ইমানের পরীক্ষা হয় সংকট কালে। ইমানের পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত থাকুন।
ইত্তেফাক, ১৭ জুলাই ২০১০।
-------------------------------------------------
হাওয়া ভবনের মাধ্যমে নিয়োগ ৩৬ হাজার
প্রশ্নপত্র ফাঁস০০ আবুল খায়ের ও ওয়াদুদ আলী
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসির গ্রেফতারকৃত প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুর রউফের স্বীকারোক্তিতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) দুর্নীতির কথা প্রকাশ পেয়েছে। পিএসসির তিন সাবেক সদস্য চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দলীয় আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে পিএসসিতে নিয়োগ প্রশ্নপত্র ফাঁসের বাণিজ্য করেছেন।
৩৬ হাজার প্রার্থীকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মেধাহীন, অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও দলীয় ক্যাডাররা এখন সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনে নিয়োজিত। তিন সদস্যের মধ্যে দুই সদস্য একজন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব এবং অপরজন তার প্রেমিকা ডাক্তার ছিলেন। তিনজন প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। পিএসসির এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাহিনী নিয়ে দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা পিএসসি, জিপি ও বিজি প্রেসের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের সিন্ডিকেটকে সনাক্ত করতে সক্ষম হন।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করার পর এবার গডফাদারের নাম বলেছেন, পিএসসি সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুর রউফ। তিনদিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, ‘মাহফুজুর রহমান স্যার পিএসসির সদস্য থাকাকালীন এই অনিয়মের সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়ি। সে সময় তার নির্দেশেই প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে আদায় করার দায়িত্বে ছিলাম আমি। ’ এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে মাহফুজুর রহমান জড়িত থাকার আরো তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
পিএসসির সদস্য থাকাকালে তার ছোট ভাই তৎকালীন এনজিও বিষয়ক মন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদের পিএস মামুনুর রশীদ মাজু, তৎকালীন ছাত্রদল নেতা হাসান মামুন, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পিএস মিয়া মোহাম্মদ নুর উদ্দিন অপু, বিএনপি চেয়ারপার্সনের তৎকালীন রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনকে ম্যানেজ করেই এ কাজ করতো। প্রথম দিকে মাহফুজুর রহমান নম্বর দেয়ার মাধ্যমে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করতেন। পরে এ প্রক্রিয়া পাল্টিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। মাহফুজুর রহমান বর্তমানে অবসরে থাকলেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন আব্দুর রউফ ও তাদের সিন্ডিকেট। আব্দুর রউফের স্বীকারোক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক আব্দুল মান্নান।
এছাড়াও গতকাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের স্থান ‘ভিন্ন জগতের’ ম্যানেজার জিয়াউর রহমান ওরফে নয়ন ও সুপারভাইজার মেহেদী হাসানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে তিনি জানান। আজ রবিবার গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ২ জনকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়া হবে।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা যায়, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ঢাকা কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের তৎকালীন সভাপতি ছাত্রদল নেতা, ঢাকাস্থ নীলফামারী ছাত্র কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও উত্তরবঙ্গ জনকল্যাণ সমিতির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জুবের আলম জুয়েলের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই ২টি সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, পিএসসি’র তৎকালীন সদস্য মাহফুজুর রহমানের। মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে জুয়েলকে পরিচয় করিয়ে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে নীলফামারী বিএনপি’র নেতা শাহরিন ইসলাম তুহিন, বিএনপি নেতা ও এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্সের (এ্যাব) দপ্তর সম্পাদক আহসান হাবিব লেনিন এবং রংপুরের গঙ্গাচড়ার যুবদল নেতা রুহুল আমিন। সে সময় জুয়েলকে নীলফামারীর বিএনপির রাজনীতিতে মাহফুজুর রহমান পুনর্বাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়।
এই সুবাদে হাওয়া ভবন ও তারেক জিয়ার পিএস অপুকে কাজে লাগিয়ে মাহফুজুর রহমান বিসিএস, সমাজসেবা, নির্বাচন কমিশন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে ৩৬ হাজার লোককে চাকরি দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জুয়েল প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে মাহফুজুর রহমান কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে দৈনিক ইত্তেফাককে বলেন, পিএসসি’র বর্তমান কম্পিউটার ও রেজিস্টার খাতা সার্চ করলেই সে আমলে মাহফুজুর রহমানের অনিয়মের অনেক তথ্য প্রমাণ উদঘাটন করা সম্ভব। তিনি জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্যের মাধ্যমে মাহফুজুর রহমান অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরে তার রয়েছে বিশাল ২টি বাড়ি। সিঙ্গাপুরের বাড়িটি হোটেল হিসাবে ভাড়া দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ঢাকা, নীলফামারীর সৈয়দপুর, কিশোরগঞ্জ ও রংপুরেও অত্যাধুনিক ৭টি বাড়ি রয়েছে। কিশোরগঞ্জ সদরে রয়েছে ৪ তলাবিশিষ্ট একটি বিশাল মার্কেট। নীলফামারী, জলঢাকা, সাভার ও গাজীপুরে রয়েছে ৫’শ একরের বেশি জমি। জুয়েল বর্তমানে নীলফামারীতে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
তিনি আরো জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের পুত্র তারেক রহমান দলীয় লোকজনকে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে আসীন করার জন্য বিশেষ মিশনে মাহফুজুর রহমানকে দায়িত্ব দেন।
ব্যক্তিগতভাবে তারেক রহমান আর্থিকভাবে লাভবান না হলেও তার আশপাশের লোকজন কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। প্রশাসনে তারেক রহমানের জাতীয়তাবাদী শক্তির পুনবার্সন প্রক্রিয়া সফল হলেও গোটা জাতি একটি মেধাশূন্য ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা উপহার পেয়েছে। তিনি বলেন, নিয়োগকৃত ৩৬ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে কমপক্ষে ২০ হাজার প্রার্থীর কাছে ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়মের সত্যতার ব্যাপারে তার ব্যবহƒত মোবাইল ফোনে দিনভর যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। এক পর্যায়ে তিনি ফোন বন্ধ করে দেন।
ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস সিন্ডিকেট চক্রের সহযোগীদের মধ্যে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা ইতিমধ্যেই গা ঢাকা দিয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা ও রংপুর আইনজীবী সমিতির সদস্য গ্রেফতারকৃত জিপি প্রেসের অফিস সহকারী হামিদুল ইসলাম ওরফে শেখ জিয়ার পক্ষে আদালতে জামিন নেয়ার আবেদনকারী হওয়ায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
মুদ্রন ও প্রকাশনা অধিদপ্তর
মুদ্রন ও প্রকাশনা অধিদফতরের পরিচালক মোঃ আবুল কাশেম শনিবার দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্যের মূল হোতা চিহ্নিত’ শীর্ষক সংবাদের এক প্রতিবাদে বলেছেন যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার বিজি প্রেস পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা বিজি প্রেসের মহাপরিচালক আলম আব্দুর রহমানকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর থেকে কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী অনুপস্থিত রয়েছেন তার পরিসংখ্যান জানতে চাইলে তিনি তাৎক্ষণিক কোন তথ্য দিতে পারেননি।
আজ রবিবার লিখিতভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারির নামসহ তথ্য প্রদান করবেন বলে জানান। ’
এ সংবাদটি সঠিক নয় প্রকৃতপক্ষে বিজি প্রেসে কোন মহাপরিচালক নেই। বর্তমান একজন উপ-পরিচালক (যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদায়) বিজি প্রেসের দায়িত্বে নিয়োজিত। তবে, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের একজন মহাপরিচালক রয়েছেন, যিনি সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ অতিরিক্ত সচিব। বিজি প্রেসের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের হাজিরা বিজি প্রেসে সংরক্ষণ করা হয় বিধায় তদন্ত কমিটির সাথে আলাপকালে মহাপরিচালক উক্ত তালিকা বিজি প্রেসের উপ-পরিচালক-এর কাছ থেকে সংগ্রহের পরামর্শ দেন এবং বিজি প্রেসের উপ-পরিচালককে তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেন।
বিজি প্রেসের উপ-পরিচালক, জনাব মোঃ মজিবুর রহমান জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটির গত বৃহস্পতিবার বিজি প্রেস পরিদর্শনের সময় কমিটির চাহিদা মোতাবেক তথ্যাদি সরবরাহ করেছেন। অবশিষ্ট তথ্যাদি তিনি বিজি প্রেস থেকে আজ রবিবার তদন্ত কমিটির বরাবরে প্রেরণ করবেন বলে মহাপরিচালক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরকে মৌখিকভাবে অবহিত করেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।