... কাছে গিয়েও মেয়েকে ছুঁতে পারলেন না
হায়দার আলী বাবু, হাতিবান্ধা থেকে
আছফুল বেগমের বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। তেমন একটা চলাফেরা করতে পারেন না, চোখেও ঠিকমতো দেখেন না তিনি। তবু ছোট মেয়ে রোকেয়াকে প্রায় ১৪ বছর পর একটু ছুঁয়ে দেখতে এই বৃদ্ধা ছুটে গিয়েছিলেন ভারতীয় সীমান্তে। ছেলে রহমান (৫৫) বৃদ্ধা মায়ের আবদার মেটাতে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। ওপারে মেয়ে রোকেয়া (৪০) ও তাঁর স্বামী রফিকুল এসেছিলেন, সঙ্গে তাঁদের সন্তান রোকসানা (১০) ও সবুজ (৭)।
তবে মেয়ে আর নাতি-নাতনিকে ছুঁয়ে দেখা হয়নি বৃদ্ধা আছফুলের। কারণ তাদের মাঝখানে বাধা হিসেবে ছিল কাঁটাতারের বেড়া।
বৃদ্ধা আছফুল তাই কাঁটাতারের এপার থেকে মেয়ের উদ্দেশে চিৎকার করে বলছিলেন, 'আয় মা, আয়, আমার কাছে আয়; কত দিন তোকে আদর করি না, কাছে আয় মা...। ' আর ওপারে মায়ের এই আকুতি দেখে মেয়ে রোকেয়া কাঁটাতারের বেড়া ধরে বারবার ডুকরে কাঁদছিলেন।
আছফুল বেগমের গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার পশ্চিম বেজগ্রামে।
এ বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তের ওপারে ভারতের কাঁসাপাড়া গ্রামে তাঁর বাবার বাড়ি। চার মেয়ে ও তিন ছেলের সবার ছোট রোকেয়াকে প্রায় দেড় যুগ আগে বিয়ে দিয়েছিলেন ভারতে থাকা ভাতিজার সঙ্গে। সে সময় সীমান্তে ছিল না কাঁটাতারের বেড়া। ফলে অবাধে যাতায়াত করতেন তিনি। কিন্তু বেড়া নির্মাণের পর মেয়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
গতকাল বৃহস্পতিবার কাছাকাছি এসেও মা-মেয়ের অতৃপ্তির দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত অনেকেই।
শুধু এই মা-মেয়েই নন; গতকাল এ রকম অনেক দৃশ্যই চোখে পড়ে এপারে হাতিবান্ধার গেন্দুকুঁড়ি সীমান্ত এবং ওপারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) নিরাপাড়া ক্যাম্প এলাকায়। ৮৯৭ ও ৮৯৮ মেইন পিলার এলাকার ভারতীয় কাঁটাতারের উভয় পাশেই নানা বয়সী শত শত নারী-পুরুষের ঢল নামে। কালীপূজা উপলক্ষে গতকাল হঠাৎ কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়ার কাছে যাওয়ার সুযোগ দেয় বিএসএফ। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও (বিজিবি) এতে মৌন সম্মতি দেয়।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গেট না খুললেও কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলিয়ে উভয় দেশে থাকা স্বজনদের একটু দেখা মিলবে_এ সুযোগকে কাজে লাগাতে উভয় সীমান্তেই ছুটে আসে মানুষ, যাদের হয়তো পাসপোর্ট-ভিসার মাধ্যমে যাতায়াতের সামর্থ্য নেই। ফলে অন্তত কিছুটা কাছে যেতে পেরে তাতেই খুশি দুই পারের মানুষ। এ সময় অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
হাতিবান্ধার গেন্দুকুঁড়ি বাজার থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটাপথে গতকাল সকালে ওই সীমান্তে গিয়ে দেখা গেছে, সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি যাওয়ার খবরে হাতিবান্ধা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে এসেছিল সেখানে; যদি ওপারে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে একটু দেখা হয়_এ আশায়। অন্যদিকে ওপারে ভারতের কোচবিহার জেলার মাথাভাঙ্গা, শীতলকুচি, নিরাপাড়া, গাছতলা, কাঁসাপাড়া, শিববাড়ী, গোলেনাহাটিসহ অনেক গ্রামের মানুষ বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের দেখতে নিরাপাড়া ক্যাম্পের সামনে এসে জড়ো হতে থাকে।
উভয় দেশের নাগরিকরা কাঁটাতারের বেড়ার দুই পাশে একে অন্যকে ছুঁতে না পারলেও ফাঁক দিয়ে স্বজনের মুখ দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলে।
কালীগঞ্জের চামটাহাট থেকে এই সীমান্তে ভারতে থাকা নিজের ভাইকে দেখতে এসেছিলেন অমৃত রায়। তিনি বলেন, 'আমরা গরিব মানুষ। তাই বৈধভাবে ভারতে যাওয়া-আসা করতে পারি না। আবার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার কারণেও যাওয়া সম্ভব হয় না।
তাই আজ অনেক দিন পর এখানে এসে দূর থেকে ভাইকে একটু দেখতে পেলাম, কথা হলো উভয়ের মধ্যে। '
ওপারে কাঁটাতারের বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে থাকা জবা রানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, প্রায় ছয় কিলোমিটার পথ হেঁটে তিনি এসেছেন সীমান্তে; যদি এপারে থাকা ভাইয়ের সঙ্গে ১০ বছর পর দেখা হয়_সেই আশায়।
সংবাদ: কালের কণ্ঠ
তারিখ: ২৮.১০.১১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।