এখানে বিনামূল্যে বিশ্ব-বিখ্যাত মাইন্ড বৈজ্ঞানিক দ্বারা মাইন্ড রিলেটেড এনি প্রবলেম অতি যত্ন সহকারে সলভ করা হয় ।
শোনা যায় যান্ত্রিক সভ্যতা যত এগোয় সভ্য মানুষ তত কৃত্রিম হতে থাকে। তার মুখে এঁটে বসে যায় এক মুখোশ শিষ্টতার, সৌজন্যের। পরে অনেক চেষ্টা করলেও তার সত্যিকারের মুখশ্রী আর দেখা যায় না, সে নিজেও এমনকি দেখতে পায় না। বলা হয় গাঁয়ের মানুষ নাকি অন্যরকম।
সভ্যতার কৃত্রিমতার আঁচ যদিও তাদের গায়ে লাগছে একটু আধটু, তবু তারা সরল প্রাণবন্ত আতিথ্যপ্রবণ।
এ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা মিশ্র ও ভিন্নতর। অন্তত শতকরা আশীভাগ গ্রামবাসীর মনের কথা টের পাওয়া যে খুব কঠিন তা আমি বলতে পারি। তাঁদের মুখের মুখোশ নেই কিন্তু আছে এক কাঠিন্যের আবরণ। আপাত সারল্যের অন্তরালে সেই কঠিনতা প্রায় দুষ্প্রবেশ্য।
তবে একবার সেই শক্ত খোলা ভাঙতে পারলে ভেতরে নারকোলের মতোই বড় স্নিগ্ধ শাঁসজল। কয়েক শতাব্দীর তিক্ত লেনদেন, ব্যর্থ আশ্বাস আর নির্লজ্জ শোষণ গাঁয়ের মানুষকে শহুরে বাবুদের সম্পর্কে ক’রে তুলেছে সন্দিহান। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁদের দেখা-জানা আর শহরের মানুষের বইপড়া-তত্ত্বে এত ফাঁক তাঁরা দেখতে পান যে আমাদের জন্যে তাঁরা সবসময়ে রেখে দেন এক অন্তর্লীন করুণাবোধ। তাঁদের মূঢ় ম্লান মূক মুখে ঢাকা আছে এক দারুণ কৌতুক, যার বিনিময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে করেন অবসর সময়ে। তাঁদের এই কৌতুক আর করুণা প্রকাশ পায় বাক্যে।
‘বাবুর কি আমাদের মোটাচালে পেট ভরবে?’ ‘এ গেরামে কী আর দেখবেন? গরমকালে ধুলো আর বর্ষাকালে কাদা’- কিংবা ‘বাবু হঠাৎ টেপ রেকর্ডার যন্তর নিয়ে অ্যালেন যে? আমাদের গেঁয়ো গানে কি আপনাদের মন ভরবে?’ অথবা ‘আপনারা এদিকে ঘন ঘন এলে আমাদের ভয় লাগে, হয়তো ভোট বা অন্য কোন তালে আসছেন কে জানে?’ এসব বাক্যবন্ধে খুব কায়দা ক’রে মেশানো আছে চাপা কৌতুক আর নীরব অট্টহাসি।
লোকসংস্কৃতি বিষয়ে যাঁর সরেজমিন ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে তিনিই বুঝবেন আমার ধারণার মূল কথা। একটা দারুণ প্রতিরোধ আর অবিশ্বাস তাঁদের পার হতে হয়েছে। সেখানে, অভ্যর্থনা জোটে, আহার বাসস্থানও। কিন্তু সন্দেহ থাকে সদাউদ্যত।
একটা ভয়। এই বুঝি কিছু বেরিয়ে গেল তাঁদের। ‘জানেন আমাদের গাঁয়ের কুবির গোঁসাইয়ের গান টুকে নিয়ে ষষ্ঠী ডাক্তার রেডিওতে দিয়েছিল, কত টাকা পেয়েছে!’ ছেঁউরিয়ার লালন ফকিরের মাজারে আমাকে একজন বলেছিলেন, ‘জানেন, আপনাদের রবি ঠাকুর আমাদের লালন শায়ের গান টুকে নোবেল প্রাইজ নাকি যেন একটা পেয়েলো। সে নাকি শতাবধি টাকা। ’
এ যদি হয় সাধারণ মানুষের বক্তব্য আর ধারণা তবে অসাধারণদের অব্যক্ত বিশ্বাস আর নাই বা বললাম।
কিন্তু আমার কাজটা ছিল আরো কঠিন জায়গায়। উদাসীন-ফকির-বাউলদের সঙ্গে। সময়টা পুরো ষাটের দশক। নদীয়া বর্ধমান মুর্শিদাবাদ এ বাংলায়, মেহেরপুর কুষ্টিয়া ও বাংলায়। অনেক অগণন গ্রাম।
তার মধ্যে আত্মগোপণ ক’রে থাকা কত উপধর্ম। এইচ.এইচ উইলসন যাঁদের একশো বছর আগে বলেন ‘মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টস্’, অক্ষয়কুমার দত্ত যাদের বলেন ‘উপাসক সম্প্রদায়’। একশো বছর আগে লেখা তাঁদের বিবরণ পড়ে জানতে ইচ্ছে হয় এখন কী অবস্থায় আছে এ সব সম্প্রদায় বা উপধর্ম? শুরুতে আমার সম্বল বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুঁথিপড়া ডিগ্রি আর জানবার আগ্রহ। কিন্তু ভাষা যে জানি না! সত্যিই তাই। লোকধর্মের ভাষা বুঝতে আমার লেগেছে ঝাড়া পাঁচটা বছর।
কেননা তাদের ভাষাটাই ‘সন্ধ্যা’ অর্থ্যাৎ বাইরের মানে আর ভেতরের মানে একেবারে আলাদা। প্রথমদিকের হোঁচট খাওয়ার কিছু নমুনা বলি।
১। একজন সাধককে আমার প্রশ্ন : আপনি বাউল?
উত্তর : আমি সংসার করি নাই।
প্রশ্ন : আপনি তো ফকির? আপনার ছেলেমেয়ে?
উত্তর : সন্তান? পাঁচহাজার।
আমার পাঁচ হাজার শিষ্যশাবক। তারাই সন্তান। জানেন না ফকিরী দণ্ড নিলে আর সন্তান হয় না।
শিষ্যসেবক নয়, শিষ্যশাবক! ফকিরী দণ্ড বস্তুটি কি? বাউল কি সংসার করে না?
২। একজন উদাসীনকে আমি জিজ্ঞেস করি : আজ কী খেলেন?
উত্তর : খাওয়া নয়, বলুন সেবা।
আজ সেবা হলো পঞ্চতত্ত্ব।
প্রশ্ন : পঞ্চতত্ত্ব মানে? সে তো চৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্বৈত…
উত্তর : আরে না না, পঞ্চতত্ত্ব মানে চাল ডাল আর তিন রকমের আনাজ।
৩। এক আখড়ায় খুব ফিসফিস ক’রে এক গুরুস্থানীয় উদাসীনকে জিজ্ঞেস করলাম : একটা গানে শুনলাম ‘ভগলিঙ্গে হলে সংযোগ/সেই তো সকল সেরা যোগ’ তার মানে? এখানে কি মৈথুনের কথা বলা হচ্ছে?
একগাল হেসে উদাসীন বললেন : মৈথুন? হ্যাঁ মৈথুনই তো! তবে কি জানেন এর মানে আলাদা। শুনুন তবে : ‘গুরুবাক্য লিঙ্গ হয় শিষ্যের যোনি কান।
’ এবার বুঝলেন?
বুঝলাম যে আগে ভুল বুঝেছিলাম।
এ তো গেল ভুল বোঝা। মুশকিল আসবে আরেকদিক থেকে। যদি প্রশ্ন করা যায়,আপনি কি বাউল সম্প্রদায়ের? উত্তর পাওয়া যাবে,তা বলতে পারেন। আবার যদি ঐ উদাসীনকে প্রশ্ন করি,আপনি ফকির? উত্তর হবে, হ্যাঁ,ফকিরও বটে।
এবারে অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করতে হয়,আমি যা-ই জিজ্ঞেস করি আপনি হ্যাঁ বলেন। আপনি সত্যিই কি বলুন তো? উত্তর মিলবে,আমি মানুষ। মানুষ ভজা।
এসব কথার স্পষ্ট মানে কি? আমরা কি সিদ্ধান্ত করব? আসলে এসব উদাসীনদের সাধনের মূলকথা গোপনতা। অসম্প্রদায়ীদের কাছে হয় কিছু বলেন না, কিংবা উল্টাপাল্টা বলে বিভ্রান্তি এনে দেন।
ওঁরা একে বলেন আপ্ত সাবধান। এর মূল বক্তব্য হল :আপন সাধন কথা/না কহিও যথা তথা/আপনারে আপনি তুমি হইও সাবধান।
আরেকরকম আছে ধন্দবাজি। সেবার যেমন ধাপাড়ার ইমানালি শাহজী ফকির তার খাতা খুলে বললেঃ লিখুন বাবু কারের খবর। অন্ধকার, ধন্ধকার, কুয়াকার, আকার, সাকার, ডিম্বাকার, নিরাকার, শূন্যাকার, হাহাকার, হুহুকার, নৈরাকার – এই হল একুনে এগারোকার আর চারকার গোপন।
আমি জানতে চাইলাম, এসবের মানে কি?
মুরুব্বির চালে মাথা নেড়ে শাহজী বললে,এসব নিগূঢ় তত্ত্ব। আপনি বুঝবেন না।
আসলে শাহজীও কিন্তু কিছু জানে না। কথাগুলো কোথা থেকে টুকে রেখেছে। শহুরে পন্ডিতমন্যরা যেমন ত্রুফো-গদার আওড়ায়।
এখন ভাবি, প্রথম যখন এইসব উপধর্মের সন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি তখন উল্টাপাল্টা সব দেখে শুনে চমকে যেতাম। সবচেয়ে বেকুব বনতে হতো গানের আসরে। হয়তো মচ্ছবের শেষে সারারাত চলল গানের আসর। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ বসে সে গান শুনছে মৌজ ক’রে,গায়ক গাইছে প্রাণ খুলে। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ তকমাধারী অথচ সে গানের বিন্দু-বিসর্গ বুঝছি না।
এসব গানকে বলে ‘শব্দ গান’। একজন প্রথমে গানে তত্ত্বকথা তোলে প্রশ্নের আকারে, আরেক গায়ক তার জবাব দেয় আরেক গানে। প্রথম গানকে বলে ‘দৈন্যতা’, জবাবী গানকে বলে ‘প্রবর্ত’। এ সব আমি ক্রমে ক্রমে শিখে নিই। পরে দেখেছি এসব নিগূঢ় ভাষার প্রয়োগ লাগসই করতে পারলে ফলও মেলে হাতেনাতে।
সেবার যেমন আমাদের মফঃস্বল শহরে পানের দোকানে এক গ্রান্য বাউল জনপ্রিয় সব রেকর্ডের গান গাইছিল। আমি ফস্ ক’রে বলে বসলাম, ওসব ফক্কিকারী রসের গান গেয়ে কি হবে সাঁই, একটা দৈন্যতার গান হোক। ’
ব্যস, কেল্লা ফতে! গায়কের চোখেমুখে আমার সম্পর্কে সে কী শ্রদ্ধার জানান! যেন দরদী পেয়েছে মরমীকে। বলেই বসল : আহা কী মান্যমান মহাশয়। শোনেন, ‘তবে আগে শান্তিপুরে চলোরে মন তবে গুপ্তিপাড়ায় যাবি।
’
আমি সেই ভিড়ের দিকে সগর্বে তাকালাম। ভাবখানা যেন, দেখলে আমার এলেম! কী না আমি জানি এ গানের মর্ম। এ গানে বলা হচ্ছে, দেহমনকে শান্ত করলে তবে গুপ্তিপাড়া অর্থাৎ গুপ্ততত্ত্ব জানা যাবে। এমনি ক’রে আমি জানতে পারি অমাবস্যা মানে নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনি। কুমীর মানে কাম।
লতা মানে সন্তান। চন্দ্র সাধন মানে মলমূত্র পান ইত্যাদি।
গোট পল্লীর আর্জান শানু ফকির বলেছিল : নিজের শরীরের বস্তু কি ঘেন্নার জিনিস? বস্তু রক্ষা আমাদের ধর্ম, শুক্ররক্ষা। অযথা শুক্রক্ষয় আর সন্তান জন্ম মানে আপ্তমরণ, নিজেকেই মারা। সন্তানজন্ম দেওয়া চলবে না।
তবে পতন কি নেই? আছে। যাদের কাম মরেনি তারা বারে বারে জন্মদ্বারে যায়। আমরা তাকে বলি ‘যোনিতে পতন’। তাই বলে নারী আমাদের ত্যক্ত নয়। নারীকে নিয়েই আমাদের সাধনা।
বিন্দু সাধন। যাকে বলে রসের ভিয়ান। দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে যেমন ক্ষীর তেমনই। আর ওথলায় না। কামকে তেমনই পাকে চড়িয়ে শান্ত করতে হবে।
আমাদের আপ্তজ্ঞানে বলে :
আপন জন্মের কথা জানরে ভাই
সকল ভেদ সেই তো জানে তার তুলনা নাই।
রজবীর্য রসের কারণ
এ দেহ হইল সৃজন
যারে ধ’রে সৃজন পালন তারে কোথা পাই?
সেই আসল মানুষ সাঁইকেই আমরা খুঁজি। বুঝলেন এবার?
লোকধর্ম আর লোকসংগীত নিয়ে গ্রামে গ্রামে প্রায় দশ বারো বছর একটানা ঘুরে বুঝেছি তার অনেকটা হেঁয়ালি, বেশ কিছুটা শহুরে অজ্ঞ লোককে বোকা বানানোর চটকদারী, কিন্তু ঠিক জায়গায় ঠিক মানুষটিকে ঘা দিতে পারলে বেরিয়ে আসে চাহিদার অতিরিক্ত রসদ। এজন্য শিখতে হয় তাদের সাংকেতিক ভাষা। জানতে হয় লোকধর্মে ‘দীক্ষা’ আর ‘শিক্ষা’ আলাদা জিনিস।
কাউকে তার নিজস্ব ধর্মমত বলাতে গেলে, ‘আপনি কি বাউল? আপনি কি ফকির?’- এ ভাবে জিজ্ঞেস না ক’রে বলতে হয় ‘আপনার কি সতীমার ঘর না দীনদয়ালের?’ বা ‘আপনি কি পাটুলী স্রোতের?’ সঙ্গে সঙ্গে উদাসীনের চোখে খেলে যাবে সুপরিচয়ের ঝলক। একবার এক বাউল আমাকে পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্ন করেছিল ‘মাটির কাজ বোঝ?’
আমি বলেছিলাম ‘হ্যাঁ, নালের কাজও বুঝি। ‘
আমার দ্বিতীয় কথাটিতে কাজ হলো খুব। তখন বাউল আরও অনেক কথা আমাকে জানিয়ে দিল।
লোকধর্মের গুপ্ত ঘরানা, তার মানে, আলাদা কতগুলো ‘বন্দিশ’ আছে।
তার কেতা সহবৎ না জানা থাকলে ওস্তাদ মুখ খুলবেন না। লোকধর্মের ‘আসলী চীজ’ সংগ্রহ করা কঠিন, আবার সময় বিশেষে খুব সহজ। আমার এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি তখন মারফতি ফকিরদের মূল রহস্যগুলো বুঝতে চেষ্টা করছিলাম।
সেবার শেওড়াতলার মেলায় প্রায় নিশিরাতে দুই ফকিরের তত্ত্ব আলোচনা শুনছিলাম।
অম্বুবাচীর ক্ষান্তবর্ষণ রাত। জাহান ফকির আর শুকুর আলী কথা বলছিলেন। আমি চুপ ক’রে শুনছিলাম। পরে দিনের আলো ফুটতে জাহান ফকিরের সঙ্গে আলাপ হলো। বাড়ি বর্ধমানের সাতগেছিয়ায়।
লেখাপড়ার হিসেবে প্রায় মূর্খ। একেবারে গরিব। পোশাক-আশাক আলখেল্লা তেমনই মলিন। কিছুতেই আমার কাছে মন খুলবে না। কেবল ধানাই-পানাই।
শেষকালে চটিয়ে দেওয়ার জন্য বলে বসলাম : আপনারা তো বেশরা। শরিয়ত একেবারে বাদ দিয়ে,ভুলে গেলে,তবে কি মারফতী কবুল হবে?
মুখ চোখ প্রথমে ব্যথায় ভরে উঠল, তারপর হঠাৎ সত্যের ঝিলিকের মতো আলো খেলে গেল মুখে। আস্তে আস্তে জাহান বললেন :আপনি পণ্ডিত লোক, এসব কী বলছেন? শরিয়ত ভুলে মারফৎ? আচ্ছা বাবু, আপনি তো প্রথমে বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ পড়েছেন, তারপরে তো দ্বিতীয় ভাগ? তাহলে কি আপনি প্রথম ভাগ ভুলে গেছেন?
বিদ্যুৎচ্চমকের মতো কথা এবং লেখাপড়া বিষয়ে মূর্খ লোকের মুখে। আমি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে রইলাম। চকিতে বুঝলাম শরিয়ত হলো means আর মারফত হলো end।
সাহস পেয়ে বললাম : আপনারা শাস্ত্র মানেন না বুঝলাম। জাতি মানেন না কেন? তার যুক্তি কী?
খুব ধীর কণ্ঠে গুণগুণ ক’রে জাহান গাইতে লাগলেন :
বামুন বলে ভিন্ন জাতি
সৃষ্টি কি করেন প্রকৃতি?
তবে কেন জাতির বজ্জাতি করো এখন ভাই। ।
বল্লাল সেন শয়তানী দাগায়
গোত্র জাত সৃষ্টি ক’রে যায়
বেদান্তে আছে কোথায় আমরা দেখি নাই। ।
বেশ ভালো লাগল। মন ভরে উঠল। জাহান যেন বেশ মেজাজ পেয়ে বলে যেতে লাগলেন আপনে মনে : শাস্তর মানুষ তৈরি করেছে। জাতও মানুষ তৈরি করেছে। হিন্দুদের মধ্যে বামুন-কায়েত, মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ-খোন্দকার এসব বড় রটালে কে? আমাদের দুদ্দুর গানে বলেঃ
অজ্ঞ মানুষে জাতি বানিয়ে
আজন্ম ঘুরিয়া মরে স্বজাতি খুঁজিয়ে।
।
শিয়াল কুকুর পশু যারা
এক জাতি এক গোত্র তারা
মানুষ শুধু জাতির ভারা মরে বইয়ে। ।
সেইজন্যই আমরা সত্যিকারের মানুষ খুঁজি। সে মানুষ বৈধিকে নেই, শরায় নেই, শালগ্রাম শিলায় নেই।
নোড়ায় নেই, মন্দিরে মসজিদে নেই। যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল।
আমি বললাম : তা হলে উচ্চবর্ণ বাতিল? শাস্ত্র কোরান খারিজ?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের কাছে বাতিল। আপনারা থাকুন আপনাদের জাতিত্ব নিয়ে, শাস্ত্র আউড়ে মৌলবী আর বামুনের বিধান মেনে।
আমরা জাতি মানিনে। আমরা বিশ্বাস করি সাধারণ মানুষের মধ্যে,দীন দরিদ্রের মধ্যে আছেন দীনবন্ধু। শুনুন এই গান :
ছোট বলে ত্যাজো কারে ভাই
হয়তো ওর রূপে এলেন ব্রজের কানাই
শূদ্র চাঁড়াল বাগদী বলার দিন
দিনে দিনে হয়ে যাবে ক্ষীণ
কালের খাতায় হইবে বিলীন দেখছি রে তাই। ।
এ গানের ভবিষ্যৎ বাণী আজকে প্রায় সত্য।
শূদ্র চাঁড়াল বলার দিন সত্যিই শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু এসব গানের মধ্যে যে প্রতিবাদ, যে রুখে দাঁড়ানো, তার মধ্যেও একটা জাতিত্বের নেশা আছে।
বেদ কোরাণ পুরাণ ব্রাহ্মণ মৌলবী মন্দির মসজিদ বৈধী সাধনা সবকিছু খারিজ করতে করতে আঠারো শতকের শেষদিকে আমাদের এই বাংলায় যত উপধর্ম জেগে উঠেছিল তার তালিকা বিচিত্র ও রোমাঞ্চকর। ‘বৈষ্ণব ব্রতদিন নির্ণয়’ বইয়ে উদ্ধৃত সেই তালিকা এই রকম : বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনী পন্থী, সহজিয়া, খুশিবিশ্বাসী, রাধাশ্যামী, রামসাধনীয়া, জগবন্ধু-জনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, সেনপন্থী, রামসনেহী, মীরাবাঈ, বিল্বলভক্ত, কর্তাভজা, স্পষ্টদায়িক বা রূপ কবিরাজী, রামবল্লভী, সাহেব ধনী, বলরামী, হজরতী, গোবরাই, পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পণারায়নী, বড়ী, অতি বড়ী, রাধাবল্লভী, সখিভাবুকী, চরণদাসী, হরিশ্চন্দ্রী, সাধনপন্থী, চুহড়পন্থী, কুড়াপন্থী, বৈরাগী, নাগা, আখড়া, দুয়ারা, কামধেন্বী, মটুকধারী, সংযোগী, বার সম্প্রদায়, মহাপুরুষীয় সম্প্রদায়ী, জগমোহিনী, হরিবোলা, রাতভিখারী, বিন্দুধারী, অনন্তকুলী, সৎকুলী, যোগী, গুরুদাসী বৈষ্ণব, খণ্ডিত বৈষ্ণব, করণ বৈষ্ণব, গোপ বৈষ্ণব, নিহঙ্গ বৈষ্ণব, কালিন্দী বৈষ্ণব, চামার বৈষ্ণব, হরিব্যাসী, রামপ্রসাদী, বড়গল, নস্করী, চতুর্ভুজী, ফারারী, বাণশয়ী, পঞ্চধুনী, বৈষ্ণব তপস্বী, আগরী, মার্গী, পল্টুদাসী, আপাপন্থী, সৎনামী, দরীয়াদাসী, বুনীয়াদদাসী, অহমদ্পন্থী, বীজমার্গী, অবধূতী, ভিঙ্গল, মানভাবী, কিশোরীভজনী, কুলিগায়েল, টহলিয়া বা নেমো বৈষ্ণব, জোন্নী, শার্ভল্মী, নরেশপন্থী, দশামার্গী, পাঙ্গুল, বেউড়দাসী, ফকিরদাসী, কুম্ভপাতিয়া, খোজা, গৌরবাদী, বামে কৌপীনে, কপীন্দ্র পরিবার, কৌপীন ছাড়া, চূড়াধারী, কবীরপন্থী, খাকী ও মুলুকদাসী।
এত উপধর্ম সম্প্রদায় ছিল এদেশে? তারা সব গেল কোথায়? সম্ভবত ঊনিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম সংস্কার আন্দোলন, মিশনারীদের প্রচার, ব্রাহ্মধর্মের উত্থান এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-বিজয়কৃষ্ণদের জীবন সাধনা এমন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে এইসব উপসম্প্রদায়ী পিছোতে পিছোতে গ্রামের প্রত্যন্তে লুকিয়ে পড়ে।
একদিকে উচ্চ ধর্মাদর্শ আরেকদিকে কট্টর মুসলমানদের সক্রিয় দমননীতি বাউল ফকিরদের ধ্বংস ক’রে দিল অনেকটা। শ্রীরামকৃষ্ণ তো এ’সব লোকায়ত ধর্মসাধনাকে সরাসরি অভিযুক্ত ক’রে বললেন : বাড়িতে ঢোকার দু’টো পথ- সদরের খোলা দরজা আর পায়খানা দিয়ে ঢোকা। সদর দিয়ে ঢোকাই ভালো, পায়খানা দিয়ে ঢুকলে গায়ে নোংরা লাগা স্বাভাবিক। তাঁর মতে কামিনীকাঞ্চনের সাধনা বিপজ্জনক।
শ্রীসদগুরুসঙ্গ’ দ্বিতীয় খণ্ডে ১২৯৭ সালের ডাইরিতে বিজয়কৃষ্ণে বলেছেন :
‘বাউল সম্প্রদায়ের অনেকস্থলে বড়ই জঘন্য ব্যাপার।
তা আর মুখে আনা যায় না। ভাল ভাল লোকও বাউলদের মধ্যে আছেন। তাঁরা সব চন্দ্রসিদ্ধি করেন। শুক্র চান, শনি চান, গরল চান, উন্মাদ চান, এই চার চান সিদ্ধি হলেই মনে করেন সমস্ত হ’লো। … আমি বললাম, “ওটি আমি পারবো না।
বিষ্ঠামূত্র খেয়ে যে ধর্ম লাভ হয়, তা আমি চাই না। ” মহান্ত খুব রেগে উঠে বললেন, “এতকাল তুমি আমাদের সম্প্রদায়ে থেকে আমাদের সব জেনে নিলে, আর এখন বলছ সাধন করব না। তোমাকে ওসব করতে হবে। ” আমি বললাম, “তা কখনই করব না। ” মহান্ত গালি দিতে দিতে আমাকে মারতে এলেন :শিষ্যরাও “মার্,মার্” শব্দ করে এসে পড়ল।
আমি তখন খুব ধমক দিয়ে বললাম, “বটে এতদূর আস্পর্ধা, মারবে? জানো আমি কে?” আমি শান্তিপুরের অদ্বৈত বংশের গোস্বামী, আমাকে বলছ বিষ্ঠামূত্র খেতে?” আমার ধমক খেয়ে সকলে চমকে গেল। ’
উচ্চস্তরের হিন্দু সাধকদের এই সব প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ নানাধরনের উপধর্মের লোকদের যতটা কমজোরী ক’রে দিয়েছিল তার চতুর্গুন লড়াই হয়েছিল ফকির দরবেশদের সঙ্গে নিষ্ঠাবান মুসলমানদের। বাংলার সামাজিক ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন তাঁরা এসব ঘটনা, কেন জানি না এড়িয়ে গেছেন।
হিসেব নিলে দেখা যাবে শেষ আঠারো শতকে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের বিপুল পরিমাণ শূদ্র ও গরীব মুসলমান বাউল বা ফকিরী ধর্মে দীক্ষা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ত্যাগ করতে থাকে। দেখা যায়, বাউল ফকিরদের মধ্যে মুসলমান ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ছিল খুব বেশি।
লালন শাহ থেকে আরম্ভ ক’রে বহুসংখ্যক উদাসীন ধর্মগুরু তাঁদের সৎ জীবনযাপন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শপ্রচার এবং সমন্বয়বাদী চিন্তাধারায় বহু সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ ক’রে নেন তাঁদের উপধর্মে। এতে বৃহত্তর হিন্দু মুসলমান ধর্ম, বিশেষ করে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব সমাজ এবং কট্টর ইসলামী সমাজ খুব বড় রকমের অর্থনীতিক ও সামাজিক ধাক্কা খায়। স্বভাবত প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জাগে। ‘পাষন্ড দলন’ জাতীয় বৈষ্ণবীয় বুকলেট বেরোয় অজস্র, যাতে কর্তাভজা ও অন্যান্য উপসম্প্রদায়দের আক্রমণ করা হয় ‘অনাচারী’, ‘ভ্রষ্ট’, ‘নিষিদ্ধাচারী’ আখ্যা দিয়ে, তাদের নারীভজন ও সহজিয়া সাধনতত্ত্বকে অপব্যাখ্যা ক’রে। উনিশ শতকে দাশরথি রায় তাঁর পাঁচালিতে গালমন্দ করলেন এসব সম্প্রদায়কে, কলকাতার জেলেপাড়ার সং বেরলো কর্তাভজাদের ব্যঙ্গ ক’রে।
শাস্ত্র বিরোধী বাউলদের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম শুরু হল উনিশ শতকের নদীয়া,যশোহর ও উত্তরবঙ্গের শরীয়তী মুসলমানদের সঙ্গে। বাউলদের অন্যান্য আচরণের, যেমন চারিচন্দ্রের সাধনা, ঘৃণ্যতার বিবরণ দিয়ে শরীয়তবদীরা বেশি জোর দিলেন বাউলদের গান গাওয়ার বিরুদ্ধে। ইসলাম ধর্মের একদল ব্যাখ্যাকারী জানালেন ইসলামে গান গাওয়া জায়েজ নয়। বাউলদের গানের আসরে তাঁরা দাঙ্গা বাধালেন। আলেম সম্প্রদায়ের নির্দেশে বাউলদের ওপর নানারকম দৈহিক নিপীড়ান শুরু হল এবং প্রায়শ তাদের ঝুঁটি কেটে নেওয়া হতে লাগল।
ভয়ে বাউলরা আত্মগোপন করল বা বহির্বাস ত্যাগ করল। এই সময়কার ওহাবী, ফারায়জী ও আহলে হাদীস আন্দোলন মুসলমান বাউলদের খুব ক্ষতি করল। তাদের জোর ক’রে শরীয়তমতে ফেরানো হতে লাগল। বহু মুসলমান সংস্কারক এই সময় বাউলদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী ক’রে লড়াইয়ে নামলেন। সে সময়কার কিছু লেখকের রচনায় বাউলফকির-বিরোধী ভাষা চোখে পড়ে।
যেমন মীর মশারর্ফ হোসেন লিখেছেন :
ঠ্যাঁটা গুরু ঝুটা পীর
বালা হাতে নেড়ার ফকীর
এরা আসল শয়তান কাফের বেইমান।
লোককবি জোনাব আলী হুংকার দিয়ে লেখেন :
লাঠি মার মাথে দাগাবাজ ফকিরের।
রংপুরর মৌলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদের লেখা ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’ বইটি কট্টর মুসলিম সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়। ১৩৩২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি লিখেছেন : ‘এই বাউল বা ন্যাড়া মত মোছলমান হইতে দূরীভূত করার জন্য বঙ্গের প্রত্যেক জেলায়, প্রত্যেক গ্রাম, মহল্যা জুমা ও জমাতে এক একটি কমিটি স্থির করিয়া যতদিন পর্যন্ত বঙ্গের কোন স্থানেও একটি বাউল বা ন্যাড়া মোছলমান নামে পরিচয় দিয়া মোছলমানের দরবেশ ফকীর বলিয়া দাবী করিতে থাকিবে ততদিন ঐ কমিটি অতি তেজ ও তীব্রভাবে পরিচালনা করিতে হইবে। মোটকথা মোছলমানগণের কর্ত্তব্য এই যে মোছলমান সমাজকে বাউল ন্যাড়া মত হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত না করা পর্যন্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে হইবে।
’
এমন বিবরণ প্রচুর মেলে। বাউল ফকিরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও অপপ্রচার উনিশ শতকের সীমান্ত পেরিয়ে বিশ শতকে ব্যাপ্ত হয়েছে। ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ বই থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলায় ষাট-সত্তর লক্ষ বাউল ছিল। উৎপীড়ন ও অত্যাচারে তারা সম্প্রদায়গতভাবে শীর্ণ ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। লিখিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে মওলানা আফছার উদ্দীনের নেতৃত্বে একদল ব্যক্তি কুষ্টিয়ায় ছেঁউরিয়া আশ্রমে সমবেত লালনপন্থি সমস্ত বাউলের চুলের ঝুঁটি কেটে নেয়।
তবে সব মুসলমান বাউল-বিরোধী ছিলেন এমন ভাবারও কারণ নেই। ১৯২৭ -এ ফরিদপুরে মুসলিম ছাত্র সমিতির বার্ষিক অধিবেশনে মুক্তবুদ্ধি মনীষী কাজী আবদুল ওদুদ বলেন : ‘ইসলাম কীভাবে বাঙালীর জীবনে সার্থকতা লাভ করবে, তার সন্ধান যতটুকু পাওয়া যাবে বাংলার এই মারফৎ-পন্থীর কাছে ততটুকুও পাওয়া যাবে না বাংলার মওলানার কাছে, কেননা সমস্ত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও মারফৎ-পন্থীর ভিতরে রয়েছে কিছু জীবন্ত ধর্ম, সৃষ্টির বেদনা, পরিবেষ্টনের বুকে সে এক উদ্ভব; আর মওলানা শুধু অনুকারক, অনাস্বাদিত পুঁথির ভাণ্ডারী -সম্পর্কশূন্য ছন্দোহীন তার জীবন।
‘এই মারাফত-পন্থীর বিরুদ্ধে আমাদের আলেম-সম্প্রদায় তাঁদের শক্তি প্রয়োগ করেছেন, আপনারা জানেন। আলেমদের এই শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলবার সবচাইতে বড় প্রয়োজন এইখানে যে সাধনার দ্বারা সাধনাকে জয় করবার চেষ্টা তারা করেন নি, তার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দূর্বলকে লাঠির জোরে তারা দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন। এ দেশে মারাফত-পন্থীদের সাধনার পরিবর্তে যদি একটি বৃহত্তর পূর্ণতর সাধনার সঙ্গে বাংলার যোগসাধনের আমাদের আলেমদের ভিতরে সত্য হ’তো, তাহলে তাঁদের কাছ থেকে শুধু বাউল ধ্বংস আর নাসারা দলন ফতোয়াই পেতাম না’।
প্রায় এক শতাব্দী ধরে এই দলন পীড়ন বাউল-দরবেশ-ফকিরদের দুর্বল ও দলছুট ক’রে দিলেও একেবারে লুপ্ত ক’রে দিতে পারে নি। কারণ নিচুসমাজের মানুষ অসাম্প্রদায়িকভাবে গ্রাম্যসমাজে সহজে মিলতে মিশতে পারে। খোঁজ করলে দেখা যাবে অখন্ড বাংলায় যত উপধর্ম সম্প্রদায় গজিয়ে উঠেছিল তাদের বেশিরভাগ প্রবর্তক একজন মুসলমান অথবা হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে। কর্তাভজাদের স্রষ্টা আউলেচাঁদ একজন মুসলমান আর তাঁর প্রধান শিষ্য রামশরণ পাল একজন সদ্ গোপ। সাহেবধনী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক একজন মুসলমান উদাসীন এবং এ ধর্মের প্রধান সংগঠক চরণ পাল জাতে গোয়ালা।
আসলে বাংলার লৌকিক উপধর্মগুলির ভিত্তিতে আছে তিনটি প্রবর্তনা – মুসলমান বাউল ফকির দরবেশদের প্রত্যক্ষ প্রভাব, শোষিত শূদ্রবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবিরোধ এবং লোকায়ত বৈষ্ণব ধর্মের উদার আহ্বান। এই শেষ বিষয়টির একটি সামাজিক ব্যাখ্যা দরকার।
শ্রীচৈতন্য আমাদের দেশে এসেছিলেন এক সময়োচিত ভূমিকায় পরিত্রাতার রূপে। তখন ষোড়শ শতকে মুসলমানের ব্যাপক হিন্দু ধর্মান্তকরণ রুখতে এবং শূদ্রবর্ণের উপর শুদ্ধ ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ঠেকাতে তিনি এক উদার সমন্বয়বাদী বৈষ্ণব ধর্মের পরিকল্পনা নেন। তাঁর ধর্মসাধনের সরলতম পন্থা ছিল ‘হরের্নামৈব কেবলম্’।
এক বিপুল জনসন্নিবেশ বৈষ্ণব ধর্মকে বেগবান করে তোলে। কিন্তু শ্রী চৈতন্যের তিরোভাবের পরেই বৈষ্ণব ধর্মে ভেদবাদ জেগে ওঠে। বৃন্দাবনের গোস্বামীরা সংস্কৃতে শাস্ত্র বই লিখে চৈতন্যতত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় বেশি মনোযোগী হলেন। তাঁর লোকশিক্ষা আর সাধারণ মানুষের সংরক্ষণের দিকটা হলো উপেক্ষিত। সাধারণ বৈষ্ণব মানুষ আর তাদের মুক্তিদূত শ্রী চৈতন্যের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো রাশি রাশি শাস্ত্র আর পুঁথি।
অসহায় শূদ্ররা তখন ভ্রষ্টাচারে মগ্ন হলো। সেই সঙ্কটকালে নিত্যানন্দের ছেলে বীরচন্দ্র বা বীরভদ্র আরেকবার অবতার আর ত্রাতারূপে দেখা দিলেন। পলাতক ভ্রষ্টাচারী বৌদ্ধ সহজিয়া, মিথুন সাধক মূর্খ তান্ত্রিক আর অজ্ঞ মুমুক্ষু মানুষদের বীরভদ্র আবার বৈষ্ণব করলেন। এবারকার বৈষ্ণবায়নে এলো নানা লৌকিক গুহ্য সাধনা, নিশ্বাসের ক্রিয়া ও গোপন জপতপ। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠল নতুন নতুন আখড়া ও শ্রী পাট।
গঙ্গার ধারে ধারে পাটুলী কাটোয়া অগ্রদ্বীপ ধরে আস্তানা পাতল সহজিয়া বৈষ্ণবরা। বীরচন্দ্রকে তারা দেখল চৈতন্যের অবতার রূপে। নতুন নেতারা জয়ধ্বনি দিয়ে তারা ঘোষণা করল নতুন বাণী :
বীরচন্দ্র রূপে পুনঃ গৌর অবতার
যে না দেখেছে গৌর সে দেখুক একবার।
কালক্রমে লোকগুরুরা গীতার ‘যদাযদাহি ধর্মস্য’ শ্লোকটি সামনে রেখে এমন একটা স্বতঃসিদ্ধ বানিয়ে ফেললেন যাতে নির্জিত শোষিত মানুষরা বিশ্বাস ক’রে নিল কৃষ্ণের অবতার গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গের অবতার বীরচন্দ্র। এই সূত্র অনুসরণ করে আমরা সকৌতূহলে দেখতে পাই কর্তাভজা ধর্মের প্রথমদিকের ঘোষণা ছিল : ‘কৃষ্ণচন্দ্র গৌরচন্দ্র আউলে চন্দ্র/তিনিই এক একেই তিন’।
তার মানে বীরচন্দ্র সরে গিয়ে এলেন আউলেচন্দ্র। তৈরি হলো এক বৈষ্ণব বিশ্বাসী নতুন উপধর্ম। অচিরে সেই উপধর্ম কর্তাভজাদের নেতৃত্বে এলেন দুলালচন্দ্র পাল, যাঁর মার (মূল নাম সরস্বতী) নতুন নামকরণ হলো সতী মা। সতী মা নামে শচী মা ধ্বনির আভাস তো স্পষ্ট। এর গায়ে গায়ে তৈরি হলো নতুন উচ্চারণ।
তিন এক রূপ
শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র শ্রীগৌরচন্দ্র ও শ্রীদুলাল চন্দ্র।
এই তিন নাম বিগ্রহস্বরূপ । ।
কেমন সুপরিকল্পিতভাবে আউলে চন্দ্রকে সরিয়ে দুলাল চন্দ্র লোকমানসে আসন পাতলেন।
একশো বছর আগে অক্ষয়চন্দ্র দত্ত যখন ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটি লেখেন তখন বাংলার বিভিন্ন উপধর্মের হদিস দেন এবং একটি মোটামুটি প্রতিবেদন খাড়া করেন।
মুশকিল যে, অক্ষয়কুমার নিজে সরেজমিন খুঁজে পেতে ঘুরে প্রতিবেদন লেখেননি। মোটামুটি খবর এর-তার কাছ থেকে সংগ্রহ ক’রে লিখেছিলেন। তাতে ভুল আছে,খণ্ডতা আছে। বরং অনেকটা ঘুরে বিবরণ লিখেছিলেন যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর Hindu Castes and Sects বই লেখার সময়। মেহেরপুরে বলরামী সম্প্রদায়ের বিবরণ অক্ষয়কুমার নিতান্ত রৈখিকভাবে দিয়েছেন, অথচ বিদ্যাভূষণ স্বয়ং মেহেরপুরে গিয়ে বলরামের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা ক’রে তবে লেখেন।
ষাটের দশকের শেষে আমি যখন উপধর্ম সম্পর্কে খোঁজ করতে শুরু করি তখন বিদ্যাভূষণের পদ্ধতিই শ্রেয়তর মনে হল। এ লেখার পরবর্তী অংশ সেই পায়ে-হাঁটা, চোখে-দেখা আর কানে-শোনার সত্য বিবরণ। এতে আছে লৌকিক উপধর্মের সেই পরাক্রান্ততা, সভ্যতা-রাজনীতি-বিজ্ঞান-শাস্ত্র-নিপীড়ন যাকে আজও মারতে পারেনি।
চলবে….
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।