আমি খুব সহজ এবং তার চেয়েও বেশী সাধারন একজন মানুষ । সমাজের অসংগতি গুলোর ফেরিওয়ালা হয়ে সবাইকে নিয়ে সংগতি প্রতিষঠা করতে চাই।
ছিলেন লৌহমানব। তিনি ছিলেন আরব-আফ্রিকার আদিগন্ত মরুর দুরন্ত বেদুঈন বাদশা। ঘটেছে সেই মরুঈগলের অবসান।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা ছিল তার মূল অনুপ্রেরণা। একাধারে তিনি ছিলেন বিলাসী ও একগুঁয়ে। তার নিরাপত্তায় সঙ্গে রাখতেন নারী দেহরক্ষী। রহস্যময় জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিজ সমালোচনা একেবারেই সহ্য করতেন না।
এজন্য পশ্চিমারাও তাকে বিশেষ সমীহ করে চলতেন। মাঝেমধ্যেই নানা রকম বক্তব্য দিয়ে পশ্চিমাদের হুমকি দিতেন।
সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একশ’ ভাগ দেশপ্রেমিক। আর তাই তো ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও অজ্ঞাত স্থান থেকে অডিও বার্তায় তার অনুগতদের হুকুম দিতেন, ‘পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও, ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না; জয় আমাদের নিশ্চিত। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই আরও জোরদার কর, আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে (লিবিয়া) রক্ষা কর।
’
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ সত্ত্বেও তিনি জীবনের শেষ সময়ে লিবিয়ায় অবস্থান করে ন্যাটোবাহিনী ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন।
১৯৪২ সালে লিবিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের সির্তে এক যাযাবর গোত্রে জন্ম নেন গাদ্দাফি। বেনগাজি ইউনিভার্সিটিতে ভূগোল বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও মাঝপথে তা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন যুবক গাদ্দাফি।
১৯৬৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার তত্কালীন রাজা ইদ্রিসকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন গাদ্দাফি। ভিন্ন মতাবলম্বীদের কঠোরভাবে দমন করে খনিজ তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার দখল ধরে রাখেন তিনি।
লিবিয়া মানে আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম তেল উত্পাদনকারী দেশ। প্রযুক্তির উত্কর্ষতায় এখন এখানে মেলে উচ্চমানের হালকা তেল। লিবিয়া মানে ৪৬.৪ বিলিয়ন ব্যারেলের আফ্রিকার বৃহত্তম তেলভাণ্ডার। বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ শীর্ষ দশটি দেশের একটি। লিবিয়া মানে দুনিয়ার ১২তম তেল রফতানিকারক দেশ।
ইউরোপের বৃহত্তম তেল রফতানিকারী দেশ। লিবিয়া মানে প্রতিদিন ১.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্পাদন, যার গুণমান অসাধারণ, শোধন করতে হয় কম।
১৯৭৭ সালে দেশের নাম বদলে গ্রেট সোশ্যালিস্ট পপুলার লিবিয়ান জামাহিরিয়াহ (জনতার রাষ্ট্র) রাখেন। এসময় দেশের সাধারণ মানুষদের পার্লামেন্টে তাদের মতামত জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
এ সময় তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ প্যান-আরব গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন।
এ সময় দেশের বৃহত্ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় রাখার অনুমতি দেন।
রহস্যময় ও বিতর্কিত জীবনযাপনের মাধ্যমে চার দশকের বেশি সময় অতিক্রম করেছেন এই নেতা। তার এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলে অভিহিত করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ‘দ্য গ্রিন বুক’ নামে বইয়ে তার রাজনৈতিক দর্শনের রূপরেখা প্রকাশ করেন। বইটির উপ-শিরোনাম ছিল গণতন্ত্রের সমস্যার সমাধান : সামাজিক ক্ষেত্রে তৃতীয় সর্বজনীন তত্ত্ব।
নিচে তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরা হলো :
‘আমি একজন বিশ্বনেতা, আরব শাসকদের প্রধান, আফ্রিকার রাজাদের রাজা এবং মুসলমানদের ঈমাম এবং আমার আন্তর্জাতিক মান-মর্যাদা এর নিচে হতে পারে না। ’ ৩০ মার্চ ২০০৯ সৌদি বাদশা আবদুল্লাহকে কাপুরুষ অভিহিত করে এমন বক্তৃতাই দেন গাদ্দাফি। যদিও তার মাইক্রোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
‘লিবিয়া ছাড়া বিশ্বে আর কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র নেই। ’ ২০০৮ সালে ২৩ মার্চ নিউইয়র্ক সিটির কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
আসুন এবার দেখি কি কি সুবিধা পেত লিবিয়ার জনগন:
বিনামূল্যে বিদ্যুত ব্যবহার করতো লিবিয়ার জনগণ। আধুনিক সময়ের নগরজীবনের অন্যতম প্রধান চাহিদা বিদ্যুত্। আর লিবিয়ার জনগণ সেই বিদ্যুত্ ব্যবহার করত পুরোপুরি বিনামূল্যে।
# সরকারনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো থেকে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হতো নাগরিকদের।
#তেলসমৃদ্ধ দেশটির তেল বিক্রি করে যে টাকা আয় হতো, তা সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হতো লিবিয়ার সব জনগণের ব্যাংক হিসাবে।
#গাড়ি কেনার সময় লিবিয়ার নাগরিককে গাড়ির মূল্যের অর্ধেক সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হতো। তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ায় প্রতি লিটার পেট্রলের মূল্য ছিল মাত্র ০.১৪ ডলার।
#গাদ্দাফি সরকারের ৫০ হাজার ডলার সহায়তা পৌঁছে যেত প্রতিটি নববিবাহিত দম্পতির কাছে। যেন তাঁরা বাড়ি কিনে স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁদের নতুন জীবন শুরু করতে পারেন। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও লিবীয় মায়েরা সরকারের কাছ থেকে পেতেন পাঁচ হাজার ডলার করে।
#পড়াশোনা বা চিকিত্সাসেবার জন্য কেউ বিদেশে গেলে তাঁকে মাসে দুই হাজার ৩০০ ডলার দেওয়া হতো সরকারের তরফ থেকে।
#গাদ্দাফি ক্ষমতায় আসার আগে লিবিয়ায় স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। শিক্ষাখাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে সেই সংখ্যাটা ৮৩ শতাংশে নিয়ে গিয়েছিলেন গাদ্দাফি। পুরোপুরি বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিত্সাসেবা পেত লিবিয়ার জনগণ। সেখানকার ২৫ শতাংশ মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে।
পড়াশোনা শেষ করে কেউ যদি চাকরি না পেত, তাহলে বেকার থাকা অবস্থায় সরকারের কাছ থেকে ভাতাও পেত তারা।
#কৃষিখাত উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিশাল অবদান ছিল মুয়াম্মার গাদ্দাফির। কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে নিতে ইচ্ছুক লিবিয়ার জনগণকে জমি, খামারবাড়ী, বীজ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি দেওয়া হতো সরকারের পক্ষ থেকে। সবই বিনামূল্যে।
#গাদ্দাফির লিবিয়ার কোনো বৈদেশিক ঋণ তো ছিলই না, বরং বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল ১৫০ বিলিয়ন ডলার।
আরবজুড়ে সাম্প্রতিক সব জন-মহাজাগরণের নেপথ্যে নাটের গুরু সিআইএ। গণবিদ্রোহের কলকাঠি নাড়ছে তারাই। তিউনিসিয়া থেকে মিসর ক্ষমতার পালাবদলে ক্রীড়নক হলো মার্কিন এই আলটিমেট গোয়েন্দা সংস্থা। বেন আলি, হোসনি মোবারকের লৌহ শৃঙ্খলিত শাসনের পতন জনবিস্ফোরণের মুখে ঘটলেও এ অভ্যুত্থান নাটকের চিত্রনাট্য ও দৃশ্যকাব্যগুলো সিআইএ’রই রচনা।
সর্বশেষ শিকার হলো আরব মরুসিংহ গাদ্দাফি।
ইসরাইলের স্বার্থরক্ষার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। আর বড় বিষয় হলো, তারা আরব বিশ্বের তেলক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। যদিও এসব দেশের আন্দোলনের আগুনে সিআইএ’র ঘি ঢালার কারণে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বে অসন্তোষও বাড়ছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর কায়রোতে ইসরাইলি দূতাবাসে হামলার ঘটনা এর বড় উদাহরণ হতে পারে।
সিআইএ মূলত খেলছে দুইরূপধারী গোপন খেলা।
আরব একনায়কদের তারাই নানা শক্তি ও সাহস জুগিয়ে পরিণত করছে দানবে। আবার মার্কিন স্বার্থের টানাপড়েনে তাদেরই খড়্গের শিকার হয়ে করুণ পরিণতি ঘটছে বেন আলি, হোসনি মোবারকদের। প্রশ্ন এবার, এর পরে কে! কোন দেশে সিআইএ’র পরবর্তী মিশন।
যে বসনত আজ লিবিয়াতে বইতে শুরু করল সে বসনত কতটুকু টিকে থাকে সেটাই এখন দেখা সময়ের ব্যাপার মাএ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।