লিখে যেতে চাই সাহসী হাতে
অনেকক্ষণ টানা ভ্রমণের পর মহাজাগতিক হলঘরটায় পৌঁছলাম । অনেকক্ষণ সময়টা কতক্ষণ সেটা হিসেব করে বলতে পারব না । সময়টা কয়েক ঘণ্টা , দিন বা মাস ও হতে পারে ।
সে এক অন্য রকম যাত্রা , আমি যেন তুচ্ছ , অতি নগণ্য এক বালুকণা , এক বিশাল , হ্যাঁ অতি বিশাল নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে ছুটে চলছি । আমার গতিটা ছিল অবিশ্বাস্য ।
পৃথিবীর কোন জেট বিমান বা রকেট কোন কিছুর সাথে এর তুলনাই চলবে না । আর অমন অন্ধকারও পৃথিবীর কেউ দেখেনি কোনদিন ।
অন্ধকারে , প্রচণ্ড গতির সেই যাত্রা একসময় শেষ হল ।
- আর আপনার কেমন লাগছিল ? সোজাসুজি বা দিকে দাঁড়ানো লোকটা আমায় জিগ্যেস করল । মেরুদণ্ডে আঘাত জনিত কোন কারণে তার মৃত্যু হয়েছে ,পিঠে বিকৃত একটা ভাঁজ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে ।
- হুম , অনুভূতি কেমন তা তখন ই বলা যায় যখন পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে আপনি কোন একটা কিছু আপনি অনুভব করেন । নিকষ কালো অন্ধকারে , অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু অনুভব করা কঠিন । তবে কারও যদি দু কানে জল ঢোকার পরের সেই ভারসম্যহীন অভিজ্ঞতাটা মনে থাকে তাহলে আমারটাও বোঝা সহজ হবে ।
-
- কিন্তু জানেন , আমার ভ্রমণটা ছিল ঠিক আপনার উল্টো । খর্বাকৃতির গড়নের একজন বলল যার শরীরটা সম্পূর্ণ ঝলসানো ।
- আপনি কি আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন ?
- হুম আমি চীনের ফুজিয়ান ফুজিয়ান প্রদেশে একটা খনিতে কাজ করতাম , খনিতে আগুন লেগে আমার মৃত্যু হয় । কিন্তু জানেন আমার ভ্রমণটা ছিল খুব আলোময় ।
- আলোকময় ! আপনিতো অনেক ভাগ্যবান , তাহলে তো আপনার যাত্রাটা বেশ উপভোগ্য ছিল !
- হ্যাঁ তা বৈকি , সূর্যকে আপনার চোখের তিনহাত দূরে রাখলে আপনার যেমন আনন্দ হবে তেমন ।
- কি বলেন মশাই ! আমাদের পাশের স্ফীত পেটের মহিলা ককিয়ে উঠলেন । পেটটা আড়াআড়ি ভাবে চেরা , সন্তান হতে গিয়ে মারা গিয়েছেন ইনি ।
- খর্বাকৃতির চীনা লোকটি বলে চলল ,
চারপাশে এত আলো , সাদা রঙের তীক্ষ্ণ আলো , মনে হয় শয়ে শয়ে সূর্য একত্রে রেখে দিয়েছে কেউ , আর তাদের আলো যেন লক্ষ বিদ্যুৎ চমক , এমনকি আমার বন্ধ চোখের পাতার উপর দিয়ে মাথার মধ্যে গিয়ে মাথাটাকে ভোতা করে দিচ্ছিল ।
- আর আপনি ? আপনাকে ত দেখে ফ্রান্সের মনে হচ্ছে, আর আপনার সন্তানটিই বা কোথায় ?
- না আমি ইতালিয়ান , সিসিলি দ্বীপে থাকতাম । আমার স্বামীর ইচ্ছে ছিল ঘর ভর্তি বাচ্চা । পাঁচটি সন্তানের জন্মও দিয়েছি আমি । ষষ্ঠটি হতে গিয়েই এ অবস্থা হল আমার ।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি ।
- ষষ্ঠটির জন্য খুব খারাপ লাগছে । বেচারা জানতেই পারবে না , মায়ের চুমু কেমন , আর কেমন ই বা তার কোলের উষ্ণতা ।
জানেন আমি এ ভ্রমণটা করতে চাই নি , উদাসী হয়ে বললেন তিনি ।
একটা রক্তের সাগরে ডুবে যাচ্ছিলাম আমি , সাগর বললে ভুল হবে , সে এক মহাসাগর , এমনকি মাথার উপর যেখানে আকাশ থাকার কথা ছিল সেখানটা ছিল ফাঁকা ।
আমি অনেকক্ষণ সাঁতরেছি, তার পর একসময় ডুবে গেছি , ডুবে ডুবেই শেষ হল নোনতা স্বাদের এক যাত্রা ।
কিন্তু সব বাবা মাই কি আপনার মত হয় ? অনেক দূরে থেকে বলে উঠল সবচেয়ে কম বয়স্ক মৃত ছেলেটি । বড় জোর ১৫ বছর পৃথিবীকে দেখেছে সে ।
মুখটা নীল হয়ে আছে । ওকে সবার থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে ।
আত্মহত্যা করেছে বলে হয়ত ।
- তুমি বাছা এত অল্প বয়সে এখানে এলে কেন ? দার্শনিকের মত চেহারার উসকোখুসকো চুলের লোকটা বলে উঠলো ।
- আমার বাবা মা বিশেষ করে আমার মা যদি আমার মনটা একবারও বোঝার চেষ্টা করত , তাহলে আর আমাকে বিষ খেতে হত না । ছেলেটা ডুকরে কেঁদে উঠলো ।
- তুমি কি কারো প্রেম এ পড়েছিলে ? পেট কাটা মহিলা জিজ্ঞেস করলেন ।
- না , আমি থাকতাম ভারতের হায়দ্রাবাদে , একটা মোটর বাইকের খুব স্বপ্ন ছিল আমার । প্রথমে অনুনয় বিনয় করে বলেছি , শোনেনি , পরে খাবার বন্ধ করে দিয়েছিলাম বলে বাবা কি মারটাই না মারলেন । আর সেদিন রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এখানে আসার । দরজা বন্ধ করে বিষ খেয়েছিলাম আমি ।
- আচ্ছা বিষ খাওয়ার পর কেমন লেগেছিল ? দার্শনিকটা জানতে চাইল ।
- মনে করুন একটা ঢালাই মেশিন আপনার পেটের মধ্যে চালিয়ে দেওয়া হলে সেটা যদি আপনার পেটের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলোকে ঢালাই করতে থাকলে কেমন লাগবে আপনার ?
- আর আপনাকে দেখে ত বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে , আপনি কিভাবে এলেন ? দার্শনিকটার মত লোকটাকে জিজ্ঞেস করল সে ।
- আমি ? আমার হৃদ-যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । আমেরিকায় বাস ছিল আমার। সারা জীবনের সঞ্চয় শেয়ার মার্কেটে রাখলাম । একদিন গ্রাফটা গেল নিচে নেমে , তার পর নামতেই থাকলো ।
আর আমার হতচ্ছাড়া হৃদপিণ্ড টাও আর কাজ করবে না বলে জানান দিল ।
হটাৎ করে আমি যেন রোলার কোস্টারে উঠে গেলাম আর সেই কোস্টার যেন খাড়া আমাকে নিয়ে নিচে নামতেই থাকলো । তীব্র গতি আর পড়ে যাওয়ার ভয় দুইয়ে মিলে সমাপ্ত হল দীর্ঘ যাত্রা ।
- আমারা সবাই ত যাত্রার কথা বললাম আপনি ত একা কিছুই বললেন না , আমি আমাদের মাঝের সবচেয়ে বয়ঃ বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম । ভ্রু ও কানের পক্ক কেশ তার দীর্ঘ বয়সের ইঙ্গিত দিচ্ছিল ।
তিনি শুধু একটু মিচকি হাসলেন । অন্য কোন দিন হয়ত বলা যাবে ।
একটা ঘণ্টাধ্বনির মত শব্দ শুনলাম, আমাদের সবাইকে প্রাথমিক মৃত রেজিট্রেশনের স্তরে নেওয়া হবে , এখানে সব কিছু খুব নিয়ম মেনে হয় ।
আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম । আমাদের আগের জায়গায় নতুন মৃতরা আসতে শুরু করলো ।
মৃত্যু যাত্রায় তাদের অনুভূতি নিয়ে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।