ডাক্তার নামের একটি প্রানী হওয়ার চেষ্টায় আছি। জীবনের যতগুলো সুখের মুহূর্ত এসেছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল ssc তে gpa 5 পাওয়া। আসলে আমার অবস্থা ছিল কোনমতে পাশ করা নিয়ে,সারাজীবনই। পড়াশোনা তেমন একটা করতাম না। আম্মার মার সারাজীবনই খেয়ে এসেছি এ কারনে।
শেষ পর্যন্ত বাসার সবাইও আমার A+ পাওয়ার আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিল। আর শেষ পর্যন্ত আমিই কিনা দেখালাম এক আজব ভেলকী যা এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারি না। সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা।
Ssc xm আসার আগ মুহুর্তে বিশাল ব্যাস্ততায় কাটাতাম সারাদিন। ভোর ৫ টায় উঠে দোয়া, তারপর আবার ঘুম বেলা ১১ টায় উঠে মুখ না ধুয়েই বেরিয়ে পড়তাম স্কুলের উদ্দেশ্যে।
কেন জানি না আমার স্কুলের পথ শেষ হতো এলাকার গেমসের দোকানটায়। আমি আর ফরহাদ তো মোস্তফার গেমওভার না করে উঠতেই পারতেম না। যদি না কোন কারনে মারা পরতাম জিদ চেপে যেত আরেকটা কয়েন নিয়ে বসটাকে শায়েস্তা না করা পর্যন্ত। এভাবে খেলে টেলে স্কুলের প্রথম ২ টা ক্লাস মিস দিয়ে ৩ নাম্বার ক্লাসটা থেকে শুরু করতাম। মনে আছে ফিজিক্সের কি একটা সুত্র পারি নাই,স্যার বলল “তোমার আর gpa 5 পাওয়া হইছে,মিনমিন করে বলেছিলাম কে চাইছে পাইতে?
আমার মাথায় ঘুরত বিকালে কিভাবে কোচিং ফাকি দিয়ে ক্রিকেট খেলা যায়,কিভাবে ১ কয়েনে মোস্তফার গেমওভার করা যায় এসব হাবিজাবি।
মেয়ে পটাইতে তখনও শিখি নাই,বিকালে ক্রিকেট আর রাত জেগে গল্পের বই পড়াই ছিল তাই একমাত্র সময়ের সদ্বব্যহার করার মাধ্যম। পড়ালেখাকে আজীবনই সময় নষ্ট ভেবে এসেছি,আজও সেই ধারনা থেকে বেশী নড়তে পারিনি।
টেষ্টে allow হলাম 3.8 নিয়ে। আমি বেজায় খুশী,পরীক্ষায় তো বসতে পারব। কারন টেষ্টে পাশ না করলে পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার নিয়ম ছিলনা আদমজীতে।
ভালো কথা যারা টেষ্টে ৪.৫ এর উপরে পেয়েছিল তাদের জন্য একটা গ্রপ আর যারা এর নিচে তাদের জন্য একটা গ্রপ খোলা হয়েছিল। মনে মনে আমি খুশীই হয়েছিলাম একপ্রকার,কারন ঐসব বেশী জ্ঞানী পোলাপানদের সাথে ক্লাস করার থেকে রফিক স্যারের বেতের বাড়ি খাওয়া আমার কাছে শ্রেয়তর মনে হতো।
ফাকিবাজির মাত্রা দিনদিন বাড়তে লাগল। বাসা থেকে প্রতিদিন ঘ্যানঘ্যান A+ না পাইলে বাসার ভাত বন্ধ,কামলা দিয়ে না হেলপারি করে খেতে হবে কি আজেবাজে সব কথা। ছিহ।
একবার আস্তে করে বলেছিলাম,পৃথিবীর সব মহান মনীষীরা পড়ালেখায় বেশীদূর যেতে পারে নি। শুনে আমার বাপজান ধাম করে পিঠে কি দিয়ে যেন দিল,দেখতে পাই নি,শুধু অনুভব করতে পেরেছিলাম। ওহ সেকি ব্যাথা,সেই থেকে মনীষী বানান লিখতে আজো আমার ভুল হয়।
কোন রকম্ পড়াশোনা চালিয়ে যেতে রাখলাম,অন্তত ৪.৫ এর উপর রাখতেই হবে নাইলে মান ইজ্জতের ফালুদা। তখন নাকি gpa 5 ওয়ালা জামাইদের চরম ডিমান্ড চলতেছে।
সে কাহিনী আরেকদিন। পরীক্ষার আর এক সপ্তাহ বাকি। সারাদিন রাত বইয়ের দিকে চেয়ে থাকি, সিলেবাসের আর কুল পাই না। পড়াশুনার এই অকুল সাগরে পরে শুধু একটা দোয়াই করতে থাকি,কোনমতে যাতে পাশ করতে পারি,লাগবো না আমার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া । এত কষ্ট করে পড়ার থেকে হেলপারি করার অনেক সোজা।
এলাকায় সকল পরীক্ষার্থীদের জন্য দোয়া হবে। মিলাদ হবে। আমি হাজির। না শুনেছিলাম জিলাপীর বন্দোবস্ত আছে। জিলাপী খেয়ে আসলাম।
এসে আবার পড়া। আল্লাহই জানে,আল্লাহ চাইলে কি না হয়,সামান্য পাশ। হাহ।
পরীক্ষার দিন সকালে উঠেই শুরু হলো ফোন। আত্নীয় স্বজন যারা আছেন সবার কাছ থেকে ফোনে দোয়া নেয়া।
। খালামনি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি দোয়া কইরেন। খালার দোয়া,বেচে থাক বাবা। আজব কই বলবে ভালো করে পরীক্ষা দিস তা না বেচে থাক। আমি কোন মিল পেলাম না।
শেষে আম্মা বলল বিল্ডিঙ্এর সব বাসায় গিয়ে আঙ্কেল আন্টির কাছ থেকে দোয়া নিয়ে আসো,আর ৩ তালার সজীব ভাইয়ের কাছ থেকেও আনবা। গেলাম দোয়া নিতে,এক বাসায় যাই,আন্টি বলে, অহ বাবা দোয়া লাগবে না,পরীক্ষা ভালো হবে। আরে দোয়া ছাড়া কাজ হয়? সজীব ভাইয়ের কাছে গেলাম। ভাইয়া আবার বুয়েটে পড়ে তো! স্পেশাল দোয়া দিবে। ভাই শুরু করল জ্ঞান দেওয়া,যেটা এখন আমি আমার জুনিয়র দের দেই।
আরে বুঝলা, ডরাইও না মিয়া। তো মামুলি এক খান পরীক্ষা। দিবা আর হইয়া যাইব। নো টেনশন। আমি মনে মনে বলি ভাই তাইলে আপনে আমার পরীক্ষাটা দিয়া আসেন।
আসলে পরীক্ষার পর সবারই পরীক্ষা সহজ লাগে।
গেলাম আম্মার সাথে পরীক্ষা হলে। আরে বাপরে, পরীক্ষা না মেলা বসছে?যত না পরীক্ষার্থী তার থেকে বেশী গার্জিয়ান, আর পোলাপান ও এমন ভাবে রিভাইস দিচ্ছিল যেন জীবনে কোনদিন পরে নাই আর এটাই তাদের শেষ পড়া। আমি বই খাতা কিছু নিয়ে যাই নি। আম্মা আইসক্রীম কিনে দিল,যেটাই খেতে লাগলাম।
আম্মা বারবার করে বলছে বাবা মাথা ঠান্ডা রাখবি। আমি তখন পেট ঠান্ডা করায় ব্যাস্ত। তো গেলাম হলের ভেতর। শুরু হলো পাবলিক পরীক্ষা নামক জীবনর প্রথম যুদ্ধ্ব। প্রশ্নপত্র দেখলাম মোটামুটি পারি।
লিখতে শুরু করলাম। একসময় শেষ হলো প্রথম পরীক্ষা। এভাবে আস্তে আস্তে দিতে লাগলাম পরীক্ষা। বাসায় আসলেই আম্মা বলে কিরে কেমন দিলি। আমিও স্বভাব মতো বলি,আম্মা সেইরকম হইছে।
পুরা ১০০ মার্কেই উওর করছি। আর ২ মার্ক বেশী থাকলে সেটার আনসার দিয়ে আসতাম । মনে মনে বলি আমি তো জানি আমি কি দিছি।
সব গুলা পরীক্ষা একসময় শেষ হলো। এ কদিনে আমার অবস্থা হয়েছে দেখার মত।
তো পরীক্ষা দিয়ে আমি তো মহা ফুর্তিতে। কত্ত বড় হয়ে গেছি। কলেজে পড়ব এই ভাবনায় একটু পরপর শুধু টাশকি খাই। রেজাল্ট যে কি হবে সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই।
মাথাব্যাথা শুরু হলো সেদিন যেদিন শুনলাম রেজাল্ট দিবে।
আমার মুখের পাওয়ার ১০০ থেকে নেমে ৪০এ এবং তার পর নাই হয়ে গেল। আম্মা ব্যাপারটা বুঝলো। বললো আরে কিছু হবে না,রেজাল্ট তো একটা হবেই। চিন্তা করিস না। সেই সময় আমি আম্মার মুখের দিকে তাকালাম।
আহারে চোখে কত আশা। আমার বাবা কত কষ্ট করেছে,যা চেয়েছি তাই দিয়েছে,মা সারা রাত আমার সাথে জেগে থেকেছে,আহারে এই বাবা মায়ের জন্য সামান্য gpa 5 টা আনতে পারব না?কায়মনে শুধু তখনি দোয়া করলাম আল্লাহ আমার বাবা মার জন্য হলেও আমি যেন A+ পাই। মহান আল্লাহ তায়ালা বোধহয় অন্য রকম ভেবে রেখেছিলেন। আল্লাহর তো অনেক আছে,বোধহয় ভাবলেন আহা নাদান বান্দা,দেই একটু বেশী করেই দেই। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া একটু বেশীই পেয়েছিলাম।
গেলাম দুপুরের দিকে ভরপেট খেয়ে রেজাল্ট আনতে। জানি তো সারা দিন আর খেতে পারবো না। কিন্তু সেটা যে খুশীতে তা যদি জানতাম।
প্রচন্ড ভীড়। বাসা থেকে,বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসতেছে।
বললাম রেজাল্ট একটু পর দিবে। প্রচন্ড ভীড়ে জায়গা করে নিলাম কোনমতো। প্রথমেই ফেল লিষ্ট। না নাম নেই। তার মানে পাশ করেছি।
তারপর শুরু করলাম ৩ থেকে ৪.৯ য়ে গিয়ে শেষ করলাম। ব্যাপার কি?হতাশ হয়ে ৫ এর রোল গুলাতে চেক করতে লাগলাম। জানতাম থাকবে না। কিন্তু একটু পরই আমার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এটা কি আমার রোল নাম্বার।
১০৮০৮২। আমার এখনও মনে আছে। তারমানে নিশ্চই আমি চোখে ভুল দেখেছি। ফ্রেন্ডদের দিয়ে চেক করালাম। ফ্রেন্ডরা বললো শালা A+ পাইয়া ভাব ধরছে।
আল্লাহ,সত্যি তাহলে পেরেছি?বাবা মার স্বপ্ন,আমার দিনের বেলার অলীক স্বপ্ন সব তাহলে আজ সত্যি…ইয়াহুহুহুহুহুহুহু
বাসায় যেন উড়ে আসলাম। এসেই ভাব, হুম আমারে আন্ডারএস্টিমেট করো,হুম আমি কোন ক্যটাগরীর স্টুডেন্ট তা জানো?আমার বাবা মার সেদিকে খেয়াল নেই। তাদের খুশী দেখে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আম্মা ফোনে সবাইকে বলছে। আব্বা বলছে।
চারিদিকে এত আনন্দ। জীবনের অন্যতম একটা সেরা দিন ছিল। বাবার খুশি মুখটা আহারে।
২ দিন পর।
সাইবার ক্যাফে তে বসছি মার্কশীট দেখার জন্য।
আমার রোল বের করেই দুইবাও ঢোক গিললাম। খাইছে আমারে,টানা A+ ছাড়া তো চোখে কিছু পড়ছে না। আমার রোল তো নাকি,অন্য কারো টা। নাহ আমার টাই। তারমানে কি আমি Golden 5 পেয়েছি?সেই দিন থেকে অনেক দিন আমার পা মাটিতে পড়েনি।
পুনশ্চঃ আজ ssc এর রেজাল্ট দিবে। দিনটা কতটা কঠিন আমি ভুক্তভোগী তা জানি। কারও স্বপ্ন পূরন হবে। কারো স্বপ্ন যাবে বাতাস হয়ে। কেউ হাসবে,কেউ কাদবে।
কিন্তু না আমি মনে করি এগুলা কোন ব্যাপার না। সবাই কষ্ট করেছে। স্বপ্নপূরনের পথে এগুলো বাধা হইয়ে দাড়াতে পারে না। কখনোই না। যারা সত্যিকারের মেধাবী তারা সব বাধা জয় করবেই।
জীবনের পরীক্ষার এই তো শুরু মাত্র। যারা কাল A+ পাবে তাদের সবার জন্য শুভেচ্ছা রইল। যারা আশানুরপ রেজাল্ট করতে পারবে না তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। মাত্র তো শুরু। সামনে অনেক পথ যেতে হবে।
তো লেগে পড়। সবাইকে শুভ কামনা।
ওহ একটা কথা পড়াশোনার সত্যিই কোন বিকল্প নেইরে ভাই। আর মনে করে আমার মিষ্টিটা কেও পাঠিয়ে দিও তো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।