প্রতিকণা শিশিরেই থাকে দূর কোন সমুদ্রের স্মৃতি। প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে কোন না কোন মানুষ...
তোমরা দেখ গো আসিয়া
কুঞ্জ ধরে শ্যাম দাঁড়াইছে
নেপূর পায়ে দিয়া। ।
ঢেউ ভাঙা পানের বরজে লাজুক দাঁড়ায় ধলেশ্বরীল জল, শরীরে পাখা গজালে নাম নেয় যারা মেঘপক্ষী। মেঘপক্ষীর পালকে আলোর ধোঁয়া, কোমরে ঝুনঝুন করে উঠে সোনালু ফুলের কুড়ানো রেনু।
টিয়ার বুকের মতো রঙ জল ছিটায় শিউরে উঠা পানের দেহে।
সে দেহে তোমার স্বর্নগন্ধী আঙুল চুবিয়ে স্নায়ুতে কি ছবি আকঁ, ভাবতে ভাবতে আমি বুনো হই।
ভাবতে ভাবতে আমি পথের পাশে ফসিলের গায়ে হেলান দিয়ে বসি, ভাবি, তোমার নূপুরের বাজনা কবে শেখালে চরাচরে আঁচল ছড়ানো বিপুল পানের চরকে। কবে?
আমরা যত ব্রজনারী
থাকি গো ঘুমাইয়া
(এগো) নেপূরের শব্দ শুনি
উঠি চমকিয়া। ।
তোমার পায়ে পলি ঠেকে। তুমি চোখ বোজে মাটিকণার আদুরে আলিঙ্গনের প্রতি স্পন্দন বুকে তুলে রাখ। আমি অপেক্ষায় থাকি, কখন তোমার বোজানো চোখ খুলবে, কি রঙ দেখা যাবে ও বিশাল কমলাক্ষীতে?
অমনি সেই হরিলুটের মহোৎসব। দেখ, কত রঙ! এ দেশে আজ রঙ উৎসব বুঝি? তোমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলে তুমি হাসিতে ভাঙতে ভাঙতে আমাকে শুধালে, রঙে নামবে এসো...
কিন্তু আমি চেয়ে রইলাম। আমার বুক কেঁপে গেল, আত্না ধরে প্রবল দীর্ঘশ্বাস ঝাপিঁয়ে নামলো।
তোমাকে দেখে দেখে কত শত ঋতু সাঁই সাঁই ত্রস্ততায় ঘুরে উড়ে ঝরে পড়তে লাগলো দিগন্ত ব্যাপী সে পানের বরজে...
তুমি তখন খিল খিল হাসছো, শনশনে বাতাস তোমার চুল খুলে দিলো, তোমার খোঁপায় ময়ূরকন্ঠী রঙ উপছে নামলো, রঙ বয়ে গেলো এ আকাশ হতে দূর আকাশে...
আমি বেভুল... বেভুল...
এখন বুঝি চন্দ্রাবলি
দিছেন নিকালিয়া
কানাকানি কানমন্ত্র
দিছে গো শিখাইয়া
লং এলাচি পানের খিলি
নিত তার লাগিয়া। ।
তখন পা মুড়ে সবুজের দেশে কাঁচপোকাদের কানাকানি। মুগ্ধ কণ্যার লাগি আমার হৃদস্পন্দন টের পেয়ে আমাকে চোখ ঠারে হলুদ পাখি, পাতি ডাহরের কাজলা চোখ-পল্লব। শ্যামা ফিঙেদের কৌতুহলী চোখের আড়ালে আমি তখন মাটিতে পা খুঁটে খুঁটে লাজুক হাসি।
অপরাজিতা ফুলের শিকড়ে নিশিন্দার পাতা গড়াগড়ি খায় হাসতে হাসতে। আমি চোখ পাকাই, রেগে উঠার ভান করি, নিশিন্দার গড়াগড়ি হাসিতে তখন যোগ দেয় ঝুটিঁওলা মাছরাঙা, তার পেছন পেছন নীল লেজ সুইচোরা।
এসবই তোমার নৃত্যরত ত্রিভঙ্গীর দীর্ঘ রেখায় ঘূর্ণিবাত্যার মতো ধেয়ে যায়, সুলতানের ফসলী জমিনের পুরুষ্ট ছবির মতো আলগোছে আঁকা হয়ে যায় চরের সুকোমল প্রান্তে, উঠোনে।
তোমার চুড়িতে চোখ রগড়ে নিয়ে বাতাসে গোত্তা খায় এক ঝাঁক নীলকান্ত পাখি। তুমি তাদের মৃদু বকে নিয়ে আরো দূরে কেটে যাওয়া লাল এক ঘুড়িকে বুকে তুলে নিলে মমতা ভরে।
আমার তখন ইচ্ছে করে, ঘুড়ি যদি হই, কেটে যাওয়া লাল ঘুড়ি এক...
ব্রজ কিশোর দাসে বলে
শোন গো ধনি রাইয়া
আর নয় বিলম্বের কাজ
শ্যাম রইছে দাঁড়াইয়া। ।
গোধূলী থমকে রইল তখন জল-স্পর্শী পানের বরজে, মাইলের পর মাইল ছোঁয়াচে কমলা আলো আকাশের ঠোঁট হতে তোমার গালের আভায় ছড়িয়ে গেল। তোমার আভা ছিটকে নামলো পানের ডগাতে, মাথা নেড়ে নেড়ে তারা গোধূলী ছড়াতে লাগলো কাউন শিরীষ বটের দিঘীতে।
তুমি এবং গোধূলী- সহোদরার মতো গলাগলি ধরে বউচি গোল্লাছুটে মেতে উঠলে।
চোখের তারায় আলো ফুটিয়ে আমাকে আবার শুধালে, গোধূলীতে নামবে এসো...
পৃথিবী ঝনাৎ করে বাজাল যাবতীয় কৌতূহল। আমার পায়ের পাতায়, পদক্ষেপের স্নায়ুতে তির তির করে কেঁপে উঠলো শ্রাবণ জলের কোলাহল, বোশেখ ঝড়ের অস্থির দাপাদাপি। আমি তোমার মুখের দিকে চাইলাম, গগন গগন ব্যাপী ছড়ানো মহাদেশের সুবিন্যস্ত রূপ কলকলিয়ে উঠলো মহাশূন্যের দিকে...
কচি কিশলয় মৃদু শিষ বাজিয়ে আবাহনী গান গাইতে থাকলে আমি পা মুড়ে সে মাতাল রঙের দেশে লিখতে বসি তোমার বন্দনাগীতি...
১৩ জুলাই ২০১৩
ছবি উৎস: গুগল
ছবি: Girl Streched out on the Grass(১৮৯০),
শিল্পী: Pierre-Auguste Renoir
স্টাইল: Impressionism
গান: ইটালিক হরফে লেখা এটি সিলেট অঞ্চলের একটি ধামালি গান।
সংগ্রহ: গিয়াসউদ্দীন আহমদ সম্পাদিত বই "ধামালি গান -১", পৃষ্ঠা ৭১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।