আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাদল বরিষণে

অন্ধ বিশ্বাস নয় বরং যুক্তিতে বিশ্বস্ত মেঘেরো হিন্দোলা, দেয় পুব হাওয়াতে দোলা; দে দুলবি এই দোলায়, আয় আয় ওরে কাজ ভোলা....। সকাল থেকেই নজরুলের বর্ষা নিয়ে এই গানটি গুনগুন করছিলাম। গত দু’দিন থেকে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে পিঠের ব্যাথা ধরে গেছে। নতুন কোন বই নেই বিধায় পুরাতন সংগ্রহ গুলো আরেকবার নতুন করে পড়ার চেষ্টা করছিলাম।

কিন্তু সম্যসা হল এই বইগুলো অসংখ্যবার পড়েছি। ছয় ঋতুতে ছয় রকম স্বাধ গ্রহণ করেছি। তাই আর ভাললাগছিল না। কিন্তু কোন উপায় নেই বিধায় পড়তেই হচ্ছিল। আর ভাল লাগছে না।

বর্ষাতিটা গায়ে চাপিয়ে বাড়ীর সবার অলক্ষেই বেড়িয়ে পড়লাম। সবার অলক্ষে বের হবার অবশ্য কারণও আছে। ক’দিন আগে বিকেল বেলায় গাছের নিচে বসে বই পড়ছিলাম। হঠাৎ করে ঝুম ঝুম বৃষ্টি। বেশ আনন্দ হচ্ছিল বৃষ্টি দেখে।

একবার চিন্তা করলাম বৃষ্টিতে একটু দৌড় ঝাপ করি। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম গাছের পাতা গলে বৃষ্টি আমায় স্পর্শ করেছে। নাহ, সবসময়তো দৌড় ঝাপ করেই ভিজেছি। তাই আজ গাছের ঝরা পানিতেই ভিজব। তারপর প্রায় একঘন্টা গাছের নিচে চেয়ারে বসে বসে ভিজলাম এবং রাতে জ্বরে শয্যাশায়ী।

ভাগনী অবশ্য বলেছিল, গাছের ময়লা-নোংরা পানিগুলোতে নাকি গোসল করেছি। আমি ভাবলাম ক্ষতি কোথায়? গাছতো আমাদের রক্ষা করতেই প্রকৃতির অসংখ্য ধুলো-বালি নিজের শরীরে জড়িয়ে নেয়। আমি না হয় গাছ থেকে একটু ধুলো-বালি মেশানো জল নিয়ে তাকে কিছুটা হালকা করলাম। নদীর পথ ধরলাম। বৃষ্টি হচ্ছেই।

কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে বৃষ্টির জলে গা ভিজিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। নিঁচু জমিগুলোতে জল স্থায়ী ভাবে আসন পেতেছে। বুঝতে বাকী রইল না যে নদী এখন কিনারাহীণ। মেঠো পথ ধরে নদীর ধারে পৌঁছে গেলাম। সত্যিই নদী ফুলে ফেপে প্রখর তেজে ছুটে চলছে সাগরের পানে।

বেশ কয়েকজন তরুণ-সাহসী ছেলেকে দেখলাম সাঁতরে নদী পার হবার নেশায় মগ্ন। এই স্রোতে নদী পারি দেওয়া অনেকটা ভয়াংকর ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তবে তারুণ্যের কাছে সব ভীতি-সংশয় হার মানে। তরুণরাই সবচেয়ে ভয়াংকর। কচুরী পানা ভেসে আসছে ঝাকে ঝাকে।

হটাৎ দেখতে পেলাম ফুটবলের মত গোল পিঁপড়ের দল ভাসছে স্রোতে। একজন অন্যজনকে জড়িয়ে স্রোতে ভেসে ভেসে নতুন কিনারের আশায় কিংবা নতুন করে বাঁচার বৃথা স্বপ্ন দেখছে। প্রতিনিয়ত দু’চারটি স্রোতের টানে হাঁরিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। এভাবেই ভাসতে ভাসতে সবাই একসময় হারিয়ে যাবে কালের মহা স্রোতে। সাঁকো দিয়ে নদীর ওপারে চলে গেলাম।

মেঠো পথ, বৃষ্টি বিধায় লোকজনের চলাচলও কম। শুধু বৃষ্টির শব্দ। সেঁজুতি থাকলে ভাললাগত। অবশ্য তখন বর্ষাতিটা শরীরে রাখতে দিত না। বৃষ্টির জল হাতে জমিয়ে আমায় ছুড়ে মারত আর হাসত।

ওর হাসিটা আর বৃষ্টি কিংবা বৃষ্টির শব্দের একটা গভীর মিল আঝে। দু’টোরই একটা ছন্দ, একটা মাধুর্যতা আছে। মন চাইল বর্ষাতিটা খুলে সেঁজুতির স্মরণে একটু ভিজি। কিন্তু হল না। ওর সাথে থাকলে বৃষ্টি থেমে গেলেও মনে হত বৃষ্টি হচ্ছেই।

বৃষ্টির সময় ঘাসে শুয়ে থাকতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। সেজুঁতির চুল বেয়ে টপটপ করে জল আমার মুখে পড়ত। মনে হত বৃষ্টি চলছে অবিরত। ‘‘রুদ্রের আজ হল ফাঁসি মেঘ বালিকার আঁচলে আকাশের সূর্য রশ্মি আজ নীপবনের শাখা জুড়ে। ’’ রাস্তার মোড়ের ছোট্ট একটা দোকান।

এক বৃদ্ধ দোকানদার বসে বসে বিড়ি টানছে। চেহারাই বলে দিচ্ছে আজ বিক্রি ভাল না। দোকানের ঝাপের নিচে দাঁড়িয়ে চা চাইলাম। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল ‘‘শুধুই চা?’’। দেখলাম প্লাষ্টিকের কৌটায় বেশ স্বাস্থ্যবান টোষ্ট বিস্কুট।

নিজ হাতে একটা বের করে নিলাম। বেচারা মনে হয় খুশিই জল। গরম চা দিয়ে বিস্কুট খেতে মন্দ লাগছিল না। বাড়ীর কথা মনে পড়ে গেল। নিশ্চই বাড়ীতে এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে আমার অনুপস্থিতি।

পকেটে সিগারেট থাকা সত্বেও বৃদ্ধকে আর একটু খুশি করতে সিগারেট চাইলাম। সিগারেট জ্বালিয়ে জিজ্ঞাস করলাম ‘‘চাচা কি অবস্থা?’’; ফুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ‘‘এই রকম বৃষ্টি হলে কি রকম অবস্থা হয়?’’- অনেকটা ব্যঙ্গাত্বক স্বরে বলল। উত্তর শুনে নিজেকে খুব বোকা বোকা মনে হচ্ছিল। অগ্যতা উঠে হাটতে শুরু করলাম। এপাশটা খুব নিঁচু অঞ্চল।

বেশ পানি জমে আছে। কারো কারো ঘর পর্যন্ত পানি। দু’একজনকে দেখলাম কোঁদাল দিয়ে আল কেটে পানি নদীমুখী করার অপচেষ্টা করছে। আবার অনেকে বাঁশের তৈরী মাছ ধরার সারঞ্জাম (যাকে স্থানীয় ভাষায় ট্যাপাই বলে) নিয়ে ছুটছে মাছ ধরার নেশায়। সব শখের জেলে বলা যেতে পারে।

প্রকৃতি আমার বরাবরই প্রিয়। কিন্তু আজ স্নান করা সবুজ-নির্মল প্রকৃতিটা ভয়াংকর সুন্দর লাগছে। মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ গুলোর পাতা গলে ফোটা ফোটা জল শরীরে গড়িয়ে পড়ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল সেজুঁতির চুল বেয়ে জল পড়ছে। সেজুঁতিই যেন প্রকৃতি।

অনেকে বাড়ীর ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে এই অদ্বুত পোশাক (বর্ষাতি) পরিহিত আমায় দেখছে। দেখেই আবার পরক্ষণেই অদৃশ্য। বেশ ভালই লাগছিল মেঘেরও হিন্দোলায় দুলতে। রাস্তার পাশের একটা বাড়ীতে মানুষের জটলা দেখে উৎসুখ হয়ে জল ডিঙ্গিয়ে এগুতে লাগলাম। কাছে যেতেই ক্রন্দনের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম কেউ হয়ত মরে গেছে।

মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। বর্ষার মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে পরিবারের মানুষজনের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। কারণ সৎকার করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। কবর খুড়লে পানি জমে। একটু বিত্তবানেরা অবশ্য কাঠ দিয়ে কফিন তৈরী করে।

গরীবেরা পানির সাথে কুলাতে না পেরে ঐ অবস্থায় লাসকে কবর দিয়ে চলে আসে। মেঠো পথ ধরে আরো কিছুটা এগিয়ে গেলাম। এখানে এসে রাস্তাটা দু’দিকে চলে গেছে। নিজের অজান্তেই সেজুঁতিদের বাড়ীর পথের পথিক হলাম। একটা গান মনে এল- এ পথে যখনি যাবে, বার এক দাঁড়ায়ো ফুল বনে শুধু দু’হাত ভরিয়া দেব ফুল, দেব ফুল।

এই বাদলের দিনে ফুল না পেলেও সেজুঁতির সম্মোহণ হাসিটা হয়ত দেখতে পাব। এপাশটা আরও নিঁচু। পথের মাঝে যদি সেজুঁতিকে পেতাম, যদি দেখতাম সেও আমার মত বৃষ্টি উপভোগ করছে! আমাদের পুরুষ শাষিত সমাজ ব্যবস্থা হয়ত সেটা সুন্দর দৃষ্টিতে মেনে নেবে না। আর গ্রামের ব্যপারটাতো আরও আদি। ইতিহাসে পড়েছিলাম পরিবারতন্ত্র শুরুর প্রাথমিক অবস্থায় একটা নারী কয়েকজন স্বামী গ্রহণ করে একত্রে বসবাস করত।

তখন সন্তান হলে মায়ের পরিচয়ে বড় হত। কারণ বাবা নির্ধারণ করাটা সম্ভব ছিলনা। মূলত সে সময় নারীরাই ছিল সমাজের সব কিছু। তো তখন পুরুষরা সমাজে অবাধ বিচরণ করতে পারত কিনা কে জানে। বৃষ্টির থামার মনে হয় কোন ইচ্ছা নেই।

‘‘গগনে স্বঘন চমকিছে গামীনি; মেঘ ঘন রস রিমিঝিমি বরিষে...... সেজুঁতিদের বাড়ী পেরিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেলাম। এ পার্শ্বে যত এগুচ্ছি ততই নিচুঁ জমি। ভাগ্যিস রাস্তাটা বেশ উঁচু বিধায় ততটা সমস্যায় পড়ছি না। তবুও হাটু পর্যন্ত জল। বাড়ী ঘর গুলোর অবস্থা করুণ।

প্রত্যেকটা বাড়ীর প্রায় অর্ধেক জলে নিমজ্জিত। একটা কাক হেলে যাওয়া কলাগাছের উপর বসে অবিরাম গর্জন করে চলেছে। অধিক বর্ষনের ফলে বেচারা কাকেরও যে ভাল যাচ্ছে না বোঝাই যাচ্ছে। সামনের একটা বাড়ী চোখে পড়ল। দু’টো কুড়ে ঘর বাঁশের বেড়া দেওয়া।

ঘরের টিনগুলোর মনে হয় আকাশের সাথে গভীর বন্ধুত্ব। জল পড়া শুরম্ন হলে থামবে না। একটা শিশুর কান্নার শব্দে এগিয়ে গেলাম। জল হাটুর উপরে উঠল। জলে সব একাকার বিধায় উঠোন বলাটা হয়ত ভূল হবে তবুও এক সময়ের উঠোনে দাঁড়ালাম।

দরজা খোলা। ঘরে অন্ধকার। তবুও বুঝতে পারলাম ঘরে যদি বিছানা বা চৌকি বলে কিছু থেকে থাকে তবে সেটাও জল ছুঁই ছুঁই। একটা মহিলা জলের তলে নিমজ্জিত রান্নাঘরের মাচার উপর। ছোট্ট একটা মেয়ে পাশে।

একজন আগন্তুককে দেখে ছো্ট মেয়েটাও চুপ করেছে। যদিও তার ছল ছল চোখ কান্নার বেশ প্রমাণ দিচ্ছে। মাচার উপর আরেকটা জীব গুটিশুটি হয়ে হয়ে বসে আছে। একটা কুকুর। আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যে, সে আমার উপস্থিতিতে বেশ বিব্রত ও আমি তার বিরক্তির কারণ।

-আসলে আমি ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম, কান্নার শব্দ শুনে এগিয়ে এলাম। সকলের কৌতুহল দূর করার জন্য বললাম। -কি দেখতে আসছেন? যতটুকু সম্ভব শুদ্ধভাষায় জিজ্ঞেস করল মহিলাটি। কন্ঠে ফুটে উঠেছে অভুক্ততা, দূর্বলতা ও অসহায়ত্ব। যা দেখতে এসেছি এই মুহুর্ত্বে তা বলতে ইচ্ছা করছে না বিধায় বললাম- কে কাঁদছিল? -মাইয়াটাই কাঁদছিল।

ছোট্ট মেয়েটার দিকে দেখিয়ে বলল। -কেন? -ছোট্ট মেয়ে খিদার জ্বালা সইবার না পেয়ে কামত্মাছিলো। -কেন আপনাদের ঘরে খাবার নেই? -আছেতো চাল আছে। এমন ভাবে বলল যেন খাবার মানে শুধুই চাল। -তাহলে? -রান্ধুম ক্যামনে? আগুন জ্বালামু কই? সত্যিইতো আমার খেঁয়ালই আসেনি যে ঘরের অর্ধাংশ জলে নিমজ্জিত সে ঘরে উনুন জ্বলবে কি করে।

-শুকনা খাবার খাইয়া মেয়েটা আর কতখন থাকতে পারে। -মহিলার অসহায় কন্ঠ। বললাম- আপনারা অন্য কোথাও যাচ্ছেন না কেন? -বাড়ী ঘর থুইয়া ক্যামনে যাই? ভাঙ্গা বা সাধারণ হলেও যে প্রতেক্যের কাছে তাদের বাড়ীটা অধিক প্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। -আমি ভাত খামু মা। এই প্রথম মেয়েটা একটা কথা বলল।

কিন্তু এমন ভাবে বলল যা শুনে আমার বুকের ভিতর হাওয়া বয়ে গেল। কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। অসহায় ভাবে ফিরে আসছিলাম। কুকুরটা ঘেউ করে উঠল। মনে হল আমায় ধক্কার জানাল।

বাড়ী পথ ধরলাম। সেজুঁতিদের বাড়ী পেরিয়ে এসেছি টেরই পাইনি। কানে কেবল ছোট্ট মেয়েটার কথাটাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অর্ধেক বর্ষনের ফলে মানুষের যে করুণ অবস্থা হয়, অনেককে না খেয়েও থাকতে হয় জানতাম না। কিন্তু কী অসহায় আমি শুধু দেখলাম কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না।

মনে পড়ল বাড়ীতে বৃষ্টির দিনে বৃষ্টির উপযোগী খাবার তৈরী হয়। মানে খিচুরি, মাংস ইত্যাদি। আজও নিশ্চই হয়েছে। বাড়ী ফিরেই হয়ত খেতে বসব। অথচ..................... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।