বঙ্গ বন্ধু মানুষ চিনতে ভুল করেননি। ৫২ ভাষা আন্দোলনে যখন এক সাথে জেলে ছিলেন তখনই তার মনে হয়েছিল এই ছেলেকে দিয়ে অনেক কিছু হবে। তাইতো দেশের ক্রান্তি লগ্নে যখন আমেরিকার সাথে আলোচনা প্রয়োজন তখন আবার সেই ছেলেটির কাছেই গোপন খবর পাঠালেন লোক মারফত। যেন আমেরিকানরা পূর্বপাকিস্তান কে সার্পোট দেয়, তাহলেই দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন তিনি। যার কাছে দুত পাঠালেন তিনি আর কেউ নন আমাদের সবার শ্রদ্ধার পাত্র অল লাইফ ফাস্ট বয় শাহ এএমএস কিবরিয়া।
এই প্রেক্ষাপটে সম্ভবত এই প্রথম কোনো মার্কিন দলিল থেকে জানা গেল, একাত্তরের ৩ মার্চেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার চিন্তা এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস খোলার পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছিল।
মার্কিন কূটনীতিক ক্রেইগ ব্যাক্সটারের কাছে আওয়ামী লীগের পক্ষে এই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি পলিটিক্যাল কাউন্সিলর এবং পরে অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। ব্যাক্সটার পরে দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত হন। ব্যাক্সটার একাত্তরে পররাষ্ট্র দপ্তরে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন।
গোপনীয় তারবার্তা।
প্রাপক মার্কিন দূতাবাস, ইসলামাবাদ, মার্কিন কনসাল ঢাকা। বিষয়: স্বাধীনতা বিষয়ে বাঙালি পাক কর্মকর্তা। তারবার্তা প্রস্তুতকারী ব্যাক্সটার। নং স্টেট ০৩৬২৫৫। ৩,৪ ৪ প্যারা নি¤েœ দেওয়া হল।
৩. রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে ইয়াহিয়ার উদ্যোগকে কিবরিয়া যথেষ্ট বিলম্বিত বলে উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন যে বাঙালিরা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, তারা আরও একটি সপ্তাহের অপেক্ষা বরদাশত করবে না। এমনকি শেখ মুজিবের ৭ মার্চে ভাষণের আগেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে জনগণ সম্ভবত চাপ সৃষ্টি করবে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা ৭ মার্চে পরে যাবে না।
কিবরিয়া আশঙ্কা করেন, মুজিব ইতস্তত করবেন এবং সে কারণে “বাম চরমপন্থীদের” কাছে তিনি তাঁর নেতৃত্ব হারাবেন। “বাম চরমপন্থীরা” জনতাকে নিজেদের উদ্দেশ্যসাধনে কাজে লাগাবে।
কিবরিয়া আরও গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কথিতমতে ইতিমধ্যেই বাঙালি পুলিশকে নিরস্ত্র করেছে এবং ইতিমধ্যে কতিপয় দমনমূলক পদক্ষেপ (আজকের সংবাদপত্র দ্রষ্টব্য) নিয়েছে। তিনি অনুমান করেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী “আমার দেশবাসীর প্রতি কসাইগিরি” চালাতে পারবে বটে। তবে তাতে বড়জোর কার্যকর স্বাধীনতা অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে, কিন্তু তাকে স্তব্ধ করা যাবে না। বরং ‘বর্বরোচিত’ কাণ্ড ঘটালে তা বাঙালি প্রতিরোধকে আরও কঠিন করে তুলবে। তিনি পৌনঃপুনিকভাবে গুরুত্বারোপ করেন যে [স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে] এখন আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়।
তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অন্যরাও সহমত পোষণ করেন।
৪. কিবরিয়া জানতে চান, বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবস্থান কী হবে? তিনি এটা বুঝতে পারছেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের পরে [মার্কিন] পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু তাঁর উদ্বেগটা হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং [যুক্তরাষ্ট্র সরকারের] স্বীকৃতি প্রদান (ওপরে যেভাবে উল্লিখিত) বিলম্বিত হতে পারে, তার অন্তর্বরতীকালে পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা কী দাঁড়াবে। ব্যাক্সটার ইঙ্গিত দেন যে আমরা স্বাভাবিকভাবেই এখানে এবং ঢাকার মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখব। কিন্তু এখানে কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ রক্ষা করা সমীচীন হবে না।
কিবরিয়া যুক্তিটি গ্রহণ করলেন। তবে ভবিষ্যতে তাঁরা যে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করতে পারেন, সেই সম্ভাবনা কিবরিয়া নাকচ করেননি। তিনি একই সঙ্গে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এবং জানতে চান যে চরম প্রয়োজনে পররাষ্ট্র দপ্তরের চ্যানেল ব্যবহার করা যাবে কি না। ব্যাক্সটার সরাসরি এর উত্তর এড়িয়ে বলেছেন, এটা অনিয়মিত, তবে যখন অনুরোধ করা হবে, সেই সময় ও বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে তা বিবেচনা করা হবে।
৫. কিবরিয়া কিছু প্রশাসনিক বিষয় নিয়েও কথা বলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পশ্চিম পাকিস্তান তা চ্যালেঞ্জ করবে। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা বিশ্বাস করেন, সেই পরিস্থিতিতে [ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের] রাষ্ট্রদূত হিলালি তখন পাকিস্তান দূতাবাস থেকে বাঙালি কূটনীতিকদের বহিষ্কারের নির্দেশনা পাবেন এবং তা অনুসরণ করবেন। তিনি তাঁদের বেতন-ভাতাও বন্ধ করে দেবেন। কিবরিয়া এ বিষয়ে কোনো সহায়তা চাননি।
কিন্তু বলেছেন, দূতাবাসের মধ্যে বাঙালিরা তখন একটা “পুলিশ পরিস্থিতি” সৃষ্টি করতে পারে। ব্যাক্সটার ইঙ্গিত দেন যে সেটা হবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এবং তা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে একটা জটিল অবস্থার মুখে ফেলে দেবে। কিবরিয়া এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং বলেছেন, তিনি তাঁর সহকর্মীদের এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেবেন। (দৈনিক প্রথম আলো, ২৬.০৩.২০১৩)
জনাব কিবরিয়া ২০০৬ সালে ইউপিএল প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘মার্চ মাসের গোড়া থেকেই আমি ও আমার সহকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন বাংলাদেশের দূতাবাস খোলা সম্পর্কে বিভিন্ন পরিকল্পনা করেছিলাম। ’
আমাদের দেশে অনেকেই আছেন যারা সরকারের উচ্চপদে রয়েছেন ।
যখন বঙ্গবন্ধু দেশের স¦াধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তার পরও তারা পাকিস্তানীদের অধীনে চাকুরি করেছেন থেকেছেন স্বীয় পদে। লোভে পড়ে চাকুরি ছাড়েনি, অথবা ভেবেছেন দেশ স্বাধীন হবে না, আজ তারা রাজ পথ দাপিয়ে পতাকা উড়িয়ের চলেন । অথচ কিবরিয়া নিজের চাকুরির পরওয়া করেননি। আমেরিকানদের বলেননি আমাদের চাকুরি গেলে কি হবে। শুধূ বলেছেন দেশের কথা ও দশের কথা, এখানেই অন্য দশজন কুটনৈতিক বা সরকারি কর্মকর্তাদের থেকে তিনি আলাদা।
আর তাইতো বঙ্গবন্ধু থাকেই ভরসা করে পাঠিয়ে ছিলেন সেই গোপন চিঠি যা তিনি তুলে ধরছেন আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।