মন ভাল নেই... বাঁশের কঞ্চির ওপর, গাছের মগডালে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা শুধু পাখির পালকের শব্দ। বাঁশে বাঁশে, গাছে গাছে, ঝোপঝাড়ে বাসা বেঁধে পাখিরা ছানাদের আদর করছে, খাদ্য মুখে পুরে দিচ্ছে মা পাখিরা। টিনের চালে, বাড়ির আশপাশের ধানক্ষেত, ডোবা, মাছের অভয়ারণ্য সবখানেই পাখি আর পাখি। ওরা ঘুরছে, খেলছে আপন মনে। সারাক্ষণ কিচির-মিচির শব্দে ভরপুর থাকে বাড়ির আশপাশ।
এ যেন পাখিদের স্বর্গরাজ্য।
বৈশাখ মাসে মা পাখিরা এসে বাসা বাঁধে। তারপর ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটিয়ে ভাদ্র মাসের শেষে চলে যায় অজানায়। তবে সারা বছরই এই বাড়িতে পাখির উৎসব চলে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এখানে পাখিদের বসবাস।
এলাকার মানুষ তাই এই বাড়ির নাম দিয়েছে ‘আরক আলির পাখিবাড়ি’।
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার দক্ষিণ জনপদ টেংরা ইউনিয়নের মনু নদীর বাঁধের পাশের গ্রাম হরিপাশা। এই গ্রামেরই একটি বাড়ির নাম পাখিবাড়ি। বাড়ির বড়ুয়া বাঁশ, জাই বাঁশ, বেতুয়া বাঁশ, আম, কাঁঠাল, জাম, নারিকেল, শিমুল, নিম, কড়ই, জাম্বুরা ইত্যাদি গাছে পাখিদের বাসা আর বাসা। বাড়িটির চতুর্দিকের গাছগাছালিতে অন্তত শ পাঁচেক পাখির বাসা রয়েছে।
আর পাখির সংখ্যাও হবে কয়েক হাজার।
শীত মৌসুমে বাড়িটি মুখর থাকে দেশীয় চড়ুই, ঘুঘু, সারস, মাছরাঙা, দোয়েল ইত্যাদি পাখির কলকাকলিতে। আবার গ্রীষ্ম থেকে শুরু করে এই শরতে বিশেষ করে বৈশাখ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত সাদা বক, কানি বক, জাটিয়া বক, পানকৌড়ি, বাঘা ডাইয়া ইত্যাদি।
শরতের সকালে বাড়ির বাঁশ ও গাছে ছানা পাখি ভরপুর থাকে। এ সময় মা পাখি ও বয়স্ক পাখিরা খুব ভোরে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।
কয়েক মাইল দূরে কাউয়াদিঘি হাওর কিংবা হাওর কড়াইয়াতে এরা চলে যায়। সন্ধ্যার সাথে সাথেই ফিরে আসে ঝাঁক বেঁধে। তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়, যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।
এই পাখিবাড়ির কর্তা আরক আলি জানান,স্বাধীনতার পরের বছর থেকেই পাখিরা তার বাড়িতে আসতে থাকে। একসময় তাদের ৯৬ শতক জমির সবটুকুই পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়।
ধীরে ধীরে পাখিদের সাথে তার পরিবারের সদস্যদের সখ্য বাড়তে থাকে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় অন্যদিকে। পাখির মলমূত্রের গন্ধে পরিবেশ নষ্টসহ রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন রাজনগর পশু হাসপাতাল থেকে জীবানুনাশক ওষুধ তাকে দেওয়া হয়।
তিনি জানান, সারা বছর কয়েক হাজার পাখি তার বাড়িতে হাজার হাজার ছানার জন্ম দেয়।
এই ছানারা বাড়ির ফলদ বৃক্ষের ফলমূল খেয়ে উজাড় করে ফেলে। তবে তিনি বা তার পরিবারের সদস্যরা এখন এজন্য দুঃখ করেন না।
তিনি জানান, একসময় পাখিদের মায়ার বাঁধনে তিনি জড়িয়ে পড়েন। তাই বাড়ির দক্ষিণ দিকে মনু বাঁধের পাশের বদ্ধ জলমহাল ৪২ একর ভূমি বাংলা ১৪০৯ সালে ৭ বছরের জন্য ইজারা নেন। এই জলমহালে বড় মাছের অভয়ারণ্য তৈরির পাশাপাশি পাখিদের খাবারের জন্য ছোট মাছও উৎপাদন করেন তিনি।
কিন্তু ১৪১৬ বাংলা থেকে সরকার জলমহালটি ইজারা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েন।
তিনি জানান, মৌলভীবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, মাছের অভয়ারণ্যের পাশাপাশি পাখির অভয়ারণ্যের ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু তিনি বদলি হয়ে যাওয়ায় আর সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে রাজনগর উপজেলা অফিসে এ সংক্রান্ত একটি ফাইল প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি জানান।
রাজনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পরিতোষ হাজরা বাংলানিউজকে জানান, আমি কিছুদিন হলো এখানে যোগ দিয়েছি।
ফাইলটি কী পর্যায়ে আছে খোঁজ নিয়ে দেখব।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, এ সংক্রান্ত একটি ফাইল সরকারের প্রক্রিয়াধীন। এটা বাস্তবায়নের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
এটি বাস্তবায়ন হলে আরক আলির অনেক দিনের বাসনা পূরণ হবে। অন্যদিকে পাখিরাও পাবে নিরাপদ আবাস।
যাবেন কীভাবে: ঢাকার সায়েদাবাদ অথবা ফকিরাপুল থেকে খুব সহজে বাসে মৌলভীবাজার যাওয়া যায়। শ্যামলী, হানিফসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস রয়েছে। ভাড়া পড়বে আড়াইশ’ টাকা। রাজধানী থেকে মৌলভীবাজার যেতে সময় লাগবে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এছাড়া কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে মৌলভীবাজার যাওয়া যায়।
কমলাপুর স্টেশন থেকে জয়ন্তীকা, পারাবত ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যেতে হবে। এরপর সেখান থেকে ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে খুব সহজে বাসে মৌলভীবাজার যাওয়া যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।