মজনু মিয়া,
সালাম নিও। জানি না এই চিঠি তুমি পড়তে পারবে কি না। ওপারে বসে কেউ এই পাড়ের চিঠি পড়েছে শুনি নি কখনো। তারচেয়ে বড় কথা তুমি পড়তে পারো কিনা সেটাই জানি না। যদিও মানুষের বেশভূষা দেখে তার স্বাক্ষরতা বিচার করাটা দুরূহ কাজ।
এই যেমন ওইদিন আমাকে অবাক করে দিয়েছিল সানা ফকিরের মা কিম্বা এই সদরের বাকীবিল্লাহ। আশি বছরের থুড়থুড়ে সানা ফকিরের মা নাম স্বাক্ষর জানত,অথচ বাকীবিল্লাহ জীবনে কলম ধরে নি কখনো।
যাহোক,বড় দুঃখ নিয়ে তোমাকে এই লেখা। তোমাকে যখন ট্রলিতে করে নিয়ে এল,তখন রাত তিনটা। নাইট ওয়াজ স্টিল ইউং দেন,কিন্তু সারাদিনের খাটুনী এবং পরের দিনের আশু ধকলের কথা চিন্তা করে খানিকটা ঝিমুনি ধরে গিয়েছিল।
এত রাত্রে তোমার মত উৎপাতের অনাবশ্যক উপস্থিতি তাই আমাকে খুশী করতে পারল না। "রোগীর লোক কে?" বলে যখন তারস্বরে চেঁচাচ্ছিলাম,তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকানো ছাড়া তাই তোমার কিছু করার ছিল না। তোমার প্রতিবেশী ছমেদ আলীকে দেখে বিরক্তি খানিকটা বেড়েছিল। এত রাতে যে বুড়ো নিজেই নিজেকে দেখে রাখতে পারবে না,সে তোমার জন্য করবে কি?তাই বিরক্তির সুরে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,"আর লোক নাই?"
তোমাকে পেটে কয়েকবার হাত চালিয়ে আমার বুঝতে দেরি হল না যে তোমার intestinal obstruction হয়েছে। কি মিয়া,বুঝ নি এইটা কি রোগ?থাক অত বুঝার দরকার নাই,শুধু শুনে রাখ এইটা একটা জটিল রোগ যার জন্য অপারেশন লাগবে।
পেট কেটে দেখতে হবে তোমার অন্ত্রের কোথায় সমস্যা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই ছমেদ আলীকে যখন বললাম যে তোমার অপারেশন লাগবে,সে আরো বেশী আহাম্মক হয়ে গেল। সে তোমার পাড়াপড়শী, ভেবেছিল কোন মতে হাসপাতালে তোমাকে পৌঁছে দিতে পারলেই তার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু আমার ভাবলেশহীন পরামশ্য শুনে সে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত না থেকে পারল না।
আমি তাকে আরো বেশি বিপদে ফেললাম,"এই রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ,অপারেশন করলেও বাঁচে কিনা সন্দেহ।
অপারেশন করতে চাইলে দুই ব্যাগ রক্ত যোগাড় করতে হবে। "লে বাবা, ঠেলা সামলা। ছমেদ অপারেশনের ওষুধ কোথায় পাবে,আর আর এতো রাতে সম্পুর্ন অচেনা এই শহরে রক্ত কোথায় পাবে?কিন্তু আমার মুখের পেশীগুলোর শক্ত অবস্থান দেখে সে কোন অজুহাত করার সাহস করল না। তখন আমার মাথায় প্রশ্নের উদয় হল,ছমেদকে জিজ্ঞেস করলাম,"রোগীর ছেলেমেয়ে কই?"ছমেদ উত্তরে যা বলল,তা শুনে আমার মেজাজ আরো তিরিক্ষ হয়ে গেল। তোমার নাকি চার ছেলে,তিন মেয়ে।
মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে,আর ছেলেরা যার যার মত। তোমাকে দেখার তাদের সময় কই?
হায় রে মজনু মিয়া ! তিলতিল করে যাদের মানুষ করেছ,তারা আজ তোমায় বোঝা মনে করে রাস্তা ফেলে দিয়েছে। অথচ গত বছরই এক হাত জমির জন্য যার মাথা ফাটাতে বসেছিলে,সেই ছমেদ আজ তোমাকে কাধে করে নিয়ে এসেছে। এরেই বলে নিয়তি। "রক্ত যোগাড় করতে পারবা?"ছমেদকে আবার জিজ্ঞেস করলাম।
ছমেদ তার ছাগুলে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,"সার,আমি রক্ত কই পাইবাম?""কই পাবা সেটা আমি জানি না। রক্ত ছাড়া এই রোগীর অপারেশন হবে না,আর অপারেশন ছাড়া এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না। রোগীর আত্মীয়স্বজন খবর দাও। এই ওয়ার্ড বয়,রোগীকে ওয়ার্ডে নামিয়ে দাও। "এই বলে আমি চলে এলাম আমার কক্ষে।
মনে মনে শুধু বিরক্তির ছড়াছড়ি,ধুর কোথ থেকে যে আধমরা বুড়া গুলা হাজির হয়?
রাতে আর তোমার সাথে দেখা হয় নি। সকাল বেলা যখন অন্য ডাক্তারদের সাথে রাউন্ডে বের হলাম,দেখলাম ছমেদ তোমাকে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তোমার স্যালাইন চালু করা হয়েছে,জিজ্ঞেস করে জানলাম সরকারী সাপ্লাইয়ের কিছু ঔষধ তোমাকে দেয়া হয়েছে,স্বাভাবিকভাবেই রক্ত জোগাড় হয় নি,তোমার ছেলেপুলেও কেউ আসে নি,আসবেও না। নিজেরা নিজেরা তোমার রোগ নিয়ে আলাপ করলাম,ছমেদকে কয়েক প্রস্থ ধমকালাম। তারপর পরের রোগীর কাছে চলে গেলাম।
তোমার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকানো ছাড়া কিছু করার রইল না।
বিকেলে অপারেশন থিয়েটার থেকে অবসাদগ্রস্ত শরীর নিয়ে যখন বের হলাম,ভাবলাম ওয়ার্ডে একটু ঢুঁ মেরে যাই। ডক্টরস রুমের সামনেই ছমেদ দাড়িয়ে,খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল,"সার,ডেত সাট্টিফিকেট"dead certificate" ইট্টু লিক্কা দিয়া যান। "স্বভাবতই চোখটা ছুটে গেল ওই দিকে যেখানে তুমি পড়ে ছিলে,ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে। দেখলাম,তোমার নিথর দেহখানা পড়ে আছে।
আসে পাশে বসে আছে কয়েকজন,তার মধ্যে দুএকজনকে দেখেই চিনলাম,এরাই তোমার কুলাঙ্গার সন্তান।
মজনু মিয়া,ক্ষমা কর। ক্ষমা কর তোমার অকৃতজ্ঞ সন্তানদের,আমাকে,ছমেদ মিয়াকে,এই দেশকে। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া মৃত্যুর আগে তোমার কিছুই করা হল না।
ইতি,
একজন ব্যর্থ মানুষ যে তোমার জন্য কিছুই করতে পারল না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।