রাশেদ। কিশোর বয়সে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি ছিল রাশেদ। ক্লাস সেভেনে থাকতে রাশেদের সাথে আমার পরিচয় হয়। তারপর থেকেই আমরা একজন আরেকজনের ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে উঠি। রাশেদ ছিল ভীষণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আর তার মনে ছিল প্রবল দেশপ্রেম।
নিজের দেশপ্রেমকে আমার মাঝেও ছরিয়ে দিয়েছিল।
রাশেদের একটিমাত্র স্বপ্ন ছিল-স্বাধীন বাংলাদেশ। রাশেদের সেই স্বপ্নটিকে আমি কবে যে নিজের স্বপ্ন ভেবে নিয়েছিলাম তা জানা ছিল না। দেশকে স্বাধীন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধে। তখন আমাদের বয়স কম থাকায় পাক-সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করার সৌভাগ্য পায়নি।
নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা কারাই ছিল আমাদের কর্তব্য। মুক্তিযোদ্ধা শফিক ভাই যখন পাক সেনাদের হাতে বন্দি হয়েছিল তখন আমরাই তাকে মুক্ত করে এনেছিলাম। আর আমাদের এই অপারেশনের পরিকল্পনাটি রাশেদের মাথা থেকেই এসেছিল।
দেশ স্বাধীন হোল কিন্তু তা পেলাম রাশেদের জীবনের বিনিময়ে। চিরদিনের জন্য হারালাম রাশেদকে।
জাফর ইকবাল স্যারের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ পড়ে এভাবেই রাশেদের সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার। তখন থেকেই রাশেদের বন্ধু ইবুর জায়গায় আমি নিজেকে ভাবতে শুরু করি। আমার কৈশোর জীবনে প্রভাব পরতে থাকে রাশেদের। সেই প্রভাবটি আজও আছে। এখনও আমি আমার পাশে রাশেদের অস্তিত্ত্ব অনুভব করি।
আজও আমি রাশেদের জন্য চোখের জল ফেলি।
ডিসেম্বর মাসের দুই তারিখে রাশেদ ধরা পড়ে। ব্যাগের মাঝে ছয়টা গ্রেনেড ছিল। আজরফ আলী আর রাজাকাররা তখন নদীর ঘাটে নিয়ে দাড় করিয়ে বলে কলমা পড়। সামনে রাজাকারগুলো দাড়িয়ে ছিল রাইফেল তুলে, পিছনে আজরফ আলী।
একজন আজরফ আলীকে বলেছিল, হুজুর, ছেড়ে দেন, এইতুকু বাচ্চা। আজরফ আলী চিৎকার করে বলেছিল, সাপের বাচ্চা বড় হয়ে সাপই হয়। তারপর, অনেক ব্যাথা..., ভীষণ কষ্ট...।
আমি রাশেদকে ভুলিনি। কখনও ভুলব না।
ইবুর মত আমিও রাশেদকে কথা দিয়েছিলাম তাকে ভুলব না- কথা না দিলেও ভুলতাম না। রাশেদের মত একজনকে কি এতো সহজে ভোলা যায়?
ক্লাস সেভেনে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ পড়ার পড় থেকেই রাজাকারগুলিকে মনে মনে প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করা শুরু করি। তখন বি.এন.পি ক্ষমতায়, রাজনীতি তেমন বুঝতাম না। খবরে প্রতিদনিই দেখতাম জামাতের নিজামী আর মুজাহিদ সগর্বে পাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বাংলার মাটির উপর দিয়ে। তখনও জানতাম না এই পশুগুলোই রাশেদের হত্যাকারী।
একদিন এক প্রবন্ধ পড়ার সময় জানতে পারলাম, ‘জামাতে ইসলামের প্রধানরাই ছিল একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী’। এই একটি লাইন-ই আমাকে জামাতের আসল রূপ আমার সামনে তুলে ধরেছিল। তখন থেকেই প্রচণ্ড ঘৃণা হতে থাকে নিজামি আর মুজাহিদের প্রতি। রাশেদ বলেছিল- ‘স্বাধীনতার প্রথম কাজই হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকদের খতম করা। যদি তাদের খতম না করা হয় তাহলে দশ বিশ বছর পড় তারা আবার পাকিস্তানিদের ডেকে আনবে’।
রাশেদের কথাটির সত্যতা তখন চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেছি। খালেদার প্রতিও ঘৃণা হতে থাকে, এই খুনিদের মন্ত্রী বানানোর জন্য।
জানতাম এই খুনিদের বিচার কোনদিনও হবে না কারণ তারা ইতোমধ্যে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। তবুও বার বার স্বপ্ন দেখতাম হয়তো কোন একদিন সত্যি সত্যিই ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে রাজাকারগুলি, তাহলে রাশেদের সেই ব্যাথাটি, সেই কষ্টটি কমবে। ২০১৩ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর আমি আমার স্বপ্নকে লালন করে গেছি।
আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, ফাসিতে ঝোলাতে পেরেছি রাজাকারকে, শান্তি দিতে পেরেছি হাজারো রাশেদের আত্মাকে।
সবশেষে, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ থেকে একটি লাইন- ‘এই শ্লোগানে কিন্তু একটাই অংশ। একজন বলে জয় বাংলা, তখন অন্য সবাই বলে জয় বাংলা। শ্লোগানটা সাংঘাতিক। বলার সময়ই মনে হয় দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে’।
জয় বাংলা। ।
Md. Mithun Hasan
December 14, 2013
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।