আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাশেদ মিয়ার অবসর

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা আজ বৃহস্পতিবার। চারিদিকে ঝিরঝিরে বাতাস। রোদের তাপ সহনীয়। আকাশ সামান্য কালো মনে হলেও এখন বৃষ্টি নামবে না। রাশেদ মিয়া পুকুর ঘাটে বসে শেষবারের মতো পেপারের পাতায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।

দুপুরের মধ্যেই শাহেদ চলে আসবে। বৃহস্পতিবার এলে বাপ-বেটা দুজন মিলে দুপুরের খাবার একসাথে খায়। রাশেদ মিয়ার স্ত্রী সেদিন ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাপ-পুতের একসাথে খাওয়ার দৃশ্য তিনি তাকিয়ে থাকেন। অবশ্য এদিন তিনি রাশেদ মিয়ার চেয়ে পুত্রের দিকে স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেন।

কাশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আব্দুর রহিম আসছে। সে এদিকেই এগিয়ে আসছে। আড়চোখে আব্দুর রহিমকে আসতে দেখে রাশেদ মিয়া পেপার পড়ায় আরও মনোযোগী হলেন। চেহারার সামনে পত্রিকার পাতা ধরে গভীর মনোযোগে তিনি পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনগুলো পড়তে লাগলেন।

অন্য পৃষ্ঠায় যত গুরুত্বপূর্ণ খবর থাকুক, এখন আর পাতা উল্টানোর সময় নাই। তোতলামিয়া চলে আসতেছে। তার কী মতলব- কে জানে! পাতা উল্টোনোর সময় চোখাচোখি হলে বিপদ নামতে পারে। মাত্র তিনটি পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন পড়া শেষ না হতেই তোতলা সাহেব এসে হাজির। কাশি দিয়ে ওয়াক থু বলে কফ ফেললেন ঘাটের পেছনে।

তারপর সোজা নেমে গেলেন পুকুরের পানিতে। হাতের আঙুল দিয়ে দাঁত ঘষছেন। ঘোয়াৎ ঘোয়াৎ করে কুলি করছেন। আব্দুর রহিমের গলা ঘষাঘষির শব্দ শুনে বিরক্ত হয়ে উঠছেন রাশেদ মিয়া। তিনি উঠে পড়লেন।

এই লোকের আশেপাশে থাকা মানে তর্কের জন্য তৈরী হয়ে বসে থাকা। শাহেদের মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। রাশেদ মিয়ার স্ত্রী। তিনি পুকুরপারের অন্দরমহলের ঘাটে বসে থালাবাটি ঘষামাজা করছেন। প্রতিদিন সকালে এ কাজে তার ঘন্টাখানেক চলে যায়।

নারিকেলে ছোবড়া দিয়ে ঘষেন, তারপর ছাই, তারপর সাবান দিয়ে। চকচকে না হলে তার মনে খচখচে ভাব লেগেই থাকে। বিয়ের পর থেকে রাশেদ মিয়া তার স্ত্রীর ভেতর খুঁতখুঁতে ব্যারামের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। অসহনীয় অভ্যাস। সামান্য কিছু হলেই ধোয়া মোছা শুরু।

পাশের বাড়ির সোহেলের মা রাবেয়া খাতুনের গল্পের সাথি। পুকুরঘাটে বাসন ধোয়ামাজার সময় শুরু হয় তাদের গপ। গতরাতের ঘটনা থেকে নিয়ে পেছনের দিকে ধারাবাহিক যেতে থাকে। রাশেদ মিয়া এ নিয়ে বেশ কয়েকবার ঝগড়া করার চেষ্টা করেছেন স্ত্রীর সাথে। পারেননি।

-সোহেলের মায়ের সাথে তোমার এত কিয়ের কথা? -এত কথা দেখলেন কই? কথাই তো কইতে পারি না আপনার জন্য। ঘন্টার পর ঘন্টা আজাইরা গপ বন্ধ করো। মাইয়া মাইনসের এত কিয়ের আলাপ? তোমরা কি হাসিনা খালেদা? রাজনীতির আলাপ করো? -আপনে তো দেখি কথা বেশি বলা শুরু করছেন? -উল্টা বুঝো কেন? তোমাদের গপের বিষয় রাত থেইকা পেছনের দিকে যায়। গতকালের গপ, তারপর পসশুদিনের গপ। তোমরা হইলা চিংড়ি মাছ।

মাথাভরা গোবর। এইজন্য চিংড়ী মাছ পেছনের দিকে হাঁটে। -আপনি বকবক থামান। আমরা চিংড়ী মাছ। আপনি শামুক।

শামুকের মতো এক লাডা মাইরা বইসা থাকেন। আপনের জেরার উত্তর দেওনের সময় নাই। শাহদ আইতাছে। রান্নাবাড়ার কাম আছে। যাই।

চা দিমু এক কাপ? মাথার ঘোমটা টেনে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান রাবেয়া খাতুন। চুলায় তরকারি বসাতে হবে। বেলা উঠছে। রাশেদ মিয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন স্ত্রীর চলে যাওয়ার দিকে। মনে মনে ভাবেন, এহ, কী ব্যস্ততা রে! স্ত্রীর সাথে কিঞ্চিত বিবাদ করে তিনি মনটাকে চাঙ্গা করতে চাইলেন।

কিন্তু হলো না। পুতের জন্য মা ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন। বাইরের আবহাওয়া ঝিম মেরে আছে। না রোদ না বৃষ্টি। অন্যসময় হলে রাশেদ মিয়া বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

কিন্তু আজ না। শাহেদ আসতেছে। সে হয়তো রাস্তায়। এখন বৃষ্টি হলে ছেলে অসুবিধায় পড়তে পারে। তিনি কায়মনোবাক্যে বৃষ্টি না আসার জন্য প্রার্থনা জানালেন।

বৈদেশে যাওয়ার আগে দেশের বৃষ্টি বাদলা নিয়ে রাশেদ মিয়ার এত মায়াদরদ ছিল না। কখনো তিনি বিরক্ত হতেন একনাগাড়ে বৃষ্টি দেখে। ‘আকাশের হইল কি? বৃষ্টি কি আর থামতো না?’ বলে বলে কিছুক্ষণ পর রাগ দেখাতেন। কিন্তু দেশে ফিরে তার কথা কমবলার অভ্যাসের সাথে যোগ হয়েছে বৃষ্টির জন্য ভালবাসা। মরুভূমির বালুর দেশে তিনি বৃষ্টি হতে দেখেননি।

সেই অভাব থেকে তার মনে জন্ম নিয়েছে বাংলার প্রবল বর্ষণের জন্য প্রচন্ড ভালোবাসা। তিনি এখন আকাশ কালো হলেই আয় আয়, বৃষ্টি আয় বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু আজ না। ছেলে আসতেছে। বৃষ্টি তো আর ছেলের চেয়ে বেশি আপন না।

চলবে..... প্রথম পর্ব ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।