আমারে দিবো না ভুলিতে
আপেল গাছ না চিনলেও স্টিভ জবসকে চেনেন না এমন মানুষ কমই আছেন। বিশ্বের এক নম্বর প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অ্যাপলকে দাঁড় করিয়ে ২৪ আগস্ট ঘোষণা দিয়ে অ্যাপলের সিইও পদ থেকে অবসরে গেলেন তিনি।
দত্তক শিশু থেকে প্রযুক্তিবিশ্বের যীশু
স্টিভেন পল জবস ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ফ্রান্সিসকোতে জš§গ্রহণ করেন। বাবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবদুল ফাত্তাহ জন জানদালি (সিরিয়ান মুসলিম) এবং মা জোন সিম্পসন জšে§র পর জবসকে দত্তক দেন নিুমধ্যবিত্ত পল ও ক্লারা জবস দম্পতির কাছে। ছেলেবেলায় তিনি বেড়ে ওঠেন ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে।
এক সময় এই সিলিকন ভ্যালি ছিল ই-বর্জ্য ফেলে রাখার জায়গা। বহু প্রকৌশলী সেখানে গড়ে তুলেছিলেন তাদের গ্যারেজ।
জবস পড়েছিলেন কুপারটিনো জুনিয়র হাইস্কুল এবং হামস্টিড হাইস্কুলে। স্কুল পাস করে ১৯৭২ সালে লিবারেল আর্টসের ওপর ব্যয়বহুল কলেজ রিডে ভর্তি হলেন তিনি। তাঁর নতুন বাবা-মা খুব একটা সচ্ছল ছিলেন না।
দত্তক নেয়া জবসের বাবা-মাকে কথা দিয়েছিলেন, তাঁদের ছেলেকে ভালো রাখবেন। তাই বেশ কষ্ট করেই জবসকে পড়তে পাঠালেন ব্যয়বহুল রিড কলেজে। কিন্তু বাউন্ডুলে জবসের কলেজে ভর্তির পর পড়ালেখার ইচ্ছা উবে গেল। এক সেমিস্টার পরই কলেজ থেকে ঝরে পড়লেন তিনি। হিউলেট-প্যাকার্ড বা এইচপি কোম্পানির লেকচারগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন প্রায় নিয়মিত।
সেখানে খণ্ডকালীন কর্মচারী হিসেবে কাজও করেছিলেন। এছাড়া ক্যালিওগ্রাফিসহ আরও নানা ধরনের বেশ কিছু ক্লাসে উপস্থিত থেকেছেন বিভিন্ন সময়ে।
সংগ্রামী জীবনের সূচনালগ্ন
পায়ের নিচে যার শস্য দানা সে কি ঘরে রয়! মাত্র ১৯ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে হয়ে পড়েছিলেন ভবঘুরে। কিছুদিন সাধু সন্তুর জীবন কাটান ভারতে। সহজিয়ায় আসক্ত হয়ে রপ্ত করেছিলেন ভিন্ন ধারার জীবনযাপন।
যে জীবনযাপন করতেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। কখনও খেয়ে না খেয়ে কেটেছে তার বেলা। ভালো খাবারের জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করতে হতো ছেলেবেলায়। সেই চর্চার ধারাবাহিকতাই যেন এটা। ফলমূল খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন অনেকটা দিন।
স্বাস্থ্যটাও তার হয়ে পড়ে শীর্ণ। ধার ধর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মকে।
অ্যাপল কম্পিউটার ইনকরপোরেটেড
১৯৬৯ সালে স্টিফেন ওজনিয়াক নামের এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয় জবসের। নিজের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ওজনিয়াকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জবসের শুধু ইলেকট্রনিকসের প্রতি দু’জনের সমান আগ্রহের জায়গা থেকেই। পরে একসঙ্গে এইচপি কোম্পানিতে কাজও করেছিলেন তারা।
একসময় ভবঘুরে জীবন থেকে আবারও ইলেকট্রনিকসের গোরস্থান সিলিকন ভ্যালিতে ফেরেন জবস। বন্ধু ওজকে সঙ্গে নিয়ে সার্কিট বোর্ড বানাতে শুরু করেন। তাদের বানানো সার্কিট বোর্ডের প্রসংশা করে সবাই। জবস ছেলেবেলা থেকেই ব্যবসায়িক মানসিকতার। তাঁদের বানানো বোর্ডটি বিক্রির চিন্তা ঘুরতে থাকে জবসের মাথায়।
ওজনিয়াক শুরু করলেন কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ তৈরি ও সেগুলো অ্যাসম্বলিং। এভাবেই কিছুদিনের মধ্যেই তৈরি হলো ‘অ্যাপল-২’। এটিই ছিল অ্যাপলের জš§কথা। আনুষ্ঠানিকভাবে স্টিভ জবস, স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন মিলে ১৯৭০ সালে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করলেন। ইন্টেল করপোরেশনের সাবেক এক কর্মকর্তার কাছ থেকে আড়াই লাখ ডলার ধার নিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের কাজ।
এরপর ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ২৫ বছর বয়সে স্টিভ জবসের সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেল।
১৯৮৫ সালের শেষের দিকে প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্তে নিজের প্রতিষ্ঠান অ্যাপল ছেড়ে আর এক প্রতিষ্ঠান ‘নেক্সট’ প্রতিষ্ঠা করেন জবস। চেষ্টা করেন আরও উন্নতমানের ও জটিল বৈজ্ঞানিক কাজের উপযোগী কম্পিউটার তৈরির। বিফল হলেন। হার্ডওয়্যারের বদলে তখন শুরু করেন সফটওয়্যার তৈরি।
‘নেক্সট’ বাজারে টিকতে ব্যর্থ হওয়ায় অ্যাপল একসময় ৪৩ কোটি ডলারে কিনে নিল কোম্পানিটি। এরপর আবারও অ্যাপলে ফিরলেন জবস।
গ্যারেজ থেকে স্পেসশিপ
সিলিকন ভ্যালির গ্যারেজে শুরু করা অ্যাপলের হেডকোয়ার্টার তৈরি হবে নতুন করে, এমনটিই স্বপ্ন ছিল জবসের। তাই স্পেসশিপ আকারের হেডকোয়ার্টার তৈরির কাজে হাত দিয়েছে অ্যাপল। কুপারটিনোর এ হেডকোয়ার্টার দেখে মনে হবে মহাশূন্য থেকে কোনো মাদারশিপ নেমে এসেছে পৃথিবীতে! আর এই সৃষ্টিশীল স্থাপনা স্টিভ জবসকে বিশ্ববাসীর কাছে অমর করে রাখবে।
১৫০ একর এলাকাজুড়ে তৈরি হবে অ্যাপলের নিজস্ব এই হেডকোয়ার্টার কাম ক্যাম্পাস। চারতলা এ ভবনটিতে ১৩ হাজার মানুষের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনটির মাটির নিচে এক হাজার সিটের একটি অডিটোরিয়াম, ৩ লাখ বর্গফুট এলাকাজুড়ে গবেষণাগার এবং গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নিজস্ব পাওয়ার প্ল্যান্ট থাকবে।
সাফল্যের মুকুটে সোনালি পালক
অ্যাপলের কোষাগারে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্র সরকারেরও নেই।
এমনটিই এখন বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। একপর্যায়ে জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে খরচ করার মতো অর্থ রয়েছে ৭৩.৭ বিলিয়ন ডলার, আর অ্যাপলের রয়েছে ৭৬.৪ বিলিয়ন ডলার। সাফল্যের এ সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থানের জন্য বন্ধুর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে অ্যাপলকে। আর এ দীর্ঘ পথের কাণ্ডারি ছিলেন স্টিভ। কম্পিউটারের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক পণ্য নিয়ে সাফল্যের সঙ্গেই শুরু হয় অ্যাপলের জয়যাত্রা।
স্টিভ জবসের নেতৃত্বে দূরদর্শীতায় কম্পিউটিং পণ্য হিসেবে সাফল্যের মুকুটে একে একে যুক্ত হয় সোনালি পালকÑ পাওয়ার ম্যাক, আইম্যাক, ম্যাকবুক, আইপড, আইফোন, আইপ্যাড। সম্প্রতি অ্যাপলের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম ম্যাক ওএস এক্স লায়ন বাজারে এসেছে। আরও এসেছে ম্যাকবুক এয়ার, ম্যাক মিনিসহ পাতলা ডিভাইস সংস্করণ। বাজারে আসার কথা রয়েছে আইফোন ৫ এবং আইফোন ৪-এর কমদামি সংস্করণ। আইপ্যাডের জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে চীনা এক তরুণকে আইপ্যাড-২ কেনার জন্য কিডনি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে।
এমনকি অ্যাপলের পণ্য পাওয়ার জন্য কুমারিত্ব বিসর্জনের ইচ্ছে পোষণ করেছেন এক তরুণীÑ এ সংবাদও সবার জানা। প্রায় ৯০টি দেশে ২০ কোটিরও বেশি আইফোন, আইপ্যাড এবং আইপড ব্যবহারকারী রয়েছেন।
অ্যাপল পণ্যের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিতে এর প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে একটা করে ইংরেজি ছোট হাতের ‘আই’ দিয়েই শুরু করার প্রচলন করেন জবস। ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সেটিÑ আইপড, আইফোন, আইম্যাক। আর একটু হলেই তার বায়োগ্রাফিটিরও নাম হতে যাচ্ছিল ‘আইস্টিভ : দ্য বুক অব জবস’।
তবে লেখক আইজ্যাকসন বইটির নাম বদলে সহজ নাম রাখেন ‘স্টিভন জবস’। বইটির প্রচ্ছদেও রয়েছে সহজিয়ার ছাপ। এছাড়া স্টিভ জবসকে নিয়ে লেখা হয়েছে কমিকস। ব্লুওয়াটার প্রোডাকশন্সের কমিক বইটির নাম ‘স্টিভ জবস : কো-ফাউন্ডার অব অ্যাপল’।
প্রযুক্তির নতুন পথে পাড়ি জমাতে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন জবস।
নতুন আইটেম যোগ আর পুরনোকে বিনা আবেগে ত্যাগ করতেন তিনি। তাই তিনিই প্রথম অ্যাপলের ম্যাক মিনি কম্পিউটার থেকে ডিভিডি অপশনটি সরিয়ে ফেলেন। ১৯৯৮ সালে অ্যাপলই প্রথম তাদের ডিভাইসে ফ্লপি ডিস্ক ব্যবহার বন্ধ করেছিল।
অ্যাপলের নামে ৬ হাজারেরও বেশি পেটেন্ট রয়েছে। এছাড়া একক ও যৌথভাবে ৩৩৮টি পণ্যের পেটেন্ট রয়েছে জবসের নিজের।
পিক্সার স্টুডিও নামে একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। গত বছর পর্যন্ত জবসের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৮৩০ কোটি ডলার।
প্রকাশ্যে দান করার প্রচার না থাকলেও মহান এই ব্যক্তি এইচআইভি পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং বাবদ ১০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করেছেন। ইউটু ব্যান্ডের গায়ক বনো প্রতিষ্ঠিত ‘রেড’ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ২০০৬ সাল থেকে সাহায্য করছে অ্যাপল। এমনকি লাল রঙের বিশেষ ধরনের আইপড মডেলটি এইডস বিষয়ে কাজ করা এ দাতব্য প্রতিষ্ঠানটির জন্যই তৈরি করিয়েছিলেন স্টিভ।
আফ্রিকায় এইডসের বিরুদ্ধে অ্যাপলের অবদান অমূল্য বলে উল্ল্যেখ করেছিলেন গায়ক বনো।
ব্যক্তি জবস
১৯৯১ সালে লরেন পাওয়েলকে বিয়ে করেন। পাওয়েলের গর্ভে জšে§ তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। এছাড়া এক প্রেমিকার গর্ভে জšে§ছিল একটি কন্যা সন্তান।
২০০৪ সালে জবসের শরীরে টিউমার ধরা পড়ে।
সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচার না করায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে অস্ত্রোপচারে সুস্থ হন তিনি। কিন্তু ২০০৮ থেকে আবার শরীর-স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করে জবসের। প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ফলে ২০০৯ সালে পাকস্থলী প্রতিস্থাপন করতে হয়।
কর্তৃত্বপরায়ণ নেতা
অ্যাপলের প্রযুক্তি নকল করায় স্যামসাং, নকিয়া, মটোরোলার মতো সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল অ্যাপল।
এ যেন জবসের এক কঠোর রূপ। রীতিমতো ‘একনায়ক’ খেতাব পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কোম্পানি চালানো ছাড়াও ক্যান্টিনে খাবারের মেনু থেকে শুরু করে অ্যাপল পণ্যের বিকিকিনি কোনটাই তার নজর এড়াত না। অ্যাডমিনেস্ট্রেটর হিসেবে এই কঠোরতাই হয়তো তাকে করপোরেট দুনিয়ায় সাফল্য এনে দিয়েছিল। পান থেকে চুন খসলেই স্টিভের এক মুহূর্ত লাগেনি কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিতে।
২০০৮ সালে আইফোন থ্রিজি এবং মোবাইলমি সার্ভিস ব্যর্থ হলে অ্যাপলের সম্মান নষ্ট হচ্ছে বলে স্টিভ জবস কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই একক সিদ্ধান্তে এই সার্ভিসের সঙ্গে জড়িত সবাইকে চাকরিচু্যুত করেছিলেন।
যোগ্য উত্তরসূরি
শরীরের সঙ্গে যখন আর পেরে উঠছিলেন না তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অব্যাহতির। জবস অব্যাহতি নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাজারে অ্যাপলের শেয়ারের দর ৫ শতাংশ কমে যায়।
প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান কার হাতে রেখে চলে গেলেন তিনি? এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই অবিবেচক হতে পারেন না এই বোদ্ধা প্রযুক্তিবিদ। নিজের মতো এক নেতা তৈরি করে তার হাতে অ্যাপলকে সঁপে দিয়েছেন তিনি।
যদিও সিইও পদ থেকে বিদায় নিয়েছেন কিন্তু ছায়া হয়ে তিনি রয়ে গেলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক হিসেবে। আর প্রধান নির্বাহী হিসেবে রেখে গেলেন কাজ পাগল টিম কুককে। যিনি দীর্ঘদিন স্টিভের সংস্পর্শে থেকেছেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব সামলেছেন। তিনি হয়তো স্টিভের মতো না হলেও ঠিকই অ্যাপলকে সামলে রাখবেন বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।