চারপাশে তাকালে দেখি সবকিছু উল্টো। যখন বইয়ের পাতায় থাকি দেখি লেখা আছে মহান ব্যক্তিদের কথা, তাদের কর্ম। আদর্শ কথাটা অনেক বড় অর্থ নিয়ে ধরা দেয় তখন। মলাট বন্ধ করার পর মনে হয় আদর্শ নামক ফুটবলটাকে গোলপোস্টে পাঠাতে সবাই ব্যস্ত। কনফিউশনে পড়ি, কোনটা আসল? মলাটের ভেতরের জগত নাকি বাইরের।
একটা মেয়েকে কেউ ধর্ষণ করল। সমাজ তাকে বোঝাতে চায়, "তুমি সতীত্ব হারিয়েছ। " কিন্তু ধর্ষককে কেউ বলে না,"তোমার চরিত্র হারিয়েছ। " নির্যাতিতার ছবি পত্রিকায় ছাপাবে না। তাতে নাকি সম্মান যায়।
কিন্তু দুইহাত দুইপায়ের একটা জন্তু আদালত থেকে বীরদর্পে বের হওয়ার ছবি ঠিকই ছাপাবে।
কেউ চায় বিয়ে করতে। ভাল কথা। কিন্তু লাখ টাকা না থাকলে তা সম্ভব না। আবার পকেটে ১০০ টাকা থাকলেই কেউ ব্যভিচার করতে পারে।
রাস্তার পাশে একটা মেয়ে সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রসমাজের লোকেরা নাক সিটকে বলবে, " '_____' কোথাকার, '_____' করার জায়গা পায় না। " বাড়ি ফিরে যখন নিজের মেয়েকে কোলে নেয় তখন ভেবেও দেখে না রাস্তার ঐ মেয়েটিও একদিন এই শিশুকন্যার মতই ছিল। বাজারে একটা কাগজের খুব দাম। ব্যাংক থেকে ছাপায়।
গায়ে লেখা থাকে ১, ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০, ১০০০।
এই কাগজটার অভাব না থাকলে আজ নিশ্চয়ই গালিগুলো হজম করতে হত না। তার মানে কী মানুষের চেয়ে ছাপানো কিছু কাগজের মূল্য বেশী?
সারাদিনের কর্মব্যস্ত শহরটা এখন মৃতের মত। এর ভেতরেই একটা ঘরে শোনা গেল শব্দ। গৃহকর্তা প্রাণ ফিরে পায়।
দিনে যতই পরিশ্রমের কাজই করুক না কেন, অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুককে দেখে যেন শক্তি ফিরে আসে। "চোর" "চোর" "চোর" চিৎকারে মহল্লার লোক তো বটেই পারলে দেশের লোকও জেগে উঠে। "শালা চোর কোথাকার, ধর ব্যাটাকে। " পরদিন খবরের কাগজে উঠবে, "গণপিটুনিতে চোর নিহত, খুশিতে এলাকাবাসীর মিষ্টি বিতরণ। " যেই হাত দিয়ে আজ এক চোরকে মেরেছে, সেই একই হাত দিয়ে ভোটের দিন অন্য এক চোরের সমর্থনে ব্যালটে সিল ঠিকই মারবে।
ছোট ছেলেটার কাধে বিশাল এক ব্যাগ। ভেতরে যে পরিমাণ বই খাতা তা অতীতের মহান জ্ঞানীরাও বহন করতেন কিনা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আগের দিনে ঘুম ভাঙত সূর্যের আলোও। এখন ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। উঠেই দৌড়।
স্কুল, প্রাইভেট এমন সব জায়গাগুলো যেন স্টপেজ। বাড়ি ফেরার সময় টোকাইদের খেলা আড়চোখে তাকায় শিশুটি। "ইশ, ওরা কত মজা করে?" এইভাবেই দিন কাটে। সময় এগিয়ে যায়। মহান সব লেখকদের কেউ মনে রাখেনি।
টলস্টয় একটা গল্প লিখেছিলেন, নাম 'কতটুকু জমি দরকার'।
ভূমির লোভে মত্ত গল্পের নায়ক পাহম মাত্র সাড়ে ছয় ফুট জমি পেয়েছিল কবরের জন্য। এইসব আর কেউ পড়ে না। টিভিতে নাটকের তো অভাব নেই। দেখতে সময়ও বেশীক্ষণ লাগে না।
কী দরকার অত কষ্ট করে বই পড়ার। বই পড়লে প্রাইভেটের পড়া কবে পড়বে?
ছেলেটা আস্তে আস্তে বড় হয়। ইদানীং নতুন কিছু গান শিখেছে। বন্ধুরা মিলে গাইতে শুরু করে, "চলে গেছ তাতে কী? নতুন একটা পেয়েছি। " "চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে?" টিভিতে দেখায়, "ছেলেটা মেয়েটাকে ভালবাসে, তার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত।
" মেয়ের জন্য জীবন দেয়ার 'শিক্ষা' ফ্রীতে পায়। কিন্তু ন্যায়ের জন্য জীবন দেয়ার শিক্ষাটা মলাটেই বন্দী থাকে। বছরে একবার আলো বাতাসের দেখা পায় কিনা সন্দেহ আছে।
"গুরুজনকে মান্য করিবে", "সদা সত্য কথা বলিবে" এইসব নীতিবাক্য আর শোনা যায় না। বরং উল্টো চর্চাই বেশী।
"মা বাবার অমতে পালিয়ে বিয়ে করল অমুক", "মিথ্যা মামলায় অমুক কারাগারে" এইসব কথার জয়জয়কার।
"আমরা সেই জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি"।
আহ! শুনলেই বুকের ভেতর কেমন জানি লাগে। রক্তচাপ নিম্ন থাকলে কিঞ্চিত বাড়ে। রাত নামলেই আবার হিন্দি নাটকের উৎসব।
বাংলাকে কোমায় পাঠাতে দেরী হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, "ফ্যাশন হল মুখোশ, স্টাইল হল মুখশ্রী"।
সবাই এখন ঐ মুখোশ নিয়েই ব্যস্ত। অমুক স্টার এভাবে চুল কাটে। আমারও তেমন চাই।
অমুক অভিনেত্রীর এই শাড়ি পড়েছে। চাই চাই, যে করেই হোক। নিজস্ব স্টাইলের ধার ধারে না।
বিদ্যাসাগর মাকে দেখতে সাতরে নদী পার হয়েছিলেন ছুটির তোয়াক্কা না করেই। আজকাল সন্তানেরা বলে, "ছুটি দিতে চায় না, পেলেই চলে আসব।
"
মদপানের অপরাধের কারণে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলা খলিফা উমর, রাতের বাগদাদে ঘুরে বেড়ান আরব্য রজনীর খলিফা হারুনুর রশীদ, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের জন্য নিজের চোখের কোটরে পিন ঢুকিয়ে দেয়া স্যার আইজ্যাক নিউটন, ব্রিটিশ সিংহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বাংলার বাঘ তিতুমীর কিংবা দলিত বলে স্কুলের বারান্দায় বসে ক্লাস করত আম্বেদকর বলে যেই ছেলেটা, এরা কেউ আর আদর্শ না। তাদের জায়গায় এখন আছে অমুক তমুক খান, দু দিন পর পর স্ত্রী বদল করা মানুষ, বিবাহিত না হয়েও বিবাহিতের মত জীবনযাপন করা লোকেরা। তাদের লাইফস্টাইলটাই মুখ্য, আদর্শ আছে কিনা তা দেখার সময় কোথায়?
একটা প্রশ্ন করি, কোনদিকে যেতে ইচ্ছে করে? স্রোতের দিকে নাকি উল্টো দিকে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।