আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।
ঠিক যেই সময়ে এসে রেজিগনেশন লেটারটা টাইপ করে বসের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন গলায় ফাঁস হয়ে ঝুলতে থেকে জীবনীশক্তি শুষে নেওয়া টাইটা একেবারে ওয়েস্টেজে ছুঁড়ে ফেলে দিলো তখন বৃষ্টি আসি আসি করছে কিন্তু আসছেনা । আবার অসহনীয় ভ্যাপসা গরমটাও তীব্রভাবেই মেজাজ বিক্ষিপ্ত করে রেখেছে ।
তবুও রেহমানের মনে হলো অনেকদিন পর প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে এমন কোন উপলক্য্গ যেন খুঁজে পেয়েছে । তার আরো মনে হতে পারতো যেন দিনের পর দিন আপাদমস্তক খচ্চরের মতো জীবনধারণ করার পর অবশেষে কোন এক দৈব ক্রমে সে স্তন্যপায়ী জীবে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে ।
কিন্তু সেটা ভাববার মতো সামান্যতম অবকাশও তার ক্ষমতার মধ্যে নেই অনেকদিন হলো । রেহমান আচমকা নিজের শরীরে টক টক স্বাদ অনুভব করে । খুব সম্ভবত একটু পরেই বমি আরম্ভ হবে । তবু হলোনা । ভীড় একটু কম দেখে রেহমান দ্রুত একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লো ।
গত রাতের কথা পুনরায় মনে পড়লে রেহমান দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো । বাসায় কিংবা অফিসে কর্মদিবসের শেষ দিবসে সহকর্মীদের কাউকেই কিছু জানায়নি । আজকাল রেহমানের প্রায়ই মনে হয় প্রত্যেকেই আসলে যখন কথা বলে , নিজেদের আবেগ – অনুভূতি প্রকাশ করে সব সময়েই অদৃশ্যমান কিন্তু প্রবল অস্তিত্বশীল রুপে কোন এক দোভাষী প্রতিটি কথা ও কাজের পিছনে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে । পিছন থেকে প্রত্যেককে চালায় । রেহমান সবচেয়ে বেশী এমনভাবে ভাবে যখন সকালে উঠে পত্রিকা পড়ে ।
খবরের কাগজে হেডিং থেকে শুরু করে শেষ পৃষ্ঠার সবচেয়ে কোনায় থাকা খবরটাও সে পড়তে বাদ রাখেনা । কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে তীব্র মানসিক চাপ অনুভব করে । আরো বেশী বিপর্যস্তবোধ করতো এতোদিন অফিসে আসলে । যেন সমগ্র পরিপার্শ্ব নিমেষেই বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে পরিণত হয় । কিংবা বিপরীতটাও হতে পারে ।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এক হাজার বর্গমাইলও অতিক্রম করা হয়না তার মতো অনেকের তবুও কতো নিশ্চিন্তে দেশ – জাতি , সমাজ – সংসার , রাজনীতি – অর্থনীতি সব বিষয়েই প্রভূত জ্ঞান অর্জন করে বসে আছে তারা সবাই । যেন নীলক্ষেত থেকে সেকেন্ডহ্যান্ড আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই কিনে আত্মস্থ করে ফেললেই সকল জ্ঞান শরীরের প্রতিটি কোষের ভেতর প্রবেশ করে জানাশোনার সর্বোচ্চো ধাপে পৌঁছে যাওয়া গেলো । এই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা ডিরোজিও বেঁচে থাকলে কি ভাবতেন রেহমান জানেনা তবুও তার ধারণা তারা প্রত্যেকেই বিদগ্ধ পন্ডিত হবার পরিবর্তে সিনিকাল হয়ে উঠতেন । যেমনটা তার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষই হয়ে গেছে । নাকি সে সিনিকালই হয়ে উঠতে চেয়েছিলো ?
নিজের ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো এতোদিন রেহমান তার কিছুই টের পায়নি ।
কিংবা বলা যায় সেই বোধের সীমার ভেতরে প্রবেশ করেনি । কিন্তু পরশু রাতে ওষুধ কিনতে বের হবার পরে যা দেখলো প্রথমে ভেবেছিলো এড়িয়ে যেতে পারবে যেমনভাবে পেরেছে এতোদিন । কিন্তু কিছু আর্মির বুট দিয়ে পাড়াতে পাড়াতে জ্বলজ্যান্ত কোন পূর্ণবয়ষ্ক পুরুষ মানুষের অন্ডকোষ ফাটিয়ে ফেলার মতো ভয়াবহতায় যখন সেই দৃশ্য এসে উপনীত হলো বিনা কারণেই এক তীব্র ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে বসলে রেহমান ছেঁড়া চপ্পলেই রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে আরম্ভ করেছিলো । সমস্যাটা শুরু হয়েছে তারপর থেকে । রেহমান অবশ্য মনে করে আসল ঘটনা ভিন্ন ।
তার অনেক জটিলতার সহজ উত্তর পেয়েছে পরশু রাতের ঘটনাটা থেকেই । কিন্তু এরকম একটা নৃশংস ঘটনাই কেন তার অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়ে দাঁড়ালো বিষয়টা রেহমানকে প্রচন্ড রকম ভাবাতে থাকে । সেই ভাবনায় ছেদ পড়ে তীব্র ঝাঁকুনীতে লোকাল বাসটি থেমে যাওয়ায় ।
রেহমান দেখতে পায় ঠিক তার গন্তব্যের সামনেই বাসটি এসে ঝাঁকি দিয়েছে । দ্রুত বাস থেকে নেমেই চারপাশ ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলো ।
চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে যেখানে আজকাল জেনারেশন গ্যাপ তৈরী হয়ে যায় সেখানে আট বছর পর একটা জায়গায় এসে চারদিক ভালো করে না তাকিয়ে চেনা কোন রেস্টুরেন্টও খুঁজে পাওয়া যায়না । তার উপর রেহমান খুঁজতে এসেছে একটা সেমি – বস্তি ধরণের জায়গা । সেই জায়গার ভেতরের দিকে থাকা ছোট্ট একটা থাকবার জায়গা যাকে ঘর বলা যায় কিনা রেহমান বলতে পারেনা । সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সেই ঘরের ভেতর সফেদ লুঙ্গি পরিহিত একজন বছর সত্তুরের বুড়ো ভদ্রলোক । সেই লোক রেহমানের জীবনে .........
রেহমান ভাবনাটাকে আর এগিয়ে যেতে দেয়না ।
আগে খুঁজে পেতে চায় তারপর অনেক ভাবনার ডালা একসাথে খুলে দেবে । আর কোনভাবেই পেরে উঠছেনা । যেন জেল পালানো কয়েদীর মতো এদিক থেকে ওদিক করে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর । হঠাৎ একটা ফুটপাথের উপরে শিমুল ডালের উপর চোখ চলে গেলে আচমকা সামনে এসে পড়া মোটরকার প্রাণপণে প্রবল শব্দে ব্রেক কষে রেহমানকে সাবধান থাকবার রিমাইন্ডার দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যায় । রেহমান বিশেষ ভ্রুক্ষেপ করেনা ।
শিমুল ডালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে ঠিকানাটা মনে করে ফেলতে পারে ঠিক ঠিক । যাক , অন্তত স্মৃতিশক্তিটা মোটামুটি অক্ষতই আছে বলা চলে ।
মিনিট পনেরো পর সেই কাঙ্খিত স্থানটির দিকে রেহমান ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে । এতোক্ষণে সে অনুভব করে দুপুরে পেটে কিছু পড়েনি । গলিটার ডান দিকে একটু সরে এসে ক্লান্ত রেহমানের নজরে আসে আট বছর পরেও সেই চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া পাতিলটা ঠিক আগের জায়গাতেই আছে ।
রেহমান উৎফুল্লবোধ করতে থাকে । কিন্তু সেই আনন্দকে ক্ষণস্থায়ীও বলা যায়না ।
সেই ছোট্ট ঘরের ভেতর থেকে কুৎসিত চিৎকার – চেঁচামেচি আসছে । রেহমানের পরিচিত সেই বুড়ো ভদ্রলোক গলার উচ্চস্বর সর্বোচ্চো পর্যায়ে নিয়ে এনে রেহমানের অপরিচিত কন্ঠস্বরে বলে চলেছে “ তোরে কইলাম এইবারে অন্তত একটু কর । এতো কইরা কইলাম তবু তিন ঘন্টা কোন কাস্টমার নিলিনা ।
কেমুন করে চইলবো ? তিনদিন আছি না খাওয়া , শরীল জ্বইলা যাইতেছে বুঝোসনা শালী ? গতর একখান বানাইছোস কিন্তু মাইনষে দাম দেয়না ক্যান ? না নিজে বাঁচবি আর শেষ বয়সে আইসা আমারে বাঁচতে দিবি । “ অতঃপর কথা শেষ হতেই সম্ভবত দুমদুম করে সেই নারীর শরীরে কিল – ঘুষি শিলাবৃষ্টির শিলার মতো পড়তে থাকে অনবরত । সেই নারী প্রবল স্বরে কান্না শুরু করে । কিন্তু আশ্চর্জনকভাবে সেই জায়গায় থাকা অন্যদের কেউই কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না । সম্ভবত ইতোমধ্যেই তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ।
তাহলে কি ? ............
ক্লান্ত – পরিশ্রান্ত রেহমান অবশেষে যখন ঘটনার আকস্মিকতায় ক্রমাগত হড়হড় করে বমি করতে আরম্ভ করলো তাতে সে ছাড়া সেই জায়গায় উপস্থিত অন্য সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো । একজন অচেনা আগন্তুক ঘরে প্রবেশ না করেই এভাবে বমি করতে আরম্ভ করেছে এই দৃশ্য আদপেই স্বাভাবিক কিছু না । এদিকে রেহমান বমি করেই চলেছে । তবুও সে স্বস্তিবোধ করে । তার মনে হতে থাকে যেন দীর্ঘদিনের চোখ বুঁজে থাকা ক্লীবের জীবনের সমস্ত নোংরা বমির সাথে সাথে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে ।
ঠিক রেহমানের ফেইন্ট হয়ে পড়ার মুহূর্তে রেহমানের পরিচিত সেই বুড়ো ভদ্রলোক যখন চিৎকার – চেঁচামেঁচি থামিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে গেলেন তখন তীব্র শারীরিক প্রহারে বিপর্যস্ত সেই নারী বুড়া বাপের জন্য রুটি বেলতে আরম্ভ করে । আজকাল বুড়োর মুখে রুটি ছাড়া অন্য কিছু রোচেনা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।