যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকার বাজার-সুবিধা (জিএসপি) ফিরে পেতে শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়নের প্রক্রিয়া সহজ করাসহ শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, বাধ্যতামূলক গ্রুপ বিমা চালু, নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠনসহ শ্রমিকদের বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যেকোনো কারখানা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নকশা অনুমোদন, লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়ন, শ্রেণী পরিবর্তন এবং সম্প্রসারণের অনুমোদনের আগে সরেজমিনে ওই কারখানা পরিদর্শন করতে হবে।
গত সোমবার জাতীয় সংসদে আলোচিত বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৩ পাস হয়েছে। সংশোধিত আইন নিয়ে শ্রমসচিব মিকাইল শিপার গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি বাস্তবায়নে দ্রুত বিধিমালা তৈরি করা হবে। বিধিমালা হলে প্রতিটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হবে।
শ্রমসচিব বলেন, ‘শ্রমিকদের স্বার্থ বিবেচনায় এই আইন সংশোধন করা হয়েছে। আশা করি, জিএসপি-সুবিধা ফেরত পেতে এসব উদ্যোগ ভূমিকা রাখবে। ’
ট্রেড ইউনিয়নের বিধানের বিষয়ে শ্রমসচিব বলেন, এ ব্যাপারে আইনে কখনো বিধিনিষেধ ছিল না।
আইনে এখন ট্রেড ইউনিয়নের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন: সংশোধিত শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তাদের তালিকা মালিককে অবগতির জন্য পাঠানোর যে বিধান ছিল, তা বাতিল করা হয়েছে।
পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক অথবা কোষাধ্যক্ষের পরিবর্তে সব ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তাকে তাঁদের সম্মতি ছাড়া এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি না করার বিধান রাখা হয়েছে। আগে যৌথ দরকষাকষি প্রতিনিধির ধর্মঘটের কোনো নোটিশ জারির ক্ষেত্রে তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন প্রয়োজন হতো, এখন দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন থাকলেই চলবে। ১০টি জাতীয়ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন সম্মিলিত হয়ে একটি জাতীয়ভিত্তিক কনফেডারেশন গঠন করতে পারবে।
এ ছাড়া যৌথ দরকষাকষি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে মালিক অথবা যৌথ দরকষাকষি প্রতিনিধি প্রয়োজন মনে করলে বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে পারবেন। বিশেষজ্ঞ সম্পর্কে কোনো আপত্তি উত্থাপিত হলে তা নিষ্পত্তির জন্য যেকোনো শ্রম পরিচালককে সালিসের জন্য অনুরোধ করবেন।
সংশোধনীতে আরও বলা হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা হবে, ওই প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমশক্তি বা সদস্যের শতকরা ২০ ভাগ নারী থাকলে সে ক্ষেত্রে ইউনিয়ন নির্বাহী কমিটিতে ন্যূনতম ১০ শতাংশ নারী সদস্য থাকতে হবে।
ইউনিয়নগুলো নিজেদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনার মনোনয়ন করে যৌথ দরকষাকষি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। প্রত্যেক মালিক তাঁর প্রতিষ্ঠানে দর-কষাকষি প্রতিনিধির জন্য অফিস বরাদ্দ করবে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতে কাজ করে এমন ইউনিয়নের সদস্যরা ইচ্চ্ছা করলে ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটির মোট কর্মকর্তার শতকরা ১০ ভাগকে নির্বাচিত করতে পারবেন, যাঁরা ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নন।
রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অনুরূপ কোনো কারণে ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে দুই বছর অথবা প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের ক্ষেত্রে তিন বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে ওই কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হবে।
অংশগ্রহণকারী কমিটি: যে প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন নেই, সেই প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত না হওয়া পর্যন্ত অংশগ্রহণকারী কমিটির শ্রমিক প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় পরিচালনা করতে পারবে। অংশগ্রহণকারী কমিটিতে শ্রমিকপক্ষের নির্বাচিত বা মনোনীত কর্মকর্তা ও সদস্যদের কমিটির মেয়াদকালে তাঁদের সম্মতি ব্যতীত মালিক বদলি করবেন না। অংশগ্রহণকারী কমিটির শ্রমিক প্রতিনিধিদের সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কাজের জন্য মালিক তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন বা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না।
নিরাপত্তা কর্মপরিবেশ: প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় কোনো কক্ষ থেকে বের হওয়ার পথ তালাবদ্ধ বা আটকিয়ে রাখা যাবে না এবং বের হওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না। শ্রমিকেরা যে কক্ষে কাজ করবেন, ওই কক্ষের সব দরজা এমনভাবে তৈরি করতে হবে, তা বাইরে থেকে যেন খোলা যায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে বের হওয়া যায়।
যদি কোনো দরজা দুটি কক্ষের মাঝখানে হয়, তা হলে ওই ভবনের বের হয়ে যাওয়ার পথের কাছাকাছি খোলা যায় এমনভাবে তৈরি করতে হবে এবং এ ধরনের সব দরজা কক্ষে কাজ চলাকালীন তালাবদ্ধ বা বাধাগ্রস্ত অবস্থায় রাখা যাবে না। ভবনের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎব্যবস্থা বিপজ্জনক অবস্থায় রাখা যাবে না। ছয় মাস পর পর মহড়া করতে হবে যে সব ঠিক আছে কি না।
সংশোধনীতে বলা হয়েছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনুমোদিত কারখানা ভবনের নকশার সঙ্গে কারখানার মেশিন স্থাপনের নকশার কাঠামোগত কোনো ব্যত্যয় বা পরিবর্তন করা যাবে না। অগ্নিনির্বাপণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
মালিক কারখানা ও শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে কর্মস্থলের চলাচলের পথ, সিঁড়ি, ফটক, গুদাম ও সাধারণ ব্যবহারের স্থানে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনতে পারবে।
শ্রমিক নিরাপত্তা: শ্রমিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সুরক্ষিত যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত না করে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে শ্রমিক ওই সুরক্ষার যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করলে যেকোনো ঘটনার জন্য তিনি দায়ী থাকবেন। মালিককে অবশ্যই নির্ধারিত পন্থায় একটি রেকর্ড বই সংরক্ষণ করতে হবে। পেশাগত রোগে বা কর্মকালীন দুর্ঘটনায় আক্রান্ত শ্রমিক ও কর্মচারীকে মালিকের নিজ খরচে ও দায়িত্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করতে হবে।
৫০ বা এর বেশি শ্রমিক থাকলেই প্রতিটি কারখানায় নিরাপত্তা কমিটি গঠন করতে হবে। ১০০ জন স্থায়ী শ্রমিক থাকলেই গ্রুপ বিমা চালু করতে হবে। শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিমা দাবি আদায় মালিকের দায়িত্ব। যেকোনো বিমা দাবি উত্থাপিত হলে তা ১২০ দিনের মধ্যে বিমা কোম্পানি ও মালিক যৌথ উদ্যোগে নিষ্পত্তি করবেন।
শ্রমিক কল্যাণ: কোনো শ্রমিকের এক বছর অথবা ছয় মাসের অতিরিক্ত সময়ের চাকরির জন্য তার সর্বশেষ পাওয়া মজুরির হারে ন্যূনতম ৩০ দিনের মজুরি অথবা ১০ বছরের বেশি চাকরির ক্ষেত্রে তাঁর সর্বশেষ মজুরি হারে ৪৫ দিনের মজুরি, যা ওই শ্রমিককে দিতে হবে।
সব ঠিকাদারি সংস্থাকে সরকারের কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে হবে এবং ঠিকাদার যে শ্রমিকদের সরবরাহ করবেন, তাঁরা ঠিকাদারের শ্রমিক বলে গণ্য হবেন। আর চিনিকল, চাতাল প্রভৃতি শিল্প ও মৌসুমি কারখানায় শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে আগের বছরের নিয়োগ করা শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
কোনো শ্রমিককে মৌসুমি কাজে নিয়োগ করা হলে মৌসুম চলাকালীন পর্যন্ত তিনি কর্মরত থাকবেন। যদি কোনো শ্রমিক কোনো মালিকের অধীনে অবিচ্ছিন্নভাবে দুই বছরের বেশি সময় চাকরিরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন, তবে এক বছর বা ছয় মাসের বেশি সময়ে চাকরির জন্য ৩০ দিনের এবং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় অথবা কর্মকালীন দুর্ঘটনার কারণে পরবর্তী ৪৫ দিনের মজুরি অথবা গ্র্যাচুইটি যা বেশি হবে। এই টাকা মৃত শ্রমিক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলে এবং অবসরজনিত সুবিধা পেতেন, তার অতিরিক্ত হিসেবে পাবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।