আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাদল ' ১৯৭১

জীবন কবিতার মত। আর কবিতাগুলো দুর্বোধ্য। বাদল সারাটাদিন এদিক সেদিক উদভ্রান্তের মত ঘোরাঘুরি করে। ওর বয়স বেশি না। দশ বা বার।

কিন্তু আজকাল ওর নিজেকে কেমন যেন অনেক দায়িত্বশীল বলে মনে হয়। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে বয়স বেড়ে গেছে। অল্প কয়েকটা দিনের মধ্যে এ গ্রামে অনেক কিছু ঘটে গেছে। মাঝে মাঝে গ্রামে মিলিটারী হানা দিচ্ছে। পরিচিত একে ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

কাউকে মেরে ফেলছে, কাউকে ল্যাংড়া করে ছেড়ে দিচ্ছে। গ্রামের যুবকেরা, মধ্যবয়স্করা সব পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়েরা গ্রাম থেকে পালিয়ে আরো গ্রামের দিকে চলে গেছে। শুধু পড়ে আছে বুড়ো বুড়ির দল আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ কেউ অবশ্য সাহস করে থেকে গেছে।

বাদলেরাও সাহস করে থেকে গেছে। বাদলের বাবা বৈরাগী মানুষ। কেউ পালিয়ে যাওয়ার কথা বললে বাদলের বাবা ভাবের কথা বলে। স্ত্রী পুত্রের নিরাপত্তা সে মুর্শিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বাদল এখন যাচ্ছে তিন গ্রাম পরের গ্রাম, ইন্দ্রুকুলে কামালকে খুঁজতে।

কেউ তাকে খুঁজতে পাঠায় নি। সেই নিজ দায়িত্বে খুঁজতে যাচ্ছে। অবশ্য কেউ কামালের কোন খোঁজ খবর জানেও না। ইন্দ্রুকুল গেলে যে কামালকে পাওয়া যাবে এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই। তবু একবার চেষ্টা করে দেখা।

শেষবারের মত যদি চোখের দেখাটা অন্তত হয়। গত রাতে কামালের মা মারা গেছে। হঠাৎ বুকের বেদনা। কামাল একজন গেড়িলা। ইন্দ্রুকুলে তার বন্ধুরা থাকে।

যদি কারো কাছে খোঁজ পাওয়া যায়, কোথায় আছে কামাল। মাথার উপর তপ্ত রোদ। কাদার রাস্তায় ঠিকমত হাঁটা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বাদল এগিয়ে যাচ্ছে। দৌড় আর হাঁটার মাঝামাঝি অবস্থা।

বিকেলের মধ্যে ফিরতে হবে। সন্ধায় বাদ মাগরিব কামালের মায়ের দাফন। বাদলের হাঁটার তালে তালে ঝনঝন করে কোমড়ে কালো সুতোর সাথে বাঁধা চাবির গোছাগুলো বাজছে। বাড়ির যুবতি ও মধ্যবয়সী মেয়েদের বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখতে হচ্ছে। কখন শুয়োরের বাচ্চা মিলিটারীরা হানা দেয়, কে জানে।

আর একটু আগে রওয়ানা দিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু দেওয়া সম্ভব হয় নি। সকালে বাদলেরা কয়েকজন মিলে সাইলোতে ঘাস কাটতে গেছে। সাইলোতে মিলিটারীরা ক্যাম্প বসিয়েছে। ছোটছোট পোলাপান দিয়ে ওরা নানারকম কাজকর্ম করায়।

কাপড়চোপড় ধোঁয়ায়, থালাবাসন মাজায়, হাত-পা টিপায়। বিশাল দেহী এক সিপাহী অনেকক্ষন ধরে ওকে দিয়ে হাত পা টিপিয়েছে। এতে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। হাত পা টিপিয়ে বাদলকে সিপাহীটা কয়েকটা বিস্কুট খেতে দিয়েছে। বাদল খায়নি, ফেলে দিয়েছে।

মিলিটারীর হাত পা টিপার পরে গা ঘিন ঘিন করছে । বাড়ি ফিরে বাদল অনেকক্ষন সময় নিয়ে পুকুরে গোসল করেছে। তবু ঘিন্না লাগছে। কিছু না খেয়েই সে ই›দ্রুকুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। ইদ্রুকুল পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে।

শরীরে তেমন বল পাচ্ছে না বাদল। তবে কামালের খোঁজ পাওয়া গেছে। কামাল আছে তার বন্ধু নাসিরের বাড়ি। বাদলকে বারান্দায় একটা চৌকিতে বসতে দেয়া হয়েছে। কামাল ঘুমাচ্ছে।

গত দুদিন সে অন্য কোথাও ছিল। শেষ রাতে ফিরেছে। সাথে আরো পনের ষোলজনের দল। সবাই ঘুমাচ্ছে। দুই একজন ভীষণ নাক ডাকছে।

নাসিরের দাদী বাদলকে বড় কাঁসার গ্লাস ভর্তি করে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দিয়েছে। বাদল খালি পেটে ঢকঢক করে শরবতটা খেল। কেউ কামালের ঘুম ভাঙাচ্ছে না। ওর অনেক ঘুমের দরকার। কামাল বাদলের সাত আট বছরের বড়।

অথচ কামালকে বাদল তুই তুই করে, নাম ধরে ডাকে। পুরানো অভ্যাস, ছাড়তে পারছে না। কামালের হাতে এর জন্য মাইরও খেতে হয়েছে অনেক। তবু বাদলের অভ্যাস বদলায় না। অভ্যাস বদলাতে লজ্জ্বা লাগে।

মাগরিবের আজানের সময় বাদলের ঘুম ভাঙানো হল। অন্যরা তখনও ঘুমাচ্ছে। কামালের ঘুম যেন ভাঙতে চায়না। নাসির বলল, ওঠ জরুরী কাজ আছে তোর সাথে। এক জায়গায় যেতে হবে।

কামালকে এক প্লেট গরম খিঁচুরি খেতে দেয়া হয়েছে। বাদলের পেটেও দারুন ক্ষুধা তবু বলার উপায় নেই। কামাল তখনও বাদলের দেখা পায় নি। খাওয়া শেষে নাসির কামালকে বলল, তুই একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। বাদল এসেছে।

তোর মায়ের খুব অসুখ। কামালের মায়ের খুব অসুখ এটা কোন নতুন ঘটনা না। বাদলকে দেখে সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেছে। অন্ধকার পথ ধরে কামাল আর বাদল দৌঁড়াচ্ছে। কামালের চেহারা দাড়িমোজে বীভৎস হয়ে গেছে।

এ যেন সেই আগের কামাল না ,অন্য কেউ । মাঝে মাঝে কামাল ডুকরে কেঁদে উঠছে। বাদলেরও খুব কান্না আসছে। আজ কামালকে খুব ভাইয়া বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে। ভাইয়াকে কী বলবে বাদল, তার মাথায় কিছু আসছে না।

বাদল কাঁদতে কাঁদতে কামালের পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। কামালের মায়ের জানাযা হয়ে গেছে। কামাল মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদল। বাদলের বাড়ি যাওয়া দরকার তার কাছে ঘরের চাবি। বাড়িতে সবাই বন্দী হয়ে আছে।

কিন্তু তার পা নড়ছে না। সবাই ধরাধরি করে লাশ তুলল। অনেক দেরী হয়ে গেছে। দাফন শেষ হতে না হতেই তিন চারটি জীপে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জনের একটি মিলিটরী দল গ্রামে ঢুকেছে। গোলগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সবাই দিগি¦দিক দৌড়াচ্ছে। কামাল তার মায়ের কবরের পাশে নিথর বসে আছে। বাদল দৌড় শুরু করল। বাতাসের আগে যাওয়া দরকার। গেরিলাদের খবর দিতে হবে।

যদি গ্রামটা বাঁচানো যায়। নিস্তব্ধ রাত। মিলিটারীর ভয়ে একটা ঝিঁঝিঁ পোকাও ডাকছে না। শুধু মাঝে মাঝে বাদলের কোমড়ে কালো সুতোয় বাঁধা চাবির গোছাটা ঝনঝন করে বাজছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।