদিবাসিদের অতিথি ঘরে আমাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ধ্রু বম ঘরের মালিক নিথং বম ও দিদির সাথে আমাদের পরিচয় করে দিল। আমাদের অতিথি ঘরটি বগালেকের ঘাটপারে যার ডানপাশেই ক্যাথলিক গির্জা এছাড়া অন্য কোন ঘর বগালেকের ঘাটপারে নেই, মাটি থেকে চারফুট উচুতে মাচাং দিয়ে তৈরি যার অভ্যন্তরে দুটি কামরা সাথে পাঁচটি বড় বিছানা যেখানে পনের থেকে বিশ জনের আয়েশে রাত কেটে যাবে। সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত দেহে আমরা নেমে পরলাম বগালেকের অথৈ পানিতে, স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে হুমায়ূন লাফ দিল ভাগ্য সুপ্রস্ন্য, না হলে নিচে লুকিয়ে থাকা বড় বড় কয়েক্টা পাথরের খন্ড রয়েছে যার সাথে সহজেই ধাক্কা খেয়ে অক্কা পাওয়া সম্ভব, সকলেই গোসল করছি কিন্তু বুঝতে পারলাম না পানি এত স্বচ্ছ কিভাবে হল ডুব দিয়ে নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পারছি। আমরা আধঘণ্টা ডুবিয়ে চলে এলাম পেটের ক্ষুধা মিটাতে, দিদি আমাদের জন্য দুপুরে খাবারের তালিকায় ভাত,আলু ভর্তা, ডিম ভাজি সাথে ডাল রেঁধেছেন খেলাম পেটপুরে কে জানে বাঙ্গালি খাবার যদি আর না পাই, দুপুরের খাবার শেষে মাচাং ঘরে সবাই যার যার জিনিসপত্র রেখে সামনেই মাচা দিয়ে তৈরি বারান্দায় বসে রইলাম। সারাদিনের ক্লান্তদেহ যেন ঘুমে আচ্ছন্ন তাইত কিছুক্ষণ পরে মাসুমের নেতৃতে নোমান, ফয়সাল ও কামরুল হাতিপোকার কামড়ের ভয়ে মশারির ভেতর একক্লান্ত নিদ্রায় শুয়ে পরল।

আমরা বেরিয়ে পরলাম পড়ন্ত বিকালে বগালেকের অপরুপ রুপের খোঁজে পাড়ার সামনের রাস্তা ধরে আর্মি ক্যাম্প তারপর হেলিপ্যাড আবার ক্যাম্প, কথা হল সেনাসদস্যদের সাথে কথার যেন শেষ নেই বাঙ্গালি পেলেই হল এরই মাঝে ধ্রু বম সাথে তার বন্ধুরা মিলে চলে এসেছে ক্যাম্পের মাঠে ভলিবল খেলতে আমাদের আনিস ভাল ভলিবল খেলে তাই আমরাও তাদের সাথে নেমে পরলাম, পাহাড়ে এসে খেলাধুলা করে বেশ ভাল সময় পার করলাম। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে সন্ধ্যা হয়েছে তাই ফিরে চলেছি, পথে দেখা হল কয়েকজন পাহারিদের সাথে যারা বগালেক থেকে হরেক রকম মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, দেখা হয়ে গেল সামিউল-মাহিনদের সাথে ওরা ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে উঠেছে সিয়াম দিদির অতিথি ঘরে ক্লান্ত শরীর তাই দেখা হবে বলে ফিরে এলাম ঘরে। সন্ধ্যা হয়েছে ওরা চারজন এখনো ঘুমে বিভর তাই জাগিয়ে দিলাম, পেটে ক্ষুধা অনুভূত হচ্ছে সবার তাই একসাথে বের হয়ে ধ্রু বমকে নিয়ে চলে এলাম তার মাশ্তুত ভাইয়ের দোকানে এদিকে স্বাক্ষর সামিউল-মাহিনদের নিয়ে এল, মুড়ি-চানাচুর সাথে ছোট পাহাড়ি ঝাল কাঁচামরিচ মাখিয়ে খেলাম তারপর এক কাপ গাড় রং চা, খাওয়া শেষে পা দুটোর সহায়তায় চলে এলাম বগালেকের ঘাটে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়েছে আমাদের আড্ডা চলছে বগালেকের ঘাটপাড়ে, আকাশের সাদা রংয়ের চাঁদ যেন তার মায়াবি আলোয় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নোমান, স্বাক্ষর এই সময়টুকু ধরে রাখছে তাদের ক্যামেরার সাহায্যে সেই সাথে আমাদেরকেও, মায়াবি এই নির্জন পাহাড়ি পরিবেশে বগালেকের চারিদিকে জোস্নার আলোয় আলোকিত লেকের পানি ঝিলিমিলি অপরূপ সাজে ঢেউ খেলছে।

সময়টুকু ভালই কাটছিল তবে রাতের খাবারের সময় পার হয়ে যাচ্ছে ধ্রু বম কয়েকবার ডেকে গেছে তাই দেরি না করে সবাই গিয়ে খেয়ে নিলাম দিদির হাতের বাঙ্গালি রান্না। পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে আমরা আবার ফিরে এলাম ঘাটপাড়ে গল্পে মশগুল সবাই আগামীকালের কেওক্রাডং অভিযান নিয়ে এরই মাঝে কামরুলের পেটে বড় ঘরের ডাক পরেছে টয়লেট চিনি না কেউ, ধ্রু বমও আমাদের সাথে নেই উপায় একটাই জঙ্গল, তাই একটা লাইট নিয়ে ভো-দৌরে চলে গেল চার্চ পেরিয়ে ফিরে এল অনেকক্ষণ পরে ওকে দেখে অট্ট হাসিতে ফেটে পরল সবাই। রাত গভীর তাই আড্ডাটাকে শেষ করে মাচাং ঘরে ফিরে এলাম মশারি লাগানো হচ্ছে কাল ভোরে উঠতে হবে শরীর ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে পরলাম। দু’শরা শ্রাবণ ভোর হয়েছে তারপরও রাতের আঁধার কাটেনি ঘুমে বিভোর সবাই এরই মাঝে সাক্ষরকে সাথে নিয়ে জাগিয়ে দিচ্ছি সবাইকে কিন্তু ঘুম যেন ক্লান্ত শরীরকে আচ্ছন্য করে রেখেছে তাইত উঠতে দেরি হচ্ছে, সবাই উঠেছে এরপর সকালের অতি জরুরি কাজ শেষ করতেই দেরি হয়ে গেল। আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে রয়েছি কেওক্রাডংকে দেখার জন্য তাইত সময় হয়েছে আবার একসাথে বেরিয়ে পরার, ধ্রু বম জানালো দিদি আমাদের জন্য ভোরে উঠে রান্না করেছেন সুতরাং না খেয়ে যাওয়া যাবে না অগত্যা কিছুই করার নেই, এদিকে সামিউল-মাহিনরা আমাদের রেখে রওনা দিল সেনাবাহিনির টহল দলের সাথে সামনেই দেখা হবে বলে বিদায় দিলাম।

ঘড়ির কাঁটায় সাত’টা বেজে গেছে আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা হলাম সবাই, ধ্রু বম পথ সম্পর্কে কিছুটা ধারনা দিল আমাদের তারপর থেকে পেছনে গাইড সামনে আমরা, এগিয়ে যাচ্ছি বগালেকের উত্তর দিক দিয়ে পাহাড়ি ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দুপায়ো পথ বেয়ে। আমাদের আজ আনুমানিক দু’হাজার ফুট উপরে উঠতে হবে, যার শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে তাই এখন শুধু লক্ষে পৌছার পালা। বগালেকের উত্তরের সবচেয়ে উচু পাহাড়ের উপর থেকে লেকটিকে সত্যি অসম্ভব সুন্দর লাগছে যা না দেখলে অনুভব করা যাবে না, পাহাড়ের ঢালে চলার পথের দু-ধার প্রকৃতি তার আপন হাতে তৈরি করেছে যার মাঝ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। আমরা প্রায় একঘন্টা পথ হেঁটে এসেছি, ঘন জঙ্গল পাহাড়ি লাল মাটি পেরিয়ে সামনেই চিংড়ি ঝরনা জানালো ধ্রু বম পাহাড়ের উপর থেকে দেখে নিলাম একঝলক ফেরার পথে যাব বলে ঠিক করলাম, সামনেই নিচে বাম দিকে পাথরের পথ যার ভেতর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে অবিরাম সেই পথের শেষেই চিংড়ি ঝরনা। আঁকাবাঁকা সরু পাহাড়ি ঢাল একবার উপরে উঠলে সামনেই নেমে যেতে হচ্ছে যার ফলে শারীরিক ভাবে কিছুটা ক্লান্তি অনুভব হচ্ছে কিন্তু মনের দিক থেকে কিছুই যেন বুঝতে পারছি না শুধু মনে হচ্ছে আমরা চলে এসেছি প্রকৃতির মাঝে যেখানে ক্লান্তি বলে কিছু নেই আছে শুধু অফুরন্ত মুগ্ধতা।

পথে দেখা পেলাম কয়েকটা ভাঙ্গা কাল্ভারট যার কিছুই অবশেষ নেই আছে শুধু পাহাড়ি খন্দকের মাঝে দুটো বাঁশের তৈরি সাঁকো পরে গেলে ওখানেই কবর হয়ে যাবে। আমরা দ্রুত হেঁটে চলেছি সামনেই লাল মাটির পাহাড়ি সমান্তরাল পথ যার উপরে একটা বিশ্রামাগার দেখা পেয়ে গেলাম সামিউল-মাহিনদের দলকে যারা আমাদের চেয়ে ঘণ্টাখানেক আগে রওনা করেছিল। বিশ্রামাগারে পাঁচ মিনিটের বিরতি নিলাম, চিত্রগ্রাহকগন পথের এইখানে দাঁড়িয়ে পূর্বের সীমান্ত পাহাড়মালা যার একপ্রান্তে ডুম-লং অন্যপ্রান্তে মদক মোয়াল যার মাঝখানে তিনমুখ সীমান্ত, যেন লেন্সের ভেতর দিয়ে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিল। হুমায়ূনকে জোঁক ধরেছে লাল রক্ত ঝরছে কিন্তু জোঁকের দেখা নেই দেখা পেলাম আমার পায়ে সাথে সাথে ওঝা দিয়ে দিল একচিমটে লবন অমনি পলায়ন। আমরা দার্জিলিং পাড়া থেকে খুব বেশি দূরে নেই তাই দ্রুত পথের বাঁকে হারিয়ে গেলাম, পথ যেন দ্রুত ধরা দিচ্ছে আমাদের কাছে সেই সাথে প্রকৃতি পাহাড়ের দুপাশে সারি সারি গাছ মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে উপরে উঠেই পৌঁছে গেলাম বাংলার দার্জিলিং।

পাহাড়ের উপরে সমতল ভূমিতে দার্জিলিং পাড়ার অবস্থান যার চারিদিকে দৈত্যকার দানবদের হাতছানি এরই মাঝে আমরা বিশ মিনিটের যাত্রা বিরতি নিলাম। দার্জিলিং পাড়া স্বপ্নের মত আমাদের কাছে ধরা দিল তাই চিত্রগ্রাহকদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম একে জানার জন্য সামনেই দার্জিলিং পাড়ার বিখ্যাত চা’য়ের দোকান সুতরাং চা সাথে অন্যকিছু না হলে কি হয়, দেখা পেলাম আমাদের আগে রওনা করা সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে কিছুক্ষন পরেই সামিউল-মাহিন্রাও চলে এল। দার্জিলিং পাড়াটি আয়তনে বেশ বড় চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো আবাস্থল তবে বেশ গুছানো ও পরিচ্ছন্ন প্রবেশের মুখে ইন্ডিপেনডেন্ট ব্যাপটিস্ট চার্চ শেষে দার্জিলিং পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঝে ঘর-বাড়ি সামনেই উঠান যেখান থেকে আমরা প্রথমবারের মত দেখা পেলাম কেওক্রাডং চূড়া। চারিদিকে কেমন যেন উৎসবের আমেজ ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে তরুণীরা নতুন পোশাকে ঘোরাফেরা করছে মানুষজন ব্যস্ত লোকজনও কেমন যেন বেশি মনে হচ্ছে, ধ্রু বম জানাল আজ রোববার উপাসনার দিন তাইতো দূর-দূরান্তের ধর্মীয় মানুষজন সাজসজ্জা করে চলে এসেছে, এদিকে ধ্রু বম নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে সাপ্তাহিক উপাসনায় যোগ দিতে না পারায় তাই সবাইকে দ্রুত সকল কাজ শেষ করিয়ে রওনা হলাম আমাদের পথে ওই দৃপ্তমান কেওক্রাডং চূড়ার উদ্দেশ্যে। দার্জিলিং পাড়া থেকে সোজা পাহাড়ি পথ ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি সামনেই দুটো উঁচুনিচু পাহাড়ি বাঁক যার পথ ধরে দ্রুত ছুটে চলেছি , সামনেই উচু এক পাহাড় যার উপর থেকে পেছনে তাকিয়ে দেখি দার্জিলিং পাড়া সগৌরবে দাড়িয়ে রয়েছে যেখানে কিছুক্ষণ আগেও আমাদের পদচারনা ছিল।

আমাদের দলের কয়েকজন পেছনে পরে গিয়েছে সামনে আনিস দূরে পেছনে মাসুম এমনই সময় হঠাৎ সামনের পাহাড় চূড়ায় দেখা পেলাম স্বপ্নে ভেসে আসা এক পাহাড় দানব কেওক্রাডং। আমরা পৌঁছে গিয়েছি কেওক্রাডং কিন্তু চূড়ায় যেতে এখনো কয়েকশ ফুট উপরে উঠতে হবে তাইত দু’মিনিট দাড়িয়ে চারিদিকের স্তব্দতা পেরিয়ে দেখি আনিস ও সাক্ষর চলে গিয়েছে সাথে মাহিন, তাই দেরি না করে ফয়সালকে সাথে নিয়ে আবার ছুটে চললাম। ঘড়ির কাঁটায় দশ ছুঁই ছুঁই জুম ক্ষেতের সবুজ পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তখন আমরা কেওক্রাডং চূড়া পৌঁছে গিয়েছি ততক্ষণে লেট’স ট্র্যাভেলের পক্ষ থেকে আনিস সর্বপ্রথম কেওক্রাডং চূড়া জয় করেছে। কেওক্রাডং চূড়ায় আমরা ক’জন পৌঁছে গিয়েছি কিন্তু বাকিরা এখনও পৌঁছায়নি, বিশ্রামাগারে অপেক্ষারত কিন্তু বাকিদের দেখা নেই তাই উঠে পড়লাম বিশ্রামাগারের ছাঁদে কিছুক্ষনের মাঝেই একে একে সবাই চলে এলো। ধ্রু বম মাসুমকে সাথে নিয়ে সর্বশেষে এসেছে তারপর থেকেই হইচই এক হজবরল আনন্দঘন পরিবেশ চূড়ার উপর, কিছুক্ষন পরেই সব শান্ত সবাই ব্যস্ত হয়ে পরেছে কেওক্রাডং পাহাড় চূড়ার পরিবেশটাকে নিজের মত করে উপভোগ করার জন্য।

পাহাড় দানব কেওক্রাডংয়ের বিশ্রামাগারের ছাঁদের উপর থেকে চারদিকের পরিবেশ যেন মায়াবী এক রুপ ধারন করেছে তাইত কামরুল ও মাসুম তাদের ওই ভারী দেহ নিয়ে উপরে উঠার ব্যর্থ চেষ্টা শেষে আমাদের সহযোগিতায় উপরে উঠে এল। আমরা আজ দাড়িয়ে রয়েছি কেওক্রাডং পাহাড় চুড়ায় যেখানে শ্রাবণের এই মেঘ-রৌদ্রের দিনে উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে চলে এসেছি তিন হাজার একশত বাহাত্তর ফুট ভাবতেই শরীরে কেমন যেন শিহরনের সৃষ্টি হচ্ছে। কেওক্রাডং চূড়ার চারিদিকের পরিবেশের কেমন যেন পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে হঠাৎ স্তব্দতা ভেঙ্গে বাতাসের মোহমুহ গর্জন, মাথার উপর রৌদ্রতাপ কোথায় যেন হারিয়ে গেল তারপর সবাইকে অবাক করে দক্ষিনি-পশ্চিমি হাওয়ার সাথে ভেসে আসতে লাগল মেঘ, সারাদিনের রৌদ্রতাপের শেষে যেন তার বিন্দু বিন্দু জলে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোন জাগতিক গ্রহে। কেওক্রাডং রেঞ্জের চারপাশে যতদূর দৃষ্টিসীমা রয়েছে ততক্ষণে সবটুকু মেঘের রাজত্বে চলে এসেছে, আকাশে বাতাসে আজ শুধুই মেঘ মেঘ আর মেঘ অন্য কিছুর দেখা মিলা ভার। পাহাড়ে আজ মেঘের মেলা বসেছে তাই সেই মেলার দোলে জুম ক্ষেতের সবুজ অরণ্যে মেঘ আশ্রয় নিয়েছে, কেওক্রাডং রেঞ্জ মেঘে ভেসেই চলেছে আর মদক রেঞ্জতো মেঘের দেয়াল রুপে জানান দিচ্ছে এখানেই বাংলাদেশর সীমান্ত।

লেট’স ট্র্যাভেলকে অসংখ্য ধন্যবাদ যার কল্যাণে আমরা আজ জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টুকু পার করছি সেই সাথে এবারের দলের সকল সদস্যকে যারা প্রতিনিয়ত মেঘের ভেলার মত ভেসে বেড়াচ্ছি বাংলার পথে প্রান্তরে। পাহাড় দানব কেওক্রাডং চূড়ায় ঘন্টা দু’য়েক সময় কিভাবে যে জীবন থেকে চলে গেল বুঝে উঠার আগেই।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।