গর্জে ওঠার এইতো সময়.... তিতাস বাচাও, দেশ বাচাও ১৭ বছর ৬ মাস ২ দিন আগের কথা। সেদিনটি ছিল ১৯৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল। স্কুল কলেজ লাইব্রেরি থেকে ‘ঘরে-বাইরে হুমায়ূন আহমেদ হাজার প্রশ্ন’ বইটি সংগ্রহ করি। বর্তমানের বিখ্যাত টিভি তারকা মাহফুজ আহমেদ গ্রন্থিত, মাওলা ব্রাদার্সের ৮৮ পৃষ্ঠার বইটি আমার সংগ্রহে হুমায়ূন আহমেদ এর প্রথম বই। তার আত্মজৈবনিক প্রায় সবগুলো বই আমার সংগ্রহে আছে।
সর্বশেষ, গত ৮ অক্টোবর ২০১১, হুমায়ূন আহমেদের ‘আমি’ শিরোনামের ৩১২ পৃষ্ঠার বৃহৎ বইটি আমার সংগ্রহে এলো। যার ব্যাক ইনার কভারে লেখক নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে পিতা-মাতার প্রসঙ্গে বলেছেনÑ “মা আয়েশা আক্তার। বাবা-মা দু’জনেই লেখালেখি করতেন। কিছুদিন আগে মা’র আত্মজৈবনিক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মোটামুটি হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন।
” খুব লোভ হলো বইটি সংগ্রহের জন্য। গত ১১ অক্টোবর, ২০১১ বইটির খোঁজে অভিযানে বের হলাম, কিন্তু পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে, সেদিনটি ছিল মঙ্গলবার আজিজ সুপার মার্কেট থেকে কাঁটাবন হয়ে নিউমার্কেটের সব বইয়ের দোকানের সাপ্তাহিক ছুটি। অবশেষে দেড় ঘণ্টার খোঁজাখুঁজির পর মিলল গুপ্তধন, “জীবন যে রকম” লেখিকা আয়েশা ফয়েজ (হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা আক্তার), সময় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। প্রথম প্রকাশ ২০০৮ সালের একুশে বই মেলায় আর আমার হাতে এপ্রিল ২০১১ এর দশম মুদ্রণ। মাত্র চার বছরে ১০টি মুদ্রণ (!) বিশাল হৈচৈ এর বিষয়ই বটে।
সফল পুত্র সফল মা।
বিলম্বে প্রকাশিত হলেও মূলত: আয়েশা ফয়েজ তার ৬১ বছর বয়েসে, ১৯৯১ সালে আমেরিকার নিউজার্সিতে তার ২য় ছেলে জাফর ইকবালের বাসায় বসে লিখে ফেলেন ১১২ পৃষ্ঠার আত্মজৈবনিক বই ‘জীবন যে রকম’। মাঝে ১০টি মুদ্রণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হয়ে এই বইটি এখন তার পরিবারের শুদ্ধতম ঐতিহাসিক দলিল।
এক বসায় পড়ে ফেলার মতো সে বইটিতে উঠে এসেছে তার পরিবার, সন্তান বিশেষ করে স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তার স্বামী ফয়েজুর রহমানের কথা বারবার। আরো এসেছে পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধ, তার স্বামীর শাহাদাত, তার সাক্ষী-প্রমাণ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের ভূমিকা ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে ধরা হলো।
“মে মাসের প্রথম দিকে পিরোজপুরে আলী হায়দার খান একটা ছোট কাগজ নিয়ে হাজির হলো। তাতে কাজলের (হুমায়ূন আহমেদের ডাক নাম) বাবা এক লাইন লিখেছে, আয়েশা, এই ছেলেটা যা বলবে তাই করবে। ... সে আমাদের সবাইকে নিয়ে বাবলা নামক এক গহীন গ্রামে মুবারক খান নামে একজন গ্রাম্য মাতবরের বাসায় পৌঁছে দিল। বিপদের সময় আমাদের সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসা এই তরুণ অ্যাডভোকেট আমাদের পরিবারের সাথে নানাভাবে জড়িত।
যুদ্ধের পর তার সাথে আমার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একদিন কাজলের বাবা বাবলায় আমাদের কাছে এসে হাজির হলো। ... ভোর দশটার দিকে একজন লোক একটা চিঠি নিয়ে এল। চিঠি লিখেছেন থানার ওসি তফাজ্জল হোসেন। তিনি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী থানা খালি না করে সেখানে রয়ে গেছেন, কোর্ট ইন্সপেক্টর আলাউদ্দিন এবং সিআই আব্দুল হালিম সাহেবও এসে গেছেন।
মিলিটারিরা এসেছে এবং কোনো সমস্যা হয়নি। ওসিও লিখেছেন কাজলের আব্বা যেন অবিলম্বে চলে আসেন। কারণ অন্য সবাইও চলে এসেছে কোনো রকম সমস্যা হবে না। ” (আয়েশা ফয়েজ,জীবন যে রকম,সময়,ঢাকা,২০১১,পৃ.৫৯)
“কাজলের আব্বা বললেন, যদি না যাই আমার নামে হুলিয়া দিয়ে ধরার জন্যে চলে আসবে। ছেলেমেয়ে সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে।
কোথায় পালাব আমরা এতগুলো মানুষ? আমাকে যেতে হবে। একটু পরে কাজলের আব্বা ইকবালকে ( ড. জাফর ইকবাল ) সাথে নিয়ে নৌকা করে রওনা হলো।
আমার আল্লাহর ওপর খুব বিশ্বাস। নফল নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি, আল্লাহ তাদের ওপর কোনো বিপদ নামতে পারে না। পরদিন বিকালে ইকবাল একা ফিরে এলো, খালি পা, গায়ে একটা ছেঁড়া শার্ট, পরনে লুঙ্গি।
গ্রামের মাঝ দিয়ে একজন মাঝিকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে, তাকে এভাবে দেখে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। নিঃশ্বাস আটকে জিজ্ঞাস করলাম, কী হয়েছে ইকবাল? ইকবাল একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আব্বা কালকে বিকালে মিটিংয়ে গিয়েছেন, আর ফিরে আসেননি। সবাই বলছে মিলিটারিরা মেরে ফেলছে। আমি আর নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম। ” (প্রাগুক্ত, পৃ.৬০)
“আমি থানায় ফোন করলাম, ফোন ধরল ওসি তফাজ্জল হোসেন।
আমার গলার স্বর শুনেই ফোনটা রেখে দিল। এর পর যতবার ফোন করি অন্য একজন ফোন ধরে বলে ওসি নেই। আমি তখন সিআই হালিম সাহেবকে চাইলাম, তিনিও নেই। অনেকবার চেষ্টা করে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে আমি থানায় আসছি, দেখি কে কে আছে। সাথে সাথে সিআই হালিম হালিম সাহেব ফোন করলেন, ভাবী আপনি কখন এলেন? বাচ্চারা কোথায়? আমি তাকে কাজলের আব্বার কথা জিজ্ঞেস করলাম, এসডিপিও সাহেব কোথায়? ঠিক করে বলেন তার কী হয়েছে? স্যার আছেন।
আর্মির ব্যাপার তো, তারা সাথে রেখেছে।
আমি শুনছি আপনি নতুন এসডিপিও হয়েছেন। ঠিক আছে, আমি মিলিটারির কর্নেল আতিক রশিদের সাথে দেখা করতে চাই, একটা ব্যবস্থা করেন। ... আমি তখন গেলাম প্রাক্তন মুসলিম লীগের মন্ত্রী, বর্তমানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আফজাল সাহেবের বাসায়। আমাদের বাসার সামনেই তার বাসা, বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন।
আমাকে দেখে একেবারে হকচকিয়ে গেলেন, আপনি? জি, আমি জানতে এসেছি এসডিপিও সাহেবের কী হয়েছে? ... কোথায় তো জানি না। তারপর বিরক্ত হয়ে বললেন,
দেশের সত্যি খবরটা তো রাখেন না, শুধু ইন্ডিয়ার রেডিও শোনেন! এখন আপনার বাচ্চাদের নিয়ে দেশে যান। আপনার বাবাকে আমি খবর দেই।
আমার বাবাকে আপনার খবর দিতে হবে না, তিনি নিজেই আসবেন। আপনার কাছে যেটা জানতে এসেছি সেটা বলেন, এসডিপিও সহেবকে কি মেরে ফেলেছে? তিনি বলেন, না মারেনি।
কাজলের আব্বাকে মে মাসের পাঁচ তারিখ বিকাল পাঁচটায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। সবাই সেটা জানত, আমাকে সামনাসামনি বলার কারো সাহস হয়নি। ” (প্রাগুক্ত, পৃ.৬১-৬৩)
“... মিলিটারি স্বদলবলে এসে আমার বাসা লুট করে নিল। আমার এতদিনের সংসার, কাজলের আব্বার শত শত বই, তার লেখা অপ্রকাশিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি, বাচ্চাদের ছেলেবেলার স্মৃতি সব কিছু তছনছ হয়ে গেল। ” ( প্রাগুক্ত,পৃ.৬৪)
“স্বাধীনতার পর ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে আমি ইকবাল, ছোট মেয়ে মনি আর সর্বকর্মা বাক্যবাগীশ আমানুল্লাহকে নিয়ে পিরোজপুর রওনা দিলাম।
ততদিন আমি মোটামুটি স্বীকার করে নিয়েছি যে কাজলের বাবা নেই। ...আমি ডাক্তার (সিরাজুল হক) সাহেবের বাসায় উঠেছি। নির্জন নদীর তীরে যেখানে কাজলের বাবাকে কবর দেয়া হয়েছে সেখান থেকে তুলে আমি দেশে নিয়ে যেতে চাই, সেটাও সবাইকে বললাম। স্থানীয় লোকজন আছে, মুক্তিযোদ্ধারা আছে সবাই বলল, স্যার আমাদের এখানকার প্রথম শহীদ, তাকে নেবেন না, এখানকার মাটিতেই রেখে যান। ইকবালও বলল...নির্জন নদীর তীর থেকে তুলে এনে এখানকার কবরস্থানে কবর দিয়ে দিই।
আমি রাজি হলাম। সবাই মিলে তখন আরেকটি প্রস্তাব দিল। এ দেশে পাকিস্তানি মিলিটারিরা লাখ লাখ মানুষ মেরেছে, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা যায় সে রকম সাক্ষী প্রমাণ কারো বিরুদ্ধে নেই। কাজলের বাবার হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী প্রমাণ রয়েছে, কে মেরেছে, কারা মেরেছে, কীভাবে মেরেছে তাও জানা আছে। শুধু তাই নয়, সে অত্যন্ত অল্প কিছু সৌভাগ্যবানের একজন যার মৃতদেহ শকুনি গৃধিনী ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়নি, যাকে মানুষেরা তুলে এনে দাফন করেছে।
তার দেহাবশেষ বের করে ময়নাতদন্ত করা যাবে এবং হত্যাকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ খুনের মামলা দাঁড় করানো যাবে। খুনি আসামির প্রধান নায়ক ব্রিগেডিয়ার আতিক রশীদ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ধরা পড়েছে। এখন যুদ্ধবন্দী হিসেবে আছে, সাধারণ যুদ্ধবন্দিরা মুক্তি পেয়ে শেষ পর্যন্ত দেশে যেতে পারে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাকে বিচার করা হত্যাকারীর শাস্তি দেয়া যাবে।
সবাই মিলে আমরা নদী তীরে এক নির্জন জায়গায় হাজির হলাম। ইকবাল আমাকে দূরে বসিয়ে দিয়ে গেল।
সে নিজেই আমানুল্লাহকে নিয়ে তার বাবার কবর খুঁড়ে দেহাবশেষ বের করেছিল। এই দীর্ঘদিন পরেও তার বাবার পায়ে নাকি ছিল একজোড়া নাইলনের মোজা। ডাক্তার সাহেব ছিলেন, তিনি ময়নাতদন্ত করলেন। বেশ কয়েকটি গুলি লেগেছিল, একটি পায়ে, একটি বুকে, একটি মাথায়। যেটি মাথায় লেগেছিল সেটিই সম্ভবত তার প্রাণ নিয়েছে।
তাকে তার ছেলে আবার যতœ করে কফিনে তুলে দিল। তারপর আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো। ”(প্রাগুক্ত, পৃ.৭৮-৮০)
“যখন কফিনটা আনা হয়েছে ঠিক তখন আফজাল সাহেবকেও গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয়েছে, আমি তার কাছে একদিন কাজলের বাবার কথা জানতে চেয়েছিলাম, উত্তর না দিয়ে দেশ সম্পর্কে আমাকে জ্ঞানদান করেছিলেন। আমাকে দেখে তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, চিনতে পারলেন সে রকম ভাব করলেন না। পরদিন কাজলের বাবার জানাজা হলো, হাজার হাজার মানুষ এসে সেই জানাজায় যোগ দিল।
জানাজার পর কাফনের কাপড়ে জড়ানো তার দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়া হলো কবরস্থানে। কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। ইকবাল হাতে ধরে শুইয়ে দিল তাকে কবরে। ” (প্রাগুক্ত, পৃ.৮১)
“অনেক যতœ করে খুনের কেসটা দাঁড় করানো হয়েছিল। যারা দেখেছে তাদের সাক্ষী প্রমাণ।
যারা কবর দিয়েছে তাদের সাক্ষী প্রমাণ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সবকিছু। প্রধান আসামি ব্রিগেডিয়ার আতিক রশীদ। সাথে মেজর এজাজ। দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি করে সেই কেস ফাইল করা হলো।
...কিন্তু সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হলো না। এ দেশের ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানের নব্বই হাজার সৈন্য সসম্মানে তাদের দেশে ফিরে গেল। এ দেশের সরকার একটি বার তার বিচারের কথা উচ্চারণ পর্যন্ত করল না। ত্রিশ লাখ প্রাণের প্রতি অবমাননা এর থেকে বড় উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও নেই। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আমি কখনো সে জন্যে ক্ষমা করিনি।
এরপর প্রত্যেকবার নতুন সরকার আসার পর আমি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আবেদন করে বলেছি, ... কোনো লাভ হয়নি। ... আমার বক্তব্য অত্যন্ত সরল, আমি বাহাত্তর সালে একটি হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে পিরোজপুর থানায় কেস ফাইল করেছি, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমি সেই বিচার আশা করতে পারি। এ দেশের কোর্টে হত্যাকারীর বিচার করা হোক। পাকিস্তান সরকারের কাছে সেই হত্যাকারীকে ফেরত চাওয়া হোক। ” (প্রাগুক্ত,পৃ.৮৩-৮৪)
ছয় সন্তান নিয়ে বিধবা সেই মহিলা স্বামী হত্যার বিচার তো পাননি বরং স্বাধীন দেশে শহীদ পরিবার হয়েও চরম জিল্লতির শিকার হয়ে ছিলেন পাঠকদের জন্য লজ্জাজনক সেই বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
“একজন সুবেদার মেজর (রক্ষীবাহিনীর) এসে জিজ্ঞেস করল, এ বাড়ি আপনি কোথা থেকে পেলেন? আমি বললাম, সরকার আমাকে দিয়েছে। আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তাই। সুবেদার মেজর কিছু না বলে চলে গেল। আমার মনের ভেতর হঠাৎ করে একটা খটকা লেগে গেল, হঠাৎ করে রক্ষী বাহিনী আসছে কেন? খানিকক্ষণ পর হঠাৎ করে আরেকজন সুবেদার মেজর হাজির। সে একা নয়, তার সাথে এক ট্রাক বোঝাই রক্ষীবাহিনী।
সবার হাতে অস্ত্র। সুবেদার মেজরের নাম হাফিজ, ভেতরে ঢুকে বলল, এই বাড়ি আমার। শেখ সাহেব আমাকে দিয়েছেন।
আমি বললাম, সে কি করে হয়? আমার কাছে বাসার অ্যালটম্যান্ট রয়েছে- সে কোনো কথা না বলে টান দিয়ে ঘরের একটা পর্দা ছিড়ে ফেলল। সাথে আসা রক্ষীবাহিনীর দলকে বলল, ছেলেমেয়েদের ঘার ধরে বের কর।
আমি এতদিনে পোড় খাওয়া পাথর হয়ে গেছি। রুখে দাঁড়িয়ে বলেছি, দেখি
তোর কত বড় সাহস। ...কাজল মুহসীন হলে ছিল, খোঁজ পেয়ে এসেছে,তাকেও ঢুকতে দিলো না। সারা রাত এভাবে কেটেছে। ভোর হতেই আমি বের হলাম।
পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলাম। তারা বললো, আমরা গোলামীর পোশাক পড়ে বসে আছি! রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কি করব?
বঙ্গভবন , গণভবন এমন কোনো জায়গা আমি বাকি রাখলাম না সাহায্যের জন্য। কিন্তু লাভ হলো না। আমি তুচ্ছ মানুষ, আমার জন্যে কার এত মাথাব্যথা। রাতে ফিরে এসেছি।
আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না, অনেক বলে ভেতরে ঢুকেছি। রাত আটটার সময় রক্ষীবাহিনীর দল হঠাৎ করে লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল। ইকবাল আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে, একজন বেয়োনেট উঁচিয়ে লাফিয়ে এলো। রাইফেল তুলে ট্রিগারে হাত দিয়েছে, চিৎকার করে কিছু একটা বলছে, গুলি মেরে ফেলবে আমাদের? আমি ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বের হয়ে এলাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাকে প্রথমবার গৃহহারা করেছিল।
বাংলাদেশ সরকারের রক্ষীবাহিনী আমাকে গৃহহারা করল। (প্রাগুক্ত, পৃ.৯২-৯৩)
ফিরে আসি ‘ঘরে-বাইরে হুমায়ূন আহমেদ হাজার প্রশ্ন’ বইটি প্রসঙ্গে। ১৯৯৪ সালে গ্রন্থিত বইটিতে তখনকার ৪৬ বৎসরের পরিণত বয়সী হুমায়ূন আহমেদ সাক্ষাৎকারধর্মী সে বইটিতে অনেক খোলামেলা ও সাহসী কথা বলেছেন মাহফুজ আহমেদ যেটি তার মুখবন্ধে উল্লেখও করেছেন “অবলীলায় তিনি বলেন, খালেদা-হাসিনা কেউই দেশ পরিচালনার জন্যে যোগ্য নেত্রী নন। ”
‘সমাজ ও রাজনীতি’ অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকার বিষয়ক একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধেও সময় যারা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেছেন তাদের মধ্যে আমার নানাও একজন, যিনি মুক্তিযুদ্ধাদের হাতে মারা গেছেন। আমার এই নানার মতো, মামার মতো ভদ্রলোক, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এত পরিপূর্ণ ভদ্রলোক এই জীবনে দেখিনি।
আমার নানা একটি আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছেন। একটি পূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। কারণ বড় হওয়ার সময় এই অঞ্চলের হিন্দুদের দ্বারা প্রচণ্ড নির্যাতিত হয়েছিলেন। কোনো মিষ্টির
দোকানে গেলে তাদের প্লেটে করে মিষ্টি দেয়া হতো না। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
তাদের হাতে দেয়া হতো। এটা শুধু মুসলমানদের সঙ্গেই না, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গেও করতো। এটা ছিল হিন্দুদের কাস সিস্টেম। এসব দেখে দেখে সে সময়ের মুসলমানরা বড় হয়েছেন এবং তাদের মনে হয়েছে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রয়োজন। অনেক যুদ্ধের পর তারা তা পেয়েছেন।
যখন তারা দেখলেন চোখের সামনে দিয়ে সেই রাষ্ট্র ভেঙে যাচ্ছে, তখন তারা মনে করেছেন আবার হিন্দু রাজত্ব শুরু হয়ে যাবে। তখন পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা শুরু করেন। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির অন্যায়গুলো ক্রমেই চোখে পড়তে থাকে। তারা দেখলেন পাকিস্তানি আর্মিরা তো কেবল হিন্দু মারছে না, সমানে মুসলমানদেরও খুন করছে। আমার নানা দেখলেন , তার অতি আদরের বড় মেয়ের পুলিশ অফিসার স্বামীকে (আমার বাবা) বেধে নিয়ে আর্মিরা গুলি করে মেরে মেরে ফেলল।
তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। কি হচ্ছে এসব? কোনদিকে যাবেন? তিনি কি পাকিস্তান আর্মির সঙ্গেই থাকবেন , নাকি কমন যে স্রোত আছে তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন? এই নিয়ে কনফিউশন তৈরি হলো তার মধ্যে। তিনি এই কনফিউশন দূর করতে পারলেন না। এক্ষেত্রে তার যেমন দোষ ছিল, আমাদেরও ছিল। কারণ আমরা তাদের বোঝাতে পারিনি।
কনফিউশন দূর করাতে পারিনি। তিনি মারা গেলেন মুক্তিযুদ্ধাদের হাতে। এখন আমরা তাকে ক্ষমা করব কি করব না সেই প্রশ্ন। শেখ মুজিব সাহেব তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমি ক্ষমার পক্ষপাতি।
”(মাহফুজ আহমেদ, ঘরে-বাইরে হুমায়ূন আহমেদ হাজার প্রশ্ন, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৪. পৃ.৩১-৩২)
৮১ বছরের মা আয়েশা ফয়েজ তার অনবদ্য বই ‘জীবন যে রকম’ এবং তার সুযোগ্য সন্তান ৬৩ বছরের হুমায়ূন আহমেদ ৫৯ বছরের ড. জাফর ইকবাল এবং আহসান হাবীব সম্মিলিতভাবে শতশত বই লেখেছেন। এর ভিতর তাদের আত্মজৈবনিক বইসমূহে উঠে এসেছে তাদের পরিবার প্রধান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমানের কাহিনী।
এ শহীদ পরিবার ১৯৭২ সালে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে পিরোজপুর থানায় কেস ফাইল করেছিল। এর সাথে আছে যারা কবর দিয়েছে তাদের সাক্ষী প্রমাণ। ময়নাতদন্তের বিস্তারিত রিপোর্ট।
দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি
করে সেই কেস ফাইল করা হয়। এতে প্রধান আসামি ব্রিগেডিয়ার আতিক রশীদ। সাথে মেজর এজাজ। আয়েশা ফয়েজের লেখায় বাংলাদেশি হিসেবে প্রাক্তন মুসলিম লীগের মন্ত্রী, সে সময়কার পিরোজপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আফজাল সাহেব (হুমায়ুন আহমেদেও নানার বন্ধু) এবং থানার ওসিসহ কিছু কর্মকর্তার পরোক্ষ সম্পৃক্ততা সন্দেহ করা হয়েছে। মূলত. খুনিরা সবাই পাকিস্তান আর্মির পদস্থ কর্মকর্তা।
৮১ বছরের বৃদ্ধা আয়েশা ফয়েজ যিনি ৪০ বছর যাবত এই কষ্টের গ্লানি নিয়ে ঘুরছেন তিনি বলেন “ আমার বক্তব্য অত্যন্ত সরল, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমি সেই বিচার আশা করতে পারি। এ দেশের কোর্টে হত্যাকারীর বিচার করা হোক। পাকিস্তান সরকারের কাছে সেই হত্যাকারীকে ফেরত চাওয়া হোক। “
বঙ্গবন্ধুর পলাতক হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বিশ্বের দিকে দিকে অভিযান চালানো হচ্ছে । অথচ এ প্রসঙ্গে আমরা অনেক বাগাড়াম্বর বক্তব্য শুনছি কিন্তু এখনও সেই পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে এনে বিচারের কোনো প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ঘটনার ৪০ বছর পর ৩৯ বছর আগের কেইস ফাইল করা বিষয়টি নিয়ে তার পরিবার এবং সংগ্রামী জনগণ কোন ঘোরপ্যাচ নয়, সত্যিকার বিচারই আশা করে। (কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি নয় বরং সত্যিকার দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার আশা করে)
মরহুম ফয়জুর রহমানের বিদেহী আত্মার কথা চিন্তা করে তার পরিবার, আমরা জনগণ,আমরা শাসক, আমরা আইনজীবী, আমরা বিচারক, আমরা লেখক, আমরা বুদ্ধিজীবী সবাই কী আন্তরিকভাবে সঠিক কাজটি করতে পারি না । নচেৎ আখেরাতে তিনি আমাদের কাউকে ক্ষমা করবেন না । আর আল্লাহ পাকতো বলেছেন “এটি সেই দিন (হাশর ), সেদিন কেউ কারো জন্য কিছু করতে পারবে না এবং ফয়সালার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে থাকবে। সূরা ইরফিতার-১৯।
(এটি একটি কপি-পেষ্ট পোষ্ট)
লেখক-
ড. আহসান হাবীব ইমরোজ
চেয়্যারম্যান
গ্লোবাল লাইট হাউজ ফাউন্ডেশন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।