আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মস্কোর জন্য লড়াইঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের বীররক্ষক ইভান পানফিলোভ ও তার অকুতোভয় সঙ্গী যোদ্ধাদের কথা।

[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/tawfiqtuhin_1319277277_1-Ivan_Panfilov.jpg ইভান পানফিলোভ। এটা ছিলো ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মান বাহিনীর দুর্বার গতিরোধের প্রথম বড় রকমের ধাক্কা,যার ফল অনেক সুদুরপ্রসারী হয়েছিলো। অপারেশান বার্বারোসা নামে পরিচিত জার্মান এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল ডিসেম্বর১৯৪১ এর মধ্যে মস্কো দখল ও তার বাসিন্দাদের নিশ্চিহ্ন করা। কিন্তু তারা বিফল হন সোভিয়েত জাতির অদম্য সাহসিকতার কাছে। এই প্রথম জার্মান জেনারেল রুন্ডস্টেড ও হাইন্স গুডারিয়ানের মতো সেনানায়করা হিটলারের কাছে তীব্র ভতসনার শিকার হোন।

চাকরীচ্যুত হোন অসংখ্য সৈনিক ও অফিসার। সোভিয়েত রাজধানী রক্ষার যুদ্ধে সমগ্র জাতি একযোগে বিপুল শৌর্য ও বীর্যের পরিচয় দেন,বীরত্ব তাদের কাছে নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনায় পরিনত হয়। এমন সব ঘটনায় এমন কিছু ব্যক্তির কথা উল্লেখ করতে হয়,যারা যুদ্ধের সময় কিংবদন্তীর জন্ম দেন,তেমনি একজন হলো সোভিয়েত ৩১৬ তম ডিভিসনের অধিনায়ক ইভান পানফিলোভ। ইভান পানফিলোভ(১৮৯২-১৯৪১) জন্মেছিলেন রাশিয়ার পেত্রভস্ক,সারাতভে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি ছিলেন সোভিয়েত কিরগিজস্থানের সামরিক কমিসার।

১৯৪১সালের ২২জুন জার্মান নাজী বাহিনী রাশিয়ার সমগ্র পশ্চিম সীমান্তজুড়ে একযোগে আক্রমন করে বসে। ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে তারা বিপুল বেগে সোভিয়েত রাজধানী মস্কোর দিকে ধাবিত হচ্ছিলো। তখন সর্বোচ্চ সোভিয়েত প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় শুধু চিন্তা করছিলো,মস্কোর পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষার জন্য ২০-২৫দিন সময় খুবই দরকার,আর শত্রুও ক্রমশ রাজধানীর নিকতবর্তী হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত ট্যাংকবিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা,পরিখা খনন ,বিভিন্ন বাধা সম্পন্ন হয়নি। এইমুহুর্তে এমন এক পেশাদার বাহিনী দরকার যাদের কে দিয়ে নাজী আক্রমন কিছু সময়ের জন্য প্রলম্বিত করা যায়,এ মূহুর্তে দরকার একটি সম্পুর্ন পেশাদার বাহিনী,যারা ২০-২৫ দিনের জন্য সে আক্রমন ঠেকিয়ে রাখবে।

সময় সে মুহুর্তে অসম্ভব মুল্যবান। সমগ্র বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত বাহিনী খুব কমই ভূল করেছিলো,কারন যে অল্প কয়টি ভূল তারা করেছিলো তার ফলাফল হয়েছিলো ভয়াবহ। তাই সোভিয়েত জেনারেল গেওর্গি জুকোভ এ গুরুত্বপুর্ন কাজের দায়িত্ব দিলেন কমান্ডার ইভান পানফিলোভ ও তার ৩১৬ রাইফেল ডিভিসনের উপর। জুকোভ দায়িত্ব নেয়ার পর পানফিলোভকে বলেছিলো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আমি নিজে তোমাকে গুলি করে মারবো। মনে রাখবে,তোমার ততপরতার উপরই রাজধানীর নিরাপত্তা নির্ভর করছে।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে পানফিলোভ তার ৩১৬ রাইফেল ডিভিসনের অমিততেজী যোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমন রুখতে গেলেন। বস্তুত কোন দেশের রাজধানীর পরাজয় মানে সে দেশের মানুষের মানসিকতার উপর ভীষন আঘাত। তাই তিনি তার সেন্যদের বললেন,তাদের কাজের গুরুত্ব কি ও কেনো তা জীবন দিয়ে হলেও পালন করতে হবে। তিনি তাদের বললেন,টাইম ইজ ব্লাড। সুতরাং বিপুল রক্তের বিনিময়ে হলেও আমাদের সময় কিনতে হবে।

যত বেশীদিন আমরা শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবো,ততবেশী দিন আমাদের ভাইয়েরা শত্রুকে প্রবল আঘাত হানার জন্য নিজেদের তৈরী করে নিতে পারবে। পানফিলোভ তার ডিভিসনকে নিয়ে মস্কোর পশ্চিমে স্মোলেনেস্ক-মস্কো মহাসড়কের নিকট ভলকলানস্ক মজাইস্ক প্রতিরক্ষা লাইনে নাজি বাহিনির সবচেয়ে শক্তিশালী ফর্মাসন গুলোর সাথে অসম যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। বাকিটা শুধুই ইতিহাস। ৩১৬ ডিভিসনের যোদ্ধারা রাজধানী রক্ষার জন্য বীরের ন্যায় মৃত্যুবরন করছিলো। রাজধানীবাসীর জন্য এটা ছিলো অত্যান্ত বেদনার মুহুর্ত যে,যখন তাদের প্রিয় সন্তানেরা তাদেরকেই রক্ষার জন্য অতি সন্নিকটে মারা যাচ্ছিল এবং তারা তা অনুভবও করছিলো।

সময় গড়াচ্ছিলো দ্রুত,যারপরনাই কঠিন পরিস্থিতিতে। বীরত্ব সেদিন তাদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বলে মনে হচ্ছিলো। আর জার্মান বাহিনীর জন্য এটা ছিলো এমন যে,এই প্রথম তারা যুদ্ধ শুরুর পর প্রবল বাধার সম্মুখিন হচ্ছিলো। যা তারা আশা করেনি। রুশ সৈনিক সম্পর্কে তারা এই মন্তব্য করছিলো যে,এদেরকে পর্যাপ্ত গুলি করার পরও ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতে হয়।

বাস্তবিকভাবে ৩১৬ ডিভিসন প্রবল বাধা দিয়ে জার্মান বাহিনী থেকে সময় কিনছিলো বিপুল রক্তের বিনিময়ে। ১৯৪১সালের ১৫নভেম্বর এ ডিভিসনের ২৮ জন যোদ্ধা নিজেদের জীবন দিয়ে মাত্র তিন ঘন্টার যুদ্ধে নাজী বাহিনীর অত্যাধুনিক ১৮টি ট্যাঙ্ক ধবংশ করে দিয়ে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী আক্রমন ব্যর্থ করে দেয়। এদের কোম্পানি কমান্ডার ভাসিলি ক্লচকভ মারা যাওয়ার পুর্বে তার সঙ্গীদের শুধু এটাই বলে যান,ভাইয়েরা শুধু মনে রাখবেন রাশিয়া বিশাল,কিন্তু আমাদের পিছু হঠা চলবে না। কেননা পিছনে মস্কো। তার এ ভাবনাতেই প্রতিফলিত হচ্ছিলো সমগ্র রাশিয়ার জন্য তীব্র ভালোবাসা ও উতকন্ঠা।

সর্বত্র কঠোর লড়াই চলছিলো,আর স্বয়ং ইভান পানফিলোভ সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। কারন প্রবল গোলাবর্ষন ও ইস্পাতের ধারা বর্ষনে তার সেন্যরা টিকতে পারছিলো না। তার গোলন্দাজেরা কামানের পাশেই যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যাচ্ছিলো। তিনি তাদের ছেড়ে না যেয়ে কামান গুলোর আবার দখল নিচ্ছিলেন,এটা দেখার পর তার সেন্যরা আর কেউ তাকে ছেড়ে যায় নি। বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছিলো।

তাদের এই তীব্র বাধাদানের ফলস্বরুপ মস্কো উপযুক্ত প্রতিরক্ষা নিতে সক্ষম হয়। অবশেষে সোভিয়েত প্রতিরক্ষাবিষয়ক জনকমিসার সিদ্ধান্ত নেয় পানফিলোভকে পর্যাপ্ত যোদ্ধা দেয়া হবে এবং তাকে ও তার ডিভিসনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের গার্ড মর্যাদা দেয়া হবে। কিন্তু অত্যান্ত দূঃখের বিষয় খবরটা তাকে দিতে যান মার্শাল রকসসভস্কি স্বয়ং,কিন্তু এর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে মর্টারের আঘাতে ইভান পানফিলোভ ও তার সহযোদ্ধারা ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। তিনি সবসময়ই চাইতেন যেনো সঙ্গীদের মাঝে তার মৃত্যু হয়। তাই হয়েছিলো।

তার মৃত্যুতে সমগ্র রাশিয়া শোকাহত হয়। এই যুদ্ধের মাঝেও তাকে তার স্মরনে মস্কো কামান দেগে এ মৃত্যুর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি ‘”সোভিয়েত রাশিয়ার বীর”উপাধী পান। তার সন্মানে ৩১৬ রাইফেল ডিভিসনের নামকরন হয় পানফিলোভাইট। পরবর্তীতে যুদ্ধে তারা দারুন ভূমিকা পালন করে।

এইসব অসংখ্য বীরদের নেতৃত্বেই রাশিয়া নাজী জার্মানকে চুড়ান্ত যুদ্ধে পরাজিত করেছিলো। ইভান পানফিলোভ। তার স্মরনে নির্মিত ভাস্কর্য। পানফিলোভের সমাধি।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।