ক্ষুধার বলিদান
পৃথিবীতে প্রতিদিন আশি লক্ষ মানুষ না খেয়ে থাকে আর ভারতে আশি হাজার লোক রাতের খাবার না খেয়ে ঘুমায়। পৃথিবীতে সাড়ে ছয়শত কোটি মানুষ, সাড়ে ছয়শত কোটি পেট, সাড়ে ছয়শত কোটি মুখ অথচ ক্ষুধা এক। এই মাত্র আরেকটি শিশু জন্ম নিল, সেও একটি মুখ আর ক্ষুধার্থ একটি পেট নিয়েই ভুমিষ্ট হয়েছে পৃথিবীতে। তাকে নিয়ে বাড়ির লোকেদের, আত্মীয়দের আনন্দের শেষ নেই, তার জন্য খাবারের চিন্তাটাই আসে প্রথম। ক্ষুধা এমন একটা বিষয় যা জীবজন্তুর জন্মের সাথে সাথেই তার জন্ম হয়।
সোমালিয়াতেই হাজার হাজার শিশু মারা গেল কয়েক দিন আগে খাদ্যের অভাবে। আবার কোথাও চলছে বাহারি খাদ্যের মহোউৎসব। ক্ষুধার যন্ত্রনায় মানুষ কত কিছু করছে, মাটি কাটা থেকে শুরু করে অনেক কঠিন কাজ করছে। মা তার সন্তান বিক্রি করছে। একজন তার ইজ্জত বিক্রি করছে।
শরীরের অঙ্গও বিক্রি করছে কেউ কেউ। যে বস্তিতে শত-শত মানুষ সারা দিনে একবেলা খাবার পায় না, আর তার পাশেই অট্টালিকায় কেউ পাঁচহাজার টাকার নাস্তা সাজায় টেবিলের উপর।
১.
সাইফুদ্দিন চাকুরি করেন পত্রিকা অফিসে। সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজনে তাকে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটতে হয়। ছুটির দিন তাই বাসায় বসে কম্পিউটারে বিভিন্ন পত্রিকা দেখছিলেন আর বন্ধুদের সাথে চ্যাট করছিলেন।
এমন সময় তার সেল ফোনটি বেজে উঠে, সম্পাদক সাহেবের ফোন।
সাইফুদ্দিন সাহেব, কুড়িগ্রামে একটি বাচ্চা বিক্রির সংবাদ আছে। এই বিষয়ে আপনি বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবেন, এখনই আপনাকে সেখানে যেতে হবে।
তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য দিলেন আর বললেন আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাত করতে। সেই সেখানে নিয়ে যেতে পারবেন।
তিনি ছুটলেন কুড়িগ্রাম, একজনকে সাথে নিয়ে গেলেন সেই বাড়িতে। কথা হল সেই বিক্রেতার সাথে এবং প্রতিবেশীর সাথে। পর দিন পত্রিকায় হেড লাইন-
:ভাতের অভাবে মাত্র ৩৪৫০ টাকায় সন্তান বিক্রি:
সাথে উপহার পেয়েছেন বাবা একটি পাঞ্জাবী মা একটি টাঙ্গাইলের শাড়ী।
বিস্তারিত: কুড়িগ্রাম জেলার পাইশকা চরের রমজান মিয়া পেশায় জেলে, পাঁচ পাঁচটি মেয়ে, দুই ছেলে সহ মোট সাত সন্তানের পিতা। বড় মেয়ের বয়স পনের, পৃথিবীর সমস্ত যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ঐ চরে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে যৌতুকের অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা।
যদিও বাড়িতে তেমন কোন কাজ নেই তবুও মেয়েরা মায়ের কাজে সাহায্য করে। অভাবের কারনে তাদের দুইবেলা আহার জোটেনা। সবার ছোট ছেলের বয়স সাত, সে এবং তার বড় ভাই বাবার সাথে মাছ ধরতে যায়, বাড়ির নয়টি প্রাণী অক্ষর জ্ঞানহীন। গত বছর এনজিও থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে ছিল সাপ্তাহিক কিস্তিতে জাল কিনার জন্য।
২.
এত দিন সাপ্তাহিক কিস্তি ২৭৫ টাকা দিলেও সামনের সোমবারের কিস্তির টাকার যোগাড় নেই।
নদীতে মাছ নেই, প্রতিদিন খালি হাতেই ফিরে আসেন। কিস্তির টাকা আর যোগাড় হচ্ছেনা। লোক জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও একটি কিস্তির টাকা যোগাড় করতে না পারায় কিস্তি দিতে পারেন নাই।
এনজিওর লোকেরা সন্ধা পর্যন্ত বসে টাকা না পেয়ে যা-তা ব্যবহার করে অপমান করে এবং যাওয়ার সময় বলে যায়, “আগামী সপ্তাহে দুটি কিস্তির টাকা একসাথে না দিলে ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাব”। যার ঘরে খাবার নেই, পড়নে কাপড় নেই, সে পাঁচশত পঞ্চাশ টাকা দিবে কিভাবে? প্রতি দিন মাছ বিক্রি করে ৫০/৬০ টাকা যা পায় তা দিয়ে নয় জনের চাল আনতেই শেষ।
তরকারী কেনার টাকাও থাকেনা। আজ সোমবার ভোরে বাপ-বেটা তিন জন না খেয়ে প্রতিদিনের মতো নদীতে মাছ ধরতে যায়।
সকাল ন’টা বাজতেই সমিতির লোকজন হাজির, আজ সাথে আছেন বড় স্যার, কিস্তির টাকা না পেয়ে ঘরের টিন খুলে নিয়ে যায় এবং সামনের একটি কিস্তি বাদ পড়লে বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করবে বলে হুমকি দিয়ে যায। রমজান মিয়া বাড়িতে এসে দেখেন ঘরের চালে টিন নেই, কারো মুখে কথা নেই। ক্ষুধা আর অপমানের জ্বালা এক হয়ে কান্নার রোল বইছে।
তখন তার স্ত্রী বলে-
: সামনের একটি কিস্তি বাদ পড়লেই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবে।
তাদের মাথা গোজার মতো ঐ টুকুই সম্বল, তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল তা বুঝি আর ধরে রাখতে পারবেনা। রমজান মিয়া একেবারে ভেঙ্গে পড়েন।
এই অভাবের মহামারীতে সল্প পরিচিত এক লোক এসে প্রস্তাব দেয় তার একটি সন্তান বিক্রি করে দিতে। প্রস্তাব পেয়ে মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, দু’চোখের পানি আর বাঁধ মানে না।
পুরুষ মানুষের আবার কান্না কি! চোখে পানি ঝড়েনা, কিন্তু ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেন রমজান মিয়াও। তার বুকের ভিতরে বইছে তুফান, দরিয়ার ঢেউ।
নয় জনের সংসারে একবার খেলে আরেকবার খাবার জোটেনা, গায়ের জামা নেই, নেই তাদের কোন ভবিষ্যৎ। চোখের সামনে ক্ষুধার যন্ত্রনায় এত কান্নাকাটি আর সহ্য হয়না। কিস্তির যন্ত্রনায় আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা, মরণ যেন তার একমাত্র পথ।
কিন্তু মরলে সে বেঁচে যাবে তার স্ত্রী সত্নানদের দেখবে কে? তাদের ভাবনায হৃদয়ের টানে মরতেও পারেনা। তার চেয়ে একটি সন্তান গেলে সেও বাঁচবে কিস্তির টাকারও ব্যবস্থা হবে। মাথাগোজার সম্বলটুকু বাঁচবে, বাকী সন্তানরাও অন্তত কিছু দিন খেয়ে বাঁচতে পারবে।
ভাবতে ভাবতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার চোখের সামনে আর যেন কোন পথ খোলা নেই।
লোকটির প্রস্তাব মতো অনেক কান্নাকাটির পর দ্বিতীয় মেয়েটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় ক্ষুধার জ্বালায় ধুকতে থাকা পরিবারটির প্রধান। যদিও তারা কেউ ফর্সা নয় তবু ঐ মেয়েটি দেখতে বেশ ভালো। কাকে দিয়েছে তার নাম ঠিকানা কিছুই জানেনা, তাদের সন্তান আছে কিনা, তারা পালবে কিনা, এমনকি এই মেয়েকে নিয়ে তারা কি করবে তাও জানেনা। শুধু জানে মেয়েটি বাঁচবে, তারাও সবাই বাঁচবে।
৩.
সকাল থেকেই পাঠকদের ফোন বেজে উঠতে লাগল।
একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন আর ধন্যবাদে সিক্ত হতে লাগলেন পত্রিকার সম্পাদক সাহেব। তখনো মানবাধিকার কর্মিরা ঘুম থেকে উঠেনি। দুপুর ১২টার পর এক কর্মির ফোন, সে সাক্ষাতপ্রার্থী এবং এখনি পত্রিকা অফিসে আসতে চাইছেন। ঠিক আছে বলে ফোন রাখলেন সম্পাদক। সাইফুদ্দিন সাহেবের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে ৫জন কর্মী ছুটলেন সেই চরে।
তাদের সাথে শরিক হলো অন্যান্য পত্রিকার সাংবাদিক ফটো সাংবাদিকরা।
তখনো মন্ত্রীপাড়ায় খবরটি চাউর হয়নি। তাদের হাতে দেশ বিদেশের অনেক বড় বড় কাজ। কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট, ৩৪৫০ টাকা নিয়ে তাদের ভবনার সময় কই!
কর্মীরা এক একটি প্রশ্ন বানে জর্জরিত করছেন বাবা মাকে -
* আপনারা নাকি সন্তান বিক্রি করেছেন কথাটা কি সত্যি?
- হ কতাডা সত্যি।
* কত টাকার বিনিময়ে সন্তান বিক্রি করেছেন?
- ৩৪৫০ টেহা, আমারে একটা পাঞ্জাবী দিছে আর অর মায়েরে দিছে একটা শাড়ী।
-
* কয়টি সন্তান আপনাদের? আপনারা কি জানেন তারা আপনার মেয়েকে নিয়ে কি করবে? আপনারা কি জানেন কত বড় অন্যায় করেছেন? আপনারা অমানবিক কাজ করেছেন, পাপ কাজ করেছেন। আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে তখন আপনারা কি করবেন?
মায়ের বুকের এ যন্ত্রনা কোন দিন শুকাবার নয় সে যন্ত্রনার মধ্যে আরো কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলে উঠে
: ঐ ব্যাটারা আমার মাইয়া আমি বেচছি তাতে তোমাগো কি? তোমাগো এত ব্যাথা লাগে ক্যান? যখন আমরা না খাইয়া থাকতাম, পোলাপানগুলিরে খাওন কাপড় দিতে পারি নাই, চেয়ারম্যান মেম্বারগো পিছে হারা বছর ঘুইরাও পাইনা একটা কাপড়, দুই কেজি চাইল, তহন তোমরা কোথায় ছিলা কোথায় ছিল তোমাদের এত দয়া, কোথায় ছিল সরকার, এত আইন?
সাংবাদিকদের মুখে কোন ভাষা ফোটে না। কি বলার আছে তাদের? ক্ষুধার্ত মুখে অন্ন তুলে দেবার সামর্থ তাদের নেই। তবুও সংবাদ জানাতে হবে দেশের সবাইকে। গরম গরম খবর, সকাল হলেই শহরের ক্রেতাদুরস্ত সাহেবী মানুষগুলো পড়বে-
“ক্ষুধার জ্বালায় কাতর মা-বাবা নিজের সন্তান বিক্রির ব্যবসা করছে, সেই টাকায় পেটপুরে ভাত খাচ্ছে, স্ফুর্তি করছে, তাদের কোন অপরাধবোধ নেই” ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।