বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মধ্যে অর্থাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের বাইরে ছিল আরেক সরকার-'ছায়া সরকার'।
এ সরকার চালাতেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দল ও জোটের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা।
২০০৫ সালের ১১ মে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো হ্যারি কে টমাসের পাঠানো এক তারবার্তায় এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকস গত ৩০ আগস্ট বার্তাটি ফাঁস করেছে।
ওই তারবার্তায় বলা হয়েছে, জোট সরকারের ভেতর অনুগত, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যাঁরা খালেদা জিয়া এবং তাঁর বড় ছেলে ও দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন। এ তালিকায় ১৭ জনের মতো রয়েছেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতার অবস্থানকে তিনটি স্তর ভেদে দেখানো হয়েছে_ইনার সার্কেল, মিডল সার্কেল ও আউটার সার্কেল।
ইনার সার্কেলে রয়েছেন খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী), সাঈদ এস্কান্দার, লুৎফুজ্জামান বাবর, কামালউদ্দিন সিদ্দিকী, সাইফুর রহমান ও খন্দকার মোশারফ হোসেন। এঁরা খালেদা জিয়ার খুব কাছের ব্যক্তি।
কোনো বিষয়ে তাঁদের কথাকে বেশি গুরুত্ব দেন তিনি।
মিডল সার্কেলে রয়েছেন রিয়াজ রহমান, মোসাদ্দেক আলী ফালু, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ হায়দার, মীর নাছিরউদ্দিন ও মতিউর রহমান নিজামী।
আউটার সার্কেলে রয়েছেন মওদুদ আহমদ, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, মোরশেদ খান ও সেনাবাহিনীর প্রধান লে. জে. হাসান মশহুদ চৌধুরী। তাঁদের প্রত্যেকের সম্পর্কে পৃথক মূল্যায়নও পাঠান রাষ্ট্রদূত।
খালেদা জিয়া : সমালোচকরা তাঁকে অলস, অশিক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তবে দলের মূল ক্ষমতা তাঁর হাতেই। তিনি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হওয়ায় সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা লাভ করেছেন সহজেই। তিনি দলের সর্বোচ্চ পদে না থাকলে বিএনপিতে ভাঙন দেখা দেবে বলে মনে করেন দলের অনেকেই।
তারেক রহমান : তিনি জিয়াউর রহমানের কুখ্যাত বড় ছেলে এবং মায়ের উত্তরসূরি। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন ও নির্বাচনে জয়লাভে কৌশলগত বুদ্ধির প্রয়োগের কৃতিত্ব তাঁর।
৬০ জনের মন্ত্রিপরিষদের এক-তৃতীয়াংশই তিনি পূরণ করেছেন বা বিক্রি করেছেন। সমালোচকরা বলেন, তিনি খুবই নির্দয়, দুর্নীতিগ্রস্ত, একাডেমিক পড়াশোনার অবস্থাও খুব ভালো নয়, রাজনীতিতে অপরিপক্ব। কিন্তু তাঁর অনুসারীরা বলেন, তিনি স্মার্ট, ডায়নামিক ও নতুন প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদে রয়েছেন। 'হাওয়া ভবন' নামে একটি বাসা থেকে তিনিই মূলত সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
ওই ভবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে 'ছায়া সরকার'।
হারিছ চৌধুরী : খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন তিনি। দলের ভেতর তাঁর পরিচয় তারুণ্যের রাজনীতিক হিসেবে, তাঁর আচার-আচরণ অমার্জিত এবং বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়নে তাঁর সম্পৃক্ততা বেশ আলোচিত ঘটনা। তিনি যেকোনো বিষয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত মন্তব্যে পারদর্শী, যাতে সহজেই অন্যকে প্রভাবিত করতে পারেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকাচৌ) : প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা হলেও সরকারের সব বিষয়েই তাঁর হাত রয়েছে।
সাকা চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণ, মানুষ হত্যা ও অস্ত্র চোরাচালানের অভিযোগও রয়েছে। বহুল প্রচলিত ধারণা, তিনি চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। কামাল সিদ্দিকী এবং তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত শমসের চৌধুরীর ধারণা, ওই সংশ্লিষ্টতার কারণেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরানো হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পারেন।
সাঈদ এস্কান্দার : খালেদা জিয়ার ভাই তিনি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর হিসেবে সেনা কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করা ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়ে তাঁর হাত রয়েছে। তিনি নিজে সংসদ সদস্য। ভাগ্নে তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যও রয়েছে।
লুৎফুজ্জামান বাবর : স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গঠনের পেছনে তাঁর ভূমিকা অনেক। তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মতো। তিনি পরিচিত চোরাকারবারি এবং জামায়াত বা ইসলামপন্থী। তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়।
তিনি নিয়মিত থাইল্যান্ডে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসেন।
সাইফুর রহমান : তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন। সামগ্রিক অর্থনীতি, উন্নয়ন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তিনি ভূমিকা রাখছেন। রাজনৈতিক কিছু বিষয়েও তাঁর বেশ প্রভাব রয়েছে। তাঁর ছেলে অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত।
কিন্তু তিনি ছেলেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন না।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন : স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ আনুকূল্য যাঁরা পেয়েছেন, তিনি তাঁদের একজন। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ঘুষের টাকার জন্য ২০০২ সালে ইউএসএইডের অর্থায়নে আসা কনডমের চালান এক মাস আটকে রেখেছিলেন তিনি।
মোসাদ্দেক আলী ফালু : তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ব্যক্তিগত সচিব। তিনি ২০০৪ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকা-১০ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির মালিক।
মতিউর রহমান নিজামী : শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় তিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরিক তাঁর দল। আগামী ২৫ বছর পর বাংলাদেশ ইসলামী শাসনভিত্তিক দেশ হবে বলে তাঁর দল আশা করে। বাংলাদেশে টাটার ২৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের বিষয়ে প্রথম দিকে তিনি কঠোর বিরোধিতা করেন। কারণ এটি ভারতীয়।
কিন্তু পরে তাঁর এলাকাতেও কিছু অংশ বিনিযোগ হবে জানার পর তিনি এটি সমর্থন করেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।