২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ 'দিন বদলের' স্লোগান দিয়েছিল। এবারের প্রহসনমূলক নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের কি নির্বাচনী ইশতেহার ছিল তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি, প্রয়োজনও বোধ করেনি। আর সেই নামকাওয়াস্তে ইশতেহার দেওয়াও হয়েছিল নির্বাচনের মাত্র দুই-তিন দিন আগে, যখন ভোটারদের পক্ষে পাঠ করে বিবেচনা করারও কোনো সময় বা সুযোগ ছিল না। আর সবচেয়ে বড় কথা, তার প্রয়োজনও হয়নি। কারণ অর্ধেকের বেশি ভোটার ভোট প্রদানের সুযোগই পাননি।
তারপর কী ধরনের ভোটারবিহীন তামাশার নির্বাচন অনুষ্ঠান করল নিবীর্য আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, তা দেশ-বিদেশের সবাই জানেন।
তারপর সরকার গঠিত হলো। নৈতিকভাবে এই সরকারের গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও সরকার গঠিত হয়েছে এবং তারা এখন শাসনকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, এটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন, তবু কিছু কিছু মন্ত্রী খায়েশ প্রকাশ করেছেন পাঁচ বছর চালিয়ে যাওয়ার।
যাক সেসব কথা।
গতবার 'দিন বদলের' অঙ্গীকারের নির্বাচন ও বিপুল ভোটে বিজয়ী সরকারের কাছ থেকেও যখন দিন বদলের মতো দেশবাসী নতুন কিছু পায়নি, তখন এরকম অগ্রহণযোগ্য ও নৈতিকভাবে দুর্বল সরকারের কাছ থেকেই বা কী আশা করব? তবে সাধারণ মানুষের দিন বদল না হলেও কিছু লোকের যে ভাগ্য বদল ঘটেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কতিপয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকারের পাঁচ বছরে সম্পদ ও আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল কয়েক হাজার শতাংশ। পাঁচ বছরের মধ্যে নতুনত্বের খবরও ছিল বেশ কিছু। সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি বা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড অবশ্য ছিল বিএনপি-জামায়াত আমলেও।
তখন ছিল ক্লিন হার্ট অপারেশন। আওয়ামী লীগ আমলে সেটা হলো ক্রসফায়ার। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে মাত্র এক মাসে বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড আরও বেশি করে ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
নতুনত্ব আমরা যে একেবারে কিছু পাইনি বা দেখিনি তা-ও নয়। ২০১৪ সালের তামাশার নির্বাচন এক তামাশার সংসদ উপহার দিয়েছে, যেখানে তথাকথিত বিরোধী দলও সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন।
কিছু দিন আগে এক টকশোতে আমি এ ধরনের সরকারকে 'আজব সরকার' বলে অভিহিত করলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমার কথার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, এটার মধ্যে নাকি অভিনবত্ব ছিল না। সময় পাইনি, তাই প্রত্যুত্তর দিতে পারিনি। তিনি বললেন, এ ধরনের সরকার নাকি ইতিহাসে আরও আছে। তাকে বলে রেইনবো সরকার। টকশোতে ব্যাখ্যা চাওয়ার সময় পাইনি।
তবে নিশ্চিতভাবে আমি বলতে পারি, এমন আজব সরকারের দ্বিতীয় উদাহরণ আর নেই। ওয়েস্ট মিনস্টার পদ্ধতির সংসদীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাসী লীগ সরকার যে অভিনবত্ব দেখিয়েছে তাকে বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ কৌতুক করে বলেছেন, 'বঙ্গীয় ইস্ট মিনস্টার সরকার পদ্ধতি'।
ভোটারবিহীন নির্বাচন আগেও দেখেছি ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬ সালে, কিন্তু অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা ও 'আজব সরকার' গঠনের কিছু ক্ষেত্রে অভিনবত্ব আছে বৈকি। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে সব কিছু একই রকম আছে। দুর্নীতি, ক্রসফায়ার, মন্ত্রীদের আবোল-তাবোল বকবকানি কোনোটাতেই নতুনত্ব নেই।
এমনকি সেই ছাত্রলীগও একই রকম আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাতেও তার নমুনা দেখা গেল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গ আসতে মহাজোট সরকারের গত আমলের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা হবে। ব্যাস, অমনি পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তোলার হিড়িক পড়ে গেল।
চাঁদাবাজির ভালো মওকা পাওয়া গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তোলার সভা ডাকল। সেখানে চাঁদা তোলার উদ্বোধন করা হলো। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বয়ং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল মানুষ উপাচার্যের বোঝা উচিত ছিল যে, সরকারি ফান্ড এভাবে সংগৃহীত হয় না।
অনেক পরে সরকার বাধ্য হয়েছিল, পদ্মা সেতুর নামে এভাবে চাঁদা সংগ্রহ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে। কিন্তু ইতোমধ্যে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। দেশের উন্নয়নের নামে চাঁদাবাজি চলছে ব্যাপকভাবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কি জানতেন না যে, সরকারি ফান্ডের টাকা এভাবে আদায় করা যায় না? অথবা তিনি কি অসহায় ছিলেন ছাত্রলীগের দাপটের সামনে? অথবা তিনি নিজেও অতি উৎসাহী ছিলেন, তার দলীয় আনুগত্য বা প্রীতি একটু বেশি মাত্রায় ছিল। যাই হোক, তিনি নিজে এমন অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য আহূত সভায় ছিলেন প্রধান অতিথি।
তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন যে তিনি উপাচার্য। শেষ পর্যন্ত সংগৃহীত অর্থ সরকারি ফান্ডে জমা পড়েনি। বরং চাঁদার ভাগ নিয়ে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে মারামারি, একপর্যায়ে গোলাগুলি হলো। এক তরুণকে জীবন হারাতে হলো। সেই তরুণটিও ছিল ছাত্রলীগের কর্মী।
কিছুই বদলায়নি। কিছুই বদলায় না। সেই সরকারও বদলায়নি। বদলায়নি ছাত্রলীগ।
আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ খবরের কাগজের শিরোনামে এসেছে।
টিভির পর্দায় দেখা গেছে। খবরের কাগজের ছবিতেও দেখা গেছে। রাজশাহীর ছাত্রলীগ নেতাদের কেউ কেউ পিস্তল হাতে সাধারণ ছাত্রদের, আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলি ছুড়ছে। পাশে পুলিশ ছিল। পুলিশও গুলি ছুড়েছে।
ছাত্রলীগ ছিল পুলিশের সহায়ক শক্তি। এর আগেও একই রকম ঘটনা দেখেছি।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী নাটকের আগে দুই মাস ধরে যে অবরোধের নাটক হয়েছিল, সেখানে জামায়াত-বিএনপি প্রধানত নৃশংসতা করলেও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররাও সহিংস কারবার করেছিল। তখনো দেখেছি পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে লীগ কর্মী পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়ছে। রাজশাহীর ঘটনা প্রসঙ্গে সরকারের কোনো কোনো কর্মকর্তা বলার চেষ্টা করছেন যে, সাধারণ ছাত্রের নামে শিবির ঢুকে পড়েছিল।
তাই ছাত্রলীগ এমন অ্যাকশনে গেছে। প্রথম কথা, তথ্য হিসেবে এটা সত্য নয়। দ্বিতীয়ত, শিবিরকে দমন করার জন্য কি পুলিশ যথেষ্ট ছিল না? পুলিশের অকজিলিয়ারি ফোর্স হিসেবে ছাত্রলীগকে কবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে?
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদকীয়তে (৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪) বলা হয়েছে, 'নির্বাচনের আগে কয়েক মাস ধরে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সন্ত্রাস-নাশকতার মুখে কার্যত ইঁদুরের গর্তে লুকিয়েছিল ছাত্রলীগ নামধারীরা। নির্বাচনের পর সে দুর্দিনের অবসান হওয়ার পর এই ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবরা স্বরূপে আবিভর্ূত হয়েছে। ' এরপর সম্পাদকীয়তে পুলিশের ভূমিকারও তীব্র নিন্দা করা হয়।
কারণ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এ কাজ করছে পুলিশের ছত্রছায়ায়। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, '... ছাত্রলীগ নামধারীরা পুলিশের ভাড়াটিয়া বাহিনীর ভূমিকা পালন করবে তা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ছাত্রলীগের অস্ত্রবাজ ক্যাডাররা যেভাবে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া চালিয়েছে তা শুধু নিন্দনীয় নয়, পুলিশের মুখে চুনকালি লাগানোর জন্যও যথেষ্ট। '
বিগত পাঁচ বছরে পুলিশের যে ভূমিকা আমরা দেখে আসছি, তার থেকে নতুন কিছু ঘটেনি এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য পুলিশ প্রশাসনকে আলাদা করে দায়ী করাই যথেষ্ট নয়।
সামগ্রিকভাবে সরকারের পলিসি ও রাজনৈতিক নির্দেশ না থাকলে পুলিশ এভাবে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পারে না। এসব হচ্ছে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দলীয় সন্ত্রাস পাশাপাশিও একযোগে চলে। ফ্যাসিবাদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো প্রশাসন ও দলের মধ্যে পার্থক্য মুছে ফেলা।
বিগত লীগ শাসনামলে আমরা পুলিশের তিন রকম ভূমিকা দেখেছি।
বিগত সংসদের বিএনপির হুইপ জনাব জয়নুল আবদিন ফারুককে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে পিটিয়েছিল পুলিশ। যে পুলিশ অফিসার এমন জঘন্য কাজটি করেছিল, তাকে আবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল। তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ঔদ্ধত্যভরে কিন্তু মূর্খের মতো বলেছিলেন, ফারুককে এমনভাবে প্রহার করার জন্যই তো সেই অফিসারকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এসব গণতন্ত্রের ভাষা নয়। এমন ঔদ্ধত্যের পরিণতিও ভালো নয়।
যাই হোক, একই অফিসারকে আবার অন্যভাবে দেখেছি। দেখেছি তিনি নীরব ভূমিকা পালন করছেন যখন তারই সামনে ছাত্রলীগের কর্মীরা বিশ্বজিৎকে হত্যা করল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন পার্লামেন্টে বলেছিলেন, 'কারা সন্ত্রাস করছে? একটি হিন্দু ছেলেকে কারা হত্যা করল?' প্রধানমন্ত্রীর ধারণা ছিল, জামায়াতের ডাকা হরতালে বুঝি জামায়াতরাই হিন্দু ছেলেকে হত্যা করেছে। তিনি তখনো জানতেন না যে, তার আদরের ছেলেরা ছাত্রলীগের কর্মীরাই এ কাজটি করেছে। জানলে হয়তো তিনি পার্লামেন্টে এ প্রসঙ্গ তুলতেন না।
যাই হোক, ছাত্রলীগ অ্যাকশনে, অতএব পুলিশ সেদিন নিশ্চুপ ছিল। আর এখন রাজশাহীতে পুলিশ সাহায্যকারী। এটা গেল পুলিশের দ্বিতীয় রূপ। পুলিশের আরেক অসহায় রূপও দেখেছি, যখন জামায়াত-শিবির পুলিশের মাথা থেঁতলে দিয়েছিল। সেটাই বা কীভাবে সম্ভব, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
উপরোক্ত সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়েছে, 'সবারই জানা, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনের মাধ্যমে। জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তোলা এ সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। '
যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে, তাতে গ্রহণযোগ্যতা প্রথম থেকেই ছিল না। তারপরও যদি আগের মতোই ছাত্রলীগের তাণ্ডব ও অন্যান্য কেলেঙ্কারি একই ধারায় অব্যাহত থাকে, তাহলে নতুন করে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলবে, এমন ভরসাই বা কোথায়?
লেখক : রাজনীতিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।