বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র স্রষ্টার নাম ফেদেরিকো ফেলিনি। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেন। চিত্রনাট্য রচনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমানভাবে সফল। সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানের প্রতি তিনি ছিলেন অধিক শ্রদ্ধাশীল। তাই প্রায় পঞ্চাশ বছরে তার নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা মাত্র চবি্বশটি।
খেয়ালি এই নির্মাতা চলচ্চিত্রের প্রথাগত পরিবেশনা, গঠনগত সংযম ও ধ্রুপদী সৌন্দর্যের স্টাইল থেকে বেরিয়ে এসে নব্য ও স্বকীয় একটি ধারায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, ফেলিনির চলচ্চিত্রগুলো তারই চেতনার বহিঃপ্রকাশ, যিনি তার পুরো জীবনটাই ক্যামেরার ফ্রেমে বেঁধে ফেলেছেন। ফেলিনি মনে করতেন, 'আমাদের স্বপ্নগুলোই আমাদের প্রকৃত জীবনকে প্রকাশ করে। আমার বাঁধনহারা কল্পনা আর আবিষ্টতা শুধু আমার জীবনেরই প্রধান অংশ নয়, বরং আমার চলচ্চিত্রেরও মূল উপাদান। '
ফেদেরিকো ফেলিনির জন্ম ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারি ইতালির রিমিনিতে।
বাবা উরবানো ফেলিনি পেশায় ছিলেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। মা ইদা বারবিয়ানি। ছেলেবেলা থেকেই ফেলিনি ছিলেন খেয়ালি আর ভাবুক প্রকৃতির। নিজের হাতে বানানো পুতুল দিয়েই তিনি পুতুলনাচ দেখাতেন। তার আরেকটি প্রিয় কাজ ছিল বাথরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজেকে দেখা।
এর প্রভাবেই কিনা একদিন সার্কাসে ঢুকে গেলেন। কিন্তু সেখান থেকে পালিয়ে যেতে খুব বেশিদিন লাগেনি। স্কুলে থাকাকালীন নিজ উদ্যোগে তিনি ক্যারিকেচার গল্প ও কার্টুনসহ পত্রিকা বের করেন। এক পর্যায়ে তিনি অভিনয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এক সময় তিনি রেডিও অনুষ্ঠান, সংবাদপত্রের জন্য প্রবন্ধ লেখার কাজ করতে লাগলেন।
মাঝে মাঝে তিনি ছবিও আঁকতেন, যেগুলো ছাপা হতো দৈনিক পত্রিকায়।
চলচ্চিত্র জগতে তার আবির্ভাব ঘটে ১৯৪৫ সালে। চলচ্চিত্রাঙ্গনে নিজের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে ফেলিনি বলেন, 'একটা অস্পষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত সময় থেকে মুক্ত করে রোসেলিনি আমাকে চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করালেন। তার 'ওপেন সিটি' চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখালেন আমাকে দিয়ে। '
চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও সমালোচকদের মতে, ফেলিনিকে বুঝতে হলে তার অন্যতম প্রধান সৃষ্টি 'এইট অ্যান্ড হাফ' দেখতে হবে।
ছবিটির নামকরণের ব্যাপারটিও বেশ মজার। এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের আগে ফেলিনি ৯টি চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন, যার মধ্যে একটি যৌথ পরিচালনায় নির্মিত। তাই ফেলিনি তার দশম চলচ্চিত্রটির নাম দিলেন 'এইট অ্যান্ড হাফ'। এই চলচ্চিত্রটি মূলত একজন চলচ্চিত্রকারের জীবন নিয়ে, যিনি একটি সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন কিন্তু চলচ্চিত্রের কাজটি শুরু করতে পারছেন না। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে ফেলিনির মতামত, 'এইট অ্যান্ড হাফ ছবিতে জীবনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার চেষ্টা আছে, তা হলো নিজের সঙ্গে মেকি ভদ্রতাহীন, সম্পূর্ণ নির্ভয়, দ্বিধাহীন ও নিঃস্বার্থ যোগসাধন।
নানা রকম বাঁধন থেকে প্রতিনিয়ত মুক্ত হতে চাওয়া, যেমনটি এই ছবির প্রধান চরিত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা গুইডো চাইছে। জি, আমিই সেই গুইডো। '
8½ (1963) ডাউনলোড লিংক
ফেদেরিকো ফেলিনি পরিচালিত চারটি ছবি অস্কার প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে। এগুলো হলো_ লা স্ট্রাডা [১৯৫৪], নাইটস অব ক্যাবিরিয়া [১৯৫৭], এইট অ্যান্ড হাফ [১৯৬৩] ও অ্যামারকর্ড [১৯৭৩]। তিনি সর্বমোট ১২ বার মনোনীত হয়ে ৪ বার অস্কার পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৯৩ সালের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তিনি আজীবন সম্মাননা পান। এ ছাড়া ১৯৬০ সালে ফেলিনির 'লা ডলচে ভিটা' চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম ডি অর জয় করে। ১৯৭৪ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ২৭তম আসরে ফেলিনি আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান।
ফেলিনি সম্পর্কে সুইডিশ কিংবদন্তি ইঙ্গমার বার্গম্যানের মন্তব্য, 'চলচ্চিত্র জগতের দরজা দিয়ে তো ভেতরে ঢুকতেই পারলাম না। ফেদেরিকো ফেলিনি আর আকিরা কুরুসাওয়া পেরেছেন।
আমি হতভাগা চিরকাল দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার এ প্রান্তেই। '
অন্যদিকে ফেলিনি নিজেকে পুরোদস্তুর চলচ্চিত্রকার মানতে একেবারেই নারাজ। চলচ্চিত্রকার হওয়ার ব্যাপারে তার নিজের মন্তব্য ছিল, 'চলচ্চিত্র আসলে আমার জন্য নয়। চলচ্চিত্রকার হওয়ার মতো মানসিক কোনো গুণই আমার মধ্যে বিদ্যমান নয়। আমার মধ্যে ধৈর্য ও মনোযোগের অভাব, অবিশ্রাম নিজেকে ক্ষয় করার মতো মানসিকতাও আমার নেই।
কিন্তু একজন ফিল্মমেকারকে হতে হবে জাহাজের নাবিকের মতো। কিন্তু আমি তা হতে পারিনি। আমি হলাম গিয়ে শিশুর মত খেয়ালি। '
১৯৯৩ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি মৃত্যুবরণ করেন।
(তথ্যসূত্র: আইএমডিবি, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট এবং দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)
(২৭ অক্টোবর ২০১১ দৈনিক সমকালের সাপ্তাহিক বিনোদন পাতা নন্দনে প্রকাশিত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।