জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় পড়া শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিনি সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক শাহিনুর ইসলাম ১১টা পাঁচ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন। ১০৯ পৃষ্ঠার রায়ে ১১৮টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সংক্ষিপ্ত রায় ৩৭ পৃষ্ঠার।
এর আগে সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়।
এরপর তাঁকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রাখা হয়। ১০টা ৪২ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানা থেকে কাঠগড়ায় আনা হয় মুজাহিদকে। তাঁর পরনে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা ও বাদামি রঙের জুতা।
১০টা ৪৮ মিনিটে চেয়ারম্যান ও অপর দুই সদস্য ট্রাইব্যুনালের এজলাসে আসেন। রায় পড়া শুরুর আগে ১০টা ৫৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সূচনা বক্তব্য দেন।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে।
ওই এলাকায় পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
এ ছাড়া নিরাপত্তার অংশ হিসেবে প্রেসক্লাবসংলগ্ন কদম ফোয়ারা সড়ক, শিক্ষা ভবনসংলগ্ন সড়ক, দোয়েল চত্বরসংলগ্ন সড়ক ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে।
এতে এসব সড়ক দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে পথচারীরা চলাচল করতে পারছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাউকে সন্দেহ হলে তাঁর পরিচয়পত্র দেখছেন।
হাইকোর্টে প্রবেশের দুটি ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু মাজারসংলগ্ন ফটক দিয়ে বিচারক, আইনজীবী, সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। আদালত চত্বরের প্রতিটি পয়েন্টে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত সোমবার জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন।
অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে এই সাজা দেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির থাকা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার রায় নিয়ে তাই সবারই অধীর আগ্রহ ছিল। এর রেশ কাটার আগেই ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মামলার রায় দিচ্ছেন আজ। ফলে আজও সবার নজর থাকবে ট্রাইব্যুনালের দিকে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী মুজাহিদকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয়।
ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ ফেরত দিয়ে সুবিন্যস্ত করে পুনর্দাখিলের আদেশ দিলে ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি তা পুনর্দাখিল করা হয়। গত বছরের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২৫ এপ্রিল এই মামলা ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়।
এ ট্রাইব্যুনালে নতুন করে অভিযোগের শুনানি হয়। গত বছরের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-২। মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে ১৭ জন সাক্ষ্য দেন, আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন মুজাহিদের ছেলে আলী আহমদ মাবরুর। ৭ মে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়ে ৫ জুন শেষ হয়। ওই দিন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষাধীন রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
এরপর গতকাল বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে দুই সদস্যের (এক সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন) ট্রাইব্যুনাল-২ কার্যক্রমের শুরুতে আজ বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। এ জন্য মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মুজাহিদের পরিচিতি: মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ গঠনের আদেশে তাঁর পরিচিতিতে বলা হয়, ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার পশ্চিম খাবাসপুর গ্রামে মুজাহিদ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘে (জামায়াতের তত্কালীন ছাত্রসংগঠন) যোগ দেন।
১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই বছর তিনি ঢাকা জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন। একাত্তরের অক্টোবরে তিনি ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হন। ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয়লাভ করেননি।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ: মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, একাত্তরে ইত্তেফাক-এর তত্কালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যা।
দ্বিতীয় অভিযোগ, ফরিদপুরের হিন্দু-অধ্যুষিত তিনটি গ্রাম বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গিতে হামলা ও অর্ধশতাধিক হিন্দুকে হত্যার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা।
তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ হলো, ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিত্ নাথ ও গোয়ালচামট খোদাবক্সপুর গ্রামের মো. আবু ইউসুফকে নির্যাতন। পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ৩০ আগস্ট মতিউর রহমান নিজামীকে (জামায়াতের বর্তমান আমির) নিয়ে মুজাহিদ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যান। সেখানে আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদকে দেখে একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে এঁদের মেরে ফেলতে হবে। ওই সিদ্ধান্ত অনুসারে মুজাহিদ সঙ্গীদের সহযোগিতায় তাঁদের অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করেন।
ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা কলেজ) পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে মুজাহিদ দলীয় নেতাদের নিয়ে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করতেন।
সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে মুজাহিদ ফরিদপুরের হিন্দু-অধ্যুষিত বাকচর গ্রামে হামলা চালান। সেখানে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।