লোকালয়ে মোর আলয়, তবু বাস করি অন্যলোকে আমি এখন রোকেয়া হলের মেইন বিল্ডিংয়ে অবস্হানরত একমাত্র ছাত্রী। রুমমেটরা চলে গেছে ৪/৫ দিন আগেই। আমার যাওয়ার কথা ছিল গতকাল। কিন্তু যে ভয়াবহ পরিস্হিতির সম্মুখীন হয়ে আজ আমি একা একা হলে ঈদ কাটাতে বাধ্য হলাম তা বলছি।
এ মাসের শুরু থেকেই মেয়েরা একে একে কাঁধে ব্যাগ আর মুখে হাসি ঝুলিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল।
আমি মনে মনে দিন গুনছিলাম কবে আমিও আব্বু-আম্মু আর ছোট বোনটার কাছে ফিরে যেতে পারব। টিকিট পাচ্ছিলাম না কোথাও। অবশেষে অনেক টেনশন, ছুটাছুটির পর আমার এক বন্ধুর কাছে ৫ তারিখ ট্রেনের টিকিট প্রাপ্তির সুখবর জানলাম। মনটা হালকা হয়ে গেল। দুদিন আগেই বোকার মত ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছি।
কয়েকটা দিন ধরে রুমে একা থাকতে থাকতে পাগল প্রায় অবস্হায় আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হল।
আমার গন্তব্য দিনাজপুর। পাবর্তীপুর স্পেশাল ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছে। যাত্রী আমরা চারজন। আমি, লেনিন, বাঁধন, আর এক বড় ভাই।
ট্রেনের টাইম ৪টা ২৫। আমরা ৩টা বাজতেই স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। যথারীতি শুনি ট্রেন লেট। এটা কিছু না। জানতাম এমন হবেই।
সবাই রিল্যাক্স থাকার চেষ্টা করছিলাম। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা দেখে নিজেরা ফান ইন্টারভিউ দিলাম, "অপরাধকন্ঠ" টাইপ পত্রিকা কিনে নায়িকাদের স্ক্যান্ডাল পড়ে, গান শুনে, চা খেয়ে, হাঁটাহাটি করে, রঙ বেরঙের মানুষগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে করে নিজেকে চাঙ্গার রাখার বদলে এক সময় বোর হয়ে গেলাম। মনের মধ্যে নানা অনিশ্চয়তা চলছিল। ট্রেন কখন আসবে, পার্বতীপৃর কখন পৌঁছবে, আবার সেখান থেকে দিনাজপুর কীভাবে যাব, কখন বাড়িতে পৌঁছে মাকে জড়িয়ে ধরতে পারব!
অন্তহীন অপেক্ষা। হাজার হাজার মানুষের মাঝে বিরক্তিকর অপেক্ষা।
ট্রেন এল প্রায় ৪ ঘন্টা পর। ততক্ষণে স্টেশনের প্লাটফরমে তিল ধারণের জায়গা নেই। থৈ থৈ করছে অসংখ্য মানুষ। সবাই একদম রেডি ট্রেন আসামাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমরাও ব্যাপারটাকে মজা হিসেবে নিয়ে যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
আজ দেখিয়ে দেব!
ট্রেন আসল। তারপরের দৃশ্য অবিশ্বাস্য, অবাস্তব, অকল্পনীয়.......আর কী বলব! ট্রেন আগে থেকেই একেবারে ভর্তি। এতটুকু জায়গা খালি নেই। আমরা আমাদের টিকিট মিলিয়ে বগি খুঁজতে এ মাথা থেকে ও মাথা ২/৩ বার দৌড়াদৌড়ি করলাম। এমনকি এটা পার্বতীপুরের ট্রেন কি না তাও বুঝতে পারছিলাম না।
কারণ ট্রেনের গায়ে খুলনা পাকশী লেখা।
ভাই এটা কি পার্বতীপৃর যাবে? ভাই, এটা কোন ট্রেন? কে জবাব দেবে? মানুষ তখন পাগল হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে, দরজা দিয়ে, এ ওর ঘাড়ে পা দিয়ে ছাদে, পাদানীতে, ইঞ্জিনে, যে যেখানে পারে যেভাবে পারে, ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করছে। আমরা কিছু ভাবতে পাছিলাম না। সবার মত আমরাও যেকোনও ভাবে শরীরটা ট্রেনের ভেতর ঢুকানোর উন্মাদনায় মেতে উঠলাম।
আমার বন্ধুরা আমাকে পেছন থেকে ঢেলে দিল। অনেক মানুষের সাথে আমিও প্রাণের মায়া বিসর্জন দিয়ে ভেতরে ঢুকতে লাগলাম। অসম্ভব চাপে ঢুকেও গেলাম। ভেতরে এক ইঞ্চি জয়িগা ছিল না। অথচ পেছন থেকে ভয়ানক চাপ্।
ট্রেনে কারেন্ট নাই... ঘুটঘুটে অন্ধকার, হাজার হাজার হাজার মানুষ....সবাই প্রাণপণে একে অন্যকে ঠেলছে....বাথরুমের ভেতরে অন্তত ১০জন মানুষ....নারী-পুরুষ নির্বিশেষে....এর মধ্যে কয়েকটা পশু মেয়েদের গায়ে জঘন্যভাবে হাত দিয়ে যাচ্ছে। আমার সেই মূহুর্তের অনুভূতি বলতে কী ছিল আমি বোঝাতে পারব না। এরই ভেতর কয়েকটা টুকরো টুকরো মুখ আমাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে ফেলল।
আমার পাশেই এক মহিলা পাগলের মত কাঁদছিল "আমার বাচ্চাটা কোথায় গেল, বাচ্চাটাকে পাচ্ছি না, আল্লাহ, বাঁচাও, আমার বাচ্চাকে বাঁচাও" বলে।
আরেক পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছিল, "আমিও তো মহিলা আমাকে আগে উঠতে দেন"- কারণ আশেপাশে বলা হচ্ছিল আগে মহিলাদের উঠতে দেন।
আর আমি একটু নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলাম। "প্লিজ একটু জায়গা দেন, শ্বাস নিতে পারতেছি না। আমি নামব ভাই, প্লিজ........"
কিন্তু নামার কোনও উপায় ছিল না। আমার ব্যাগ কোথায় কী, কোনও খেয়াল ছিল না। আমি শুধু জানতাম বাঁচতে হলে আমাকে নামতে হবে।
শেষে কীভাবে নামতে পেরেছিলাম খেয়াল নেই। নেমেই আমার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছি। অনেকক্ষণ প্লাটফরমের উপর বসে কাঁদতে থাকি! এ পরিস্হিতি যে নিজে দেখেনি সে বুঝবে না। আমি ঘেমে সম্পূর্ণ ভিজে গিয়েছিলাম এবং প্রায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলাম। পা দুটো ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছিল মানুষের পায়ের চাপে।
একজন আমাকে নিয়ে ফিরে চলল। বাকিরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর বাকি দুজনও ফিরে এল। আমাদের কারো কথা বলার মত শক্তি ছিল না। এর মধ্যে একজন বইয়ের ব্যাগ হারিয়ে ফেলেছে।
আল্লাহর রহমতে আমার ল্যাপটপ মোবাইল ঠিক ছিল। কারণ ওগুলো নিয়ে উঠিনি। ওঠা সম্ভবও ছিল না। আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম।
কিন্তু আমি কান্না থামাতে পারছিলাম না।
ভুলতে পারছিলাম না ভিড়ের ভেতরকার মানুষগুলোর আকুতি, সন্তান হারিয়ে ফেলা মায়ের আহাজারি, একটু শ্বাস নেবার জন্য চিৎকার।
তারপর থেকে হলে একা আমি। ফিরে এসে রুমের তালা খুলতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম খানিকক্ষণ। দুপুরে এই তালাটা লাগিয়েছিলাম অনেক আশা আর আনন্দ নিয়ে। ভাবিনি এভাবে ফিরে আসতে হবে।
ব্যাগের কাপড়গুলো বের করে আগের জায়গায় গুছিয়ে রাখলাম। আম্মু, আব্বু আর ছোট বোনের জন্য কেনা গিফটগুলো তুলে রেখে দিলাম। প্রায় অর্ধচেতন অবস্হায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাতটা কেটেছে অনেক কষ্টে। সকালেই উঠে প্রথমেই নেটে বসে পেপারটা খুললাম।
যা ভেবেছিলাম, তাই। পাবর্তীপুর স্পেশাল ট্রেনের ৬ জন যাত্রী ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে। এ ধরণের অমানবিক অবস্হায় সব যাত্রী সুস্হভাবে পৌঁছানোটা একেবারেই অসম্ভব ছিল। হয়তো ভেতরেও অনেক যাত্রী অসুস্হ হয়ে পড়েছিল, যার খবর পেপারে আসেনি।
বাসায় সবাই অনেক কষ্ট পেয়েছে।
কেউ এটা মেনে নিতে পারছে না। বাবামাকে ছেড়ে জীবনে কোনও ঈদ করিনি। এভাবে একা তো না-ই। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে আমার মনে, চিন্তায়, ভাবনায় শুধু গতকালকের স্মৃতিগুলোই ভেসে উঠছে। কাল ঠিক এই সময়ে এক বীভৎস, নারকীয় পরিস্হিতির মাঝে ছটফট করছিলাম আমি এবং আমার মত আরও হাজার হাজার অসহায় মানুষ।
আমি যেন এখনও আচ্ছন্ন হয়ে আছি সেই শ্বাসরুদ্ধকর, উন্মাদ, বিভীষিকাময় ত্রিশটি মিনিটেই।
জানি না এ অবস্হা কাটিয়ে উঠতে পারব কি না। সবাই দোয়া করবেন।
পরিবারের সবার সাথে আনন্দে কাটুক সবার ঈদ।
ঈদ মোবারক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।