'আছোত্তি ভালা?' দুর্বল হাতে আমার মাথাটা টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঘষে দাদু জিজ্ঞেস করলেন। আগে যখন বাড়ি ফিরতাম, এমনকি ক্লাস এইট পর্যন্ত বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই দাদু টেনে নিয়ে কোলে বসিয়ে রাখতেন, আর খসখসে হাত বুলিয়ে দিতেন সারা শরীরে। আমি বেচারা চরম অস্বস্তি আর বাইরে দৌড়ে বেড়ানোর আকর্ষণে ছটফট করে নিজেকে ছাড়িয়েই দিতাম ছুট। আমার সেই দাদুই এখন এত বুড়ো হয়ে গেছে যে দেহটা গুটলু পাকাতে পাকাতে এতটুকুন হয়ে গেছে! দাঁতগুলো পড়ে গেছে সব, কথা বলতে গেলে হড়হড় করে বের হয়ে যায় দাঁতের ফাঁক দিয়ে। কানে শুনতে পান না, এইমাত্র বলা কথাটা ভুলে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেন।
'চাইয়্যা রইছি খালি, কুন সম তোরা আইবি! কত দোয়া করছি আল্লাহর কাছে আমার পুতেরে, বউরে, নায়-নাতকুররে ঠিকমত পৌঁছায় দেও। ' ঘুরে ফিরে বারবার এই কথাগুলোই বলতে লাগলেন। দাদুই আমাদের বাড়ির সাথে শেষ শেকড়টি। যে কোনদিন যেকোন সময়েই হয়তো উপড়ে যাবে এই শেকড়টা। তাই এত কষ্ট, ঝামেলা সহ্য করেও প্রতি বছর আমরা ফিরি, একবারের জন্য।
প্রতিবার মামণি বলে, 'তওবা করছি, সামনের বছর আর এই দুর্গতি করবো না। ' কিন্তু তারপরও প্রতিবার দাদুর পছন্দের ইলিশ মাছ আলাদা করে রাখে, গ্রামে তো পাওয়া যায় না। তারপরও সাড়ে চার ঘন্টার রাস্তা আমরা বার ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে ফিরে আসি, দাদুর বাড়িতে। ছোটবেলায় দাদা বাজারে যাওয়ার সময়ে দাদু আমার কানে কানে শিখিয়ে দিতেন ইলিশ মাছের কথা বলতে। আর আমিও দাদার সামনে যেয়ে লাফাতাম, 'ইঙ্গিল মাছ! ইঙ্গিল মাছ!' বলে।
এত সহজ নামটা এত কঠিন করে বলতে কোথায় শিখেছিলাম কে জানে! দাদার অনেক অনেক আদরের ছিলাম আমি। যখন দাদা মারা যান, এতটাই কষ্ট পেয়েছিলাম যে কিছুদিন খুব অস্বাভাবিক আচরণ করতাম। ভর দুপুরে কবরস্থানে গিয়ে বসে থাকতাম, কথা বলতাম না কারো সাথে। একারণেই আমার প্রতি এখনও দাদুর পক্ষপাতটা একটু বেশি।
যখন খুব ছোট ছিলাম, আমি আর শারমিন আপু মিলে ঈদের আগের দিন পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিতাম...উঠান, আনাচে-কানাচে, এমনকি সেই রাস্তা পর্যন্ত।
ঈদের দিন লোকজন বেড়াতে এসে যদি বাড়ি নোংরা দেখে তাহলে কি লজ্জার কথা হবে না! একবার আমরা সবাই মিলে কই যেন বেড়াতে গেলাম। ফেরার পথে শারমিন আপু আর শাহেদ ভাইয়া টুপ করে রিকশা থেকে নেমে পাশের গ্রামে আমার ফুপুর বাড়ি চলে গেল। কেউ টের পায়নি ওরা যে নেমেছে। বাড়ি ফিরে বিশাল হইচই, 'পোলা-মাইয়্যা দুইটা কই হারাইল!' আর আমি মন খারাপ করে ঘরে বসে আছি, কারণ শারমিন আপু আমার বিড়ালওয়ালা স্কার্টটা পরে ছিল। ও যদি হারায় তাহলে তো আমি স্কার্টটা আর ফেরত পাবো না।
ওইদিন ওরা ঠিকই ফিরে এসেছিল, কিন্তু তার কিছুদিন পরে শারমিন আপু হারিয়ে গেল একেবারে। এক সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলের নিচে কাদের যেন ছায়া দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে মেয়েটা চলে গেল। পুরনো কথা মনে পড়তেই আজ সকালে বাড়ির উঠোন, চারপাশটা ঝাড়ু দিলাম। একাই.....তবে কেন যেন মনে হচ্ছিল আপুটা আমার পাশেই আছে, প্রতিযোগিতা হচ্ছে কে কত বেশি জায়গা ঝাড়ু দিতে পারে।
ভোরে উঠার অভ্যাস আমার কখনো ছিল না।
কিন্তু বাড়ি ফিরলে শারমিন আপু আমাকে টেনে-টুনে তুলে দিতো ফজরের সাথে সাথেই। আর ওর সাথে 'বিছনা'য় হেঁটে এসে এমনকি মক্তবেও যেতে হতো। ছোটবেলা থেকেই শাড়ি আমার খুব প্রিয়। তাই একবার ঈদে আব্বু আমাকে জামা কিনে না দিয়ে শাড়ি দিল। লাল টুকটুক একটা শাড়ি, তার সাথে লাল ব্লাউজ আর পেটিকোট।
ঈদের দিন আমি আর শারমিন আপু মিলে কত জায়গায় যে ঘুরলাম! আমাদের গ্রাম পার হয়ে মনে হয় আরো তিন-চারটা গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। সবাই অবাক বিস্ময়ে বলে, 'কেডা গো? ওওও আমিনের ঝি নি!'
আর ঈদের তিন-চারদিন আগে থেকে আমরা, আমি-আপা-শাহেদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে থাকতাম 'ঘাডা'র সামনে। আর যখনই দেখতাম কেউ গরু নিয়ে আসছে, দূর থেকেই শুরু করতাম চিৎকার। একদম কাছে না আসা পর্যন্ত শাহেদ ভাইয়া রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাচতে থাকতো। কি যে ছিল ওর নাচের মধ্যে কে জানে! গরুগুলো ক্ষেপে-টেপে অস্থির হয়ে যেতো একেবারে।
আর দূর থেকেই গবেষণা শুরু হতো এটা ষাঁড় নাকি গাভী! ষাঁড় থেকে নাম হল বেরেষ, তারপরে ব্যালেট। 'এইইইই ব্যালেট...টিক টিক টিক...' আর সেই নাচ! শাহেদ ভাইয়া তো এখন আর ঈদে বাড়ি আসে না, আপাও দেশে নাই চার বছর হল। আমি একাই পড়ে আছি। ঘরের কোণায় চুপ করে বসে বাইরে পিচ্চি-পাচ্চাদের হইচই শুনি।
আর সন্ধ্যায় বসতো মেহেদীর আসর।
হাতে বাটা মেহেদী, কলাপাতায় রাখা। দুই হাতের আঙুলে টুপি করে পরাতাম, আর হাতের তালুতে বড় একটা গোল চাঁদ, তার আশেপাশে ছোট ছোটে আরো অনেকগুলো। ছোট ছিলাম বলে এরচেয়ে ভাল কিছু আমার ভাগ্যে জুটতো না কখনো। কত বছর যে আমি ঈদের সময়ে হাতে মেহেদী দেই না! প্রায় সাত-আট বছর হবে বোধহয়।
বাজার থেকে আমরা রিকশা নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত আসি।
রাস্তার মাঝে একটা কালভার্ট মত আছে। আগে কালভার্টটা এত উঁচু ছিল যে রিকশা এমনি উঠতো না, ঠেলে তুলতে হতো। আমি আর আপা ওইখানেই রিকশা থেকে নেমে বাকি রাস্তা দৌঁড়ে আসতাম। আর ছোটবেলায় আমাকে সবাই বলতো ওই কালভার্টের নিচে নাকি আমি দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম, আর দাদা বাজার থেকে ফেরার পথে কান্না শুনে মায়া হয়েছিল বলে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। আমি তো আসলে ওদের মেয়ে নই, কুড়িয়ে পাওয়া।
ওহ, ছোট্ট একটা মেয়ে, আর আমার মত একটা ছিঁচকাঁদুনের জন্য এটা যে কত ভয়ংকর একটা কথা! বললেই আমি কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলতাম। এই কথাগুলো পারভিন আপু্ই বলতো সবচেয়ে বেশি, আর তারপরে আদরও করতো সব্বার চেয়ে বেশি। এবার ফেরার পথে দেখি রাস্তাটার সংস্কার করতে করতে এমন অবস্থা করেছে যে কালভার্ট আর রাস্তার উচ্চতা সমান হয়ে গেছে। এখন আর অনেক কষ্টে ঠেলে-ঠুলে রিকশা তুলে আবার নামার সময়ে 'ইয়েয়েয়েয়েয়ে......' করে নামা যায় না। এখন আর কালভার্টের পাশে মাদ্রাসার পুকুরটার উপর ঝাকে ঝাকে জোনাকি জ্বলে না।
এখন আর কলপাড়ে জোড়া তেতুল গাছে হুতুম প্যাঁচা দুটো বসে থাকে না। দিনের বেলায়ও অন্ধকার হয়ে থাকা বাড়ির পেছনের জংলাটা কেটে সাফ করে এখন বিল্ডিং করা হয়েছে। বাঁশবনে একবার দুপুরে বিনা বাতাসে বাঁশের ঠকাঠক বাড়ি খাওয়া দেখে, আর এক সন্ধ্যায় সাদা কাপড় পরা আপাদমস্তক ঢাকা একটা বুড়িকে হনহন করে কবরস্থানের দিকে চলে যেতে দেখে যেভাবে শিউড়ে উঠেছিলাম...তার কিছুই এখন আর হয় না। অনেক রাত পর্যন্ত সে'চাচ্চু উঠানে পাটি পেতে কাৎ হয়ে শুয়ে পিচ্চি-পাচ্চাদের গল্প শোনায় না। সেই উঠানটাই যে নাই আর এখন!
সময় যায়, সবকিছুই বদলায় সময়ের সাথে স্বাভাবিক নিয়মে।
শুধু আমার দাদু তার আদ্যিকালের অভ্যাসবশে এখনো সবার খাওয়া হয়েছে কি না তার খোঁজ নিয়ে যান। চিরকাল অন্যকে খাইয়েই গেছেন, নিজের আরাম-আয়েশের তোয়াক্কা করেন নি। তাঁর জীবনের পাঁচ ভাগের চার ভাগই কেটে গেছে রান্নাঘরে। তাই যখনই কেউ তাঁর সামনে পড়ে যায়, তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন আসে, 'আগো, খাইছোত্তি?'
বুড়ো গাছটির ছায়া আর মমতার স্পর্শ খুব অস্বস্তিকর লাগে বলে আমি তাঁর আশেপাশে যাই না খুব একটা। মামনি বারবার বলে, 'এখন আর ঘরে কোনাটার মধ্যে না গিয়ে একটু দাদুর কাছে বয়'।
আমি বসি না। তারপরও সেই মমতাময় বুড়ো গাছটার মায়াময় স্পর্শে শীতল হই। আগে রান্নাঘর থেকে দাদু বেরুতে চাইলেই আমি যতদূর সম্ভব হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে দরজা আটকে বলতাম, 'দাদু, আগা নাই। ' আমি এখনো এমনি করে তাঁকে আটকে রাখতে চাই, 'আগা নাই দাদু, আগা নাই'। সবকিছু, সব মানুষই তো বদলে গেছে।
অন্তত একজন মানুষ থাকুক যিনি পুরনোকে ধারণ করে আছেন সমস্ত অস্তিত্বে এবং সত্ত্বায়।
দাদুর বাড়িতে ফিরে আসার জন্য শেষ শেকড়টি থাকুক আমাদের..........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।