মুক্তমত প্রকাশের প্লাটফর্ম ব্লগ। তাই ব্লগে বসতে ভা্ল লাগে....। মূল্যস্ফীতি বাড়লেও বাড়েনি মজুরি
দেশের ৫ কোটি ১০ লাখ শ্রমিক ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ গত কয়েক বছরে দেশে মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বাড়লেও সে হারে বাড়েনি মজুরি হার। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বাড়ায় বিপাকে পড়েছে শ্রমিকরা।
সরকারি হিসাবে মজুরি হার বাড়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে সে হারে বাড়েনি বলে জানিয়েছে শ্রমিকরা। বর্তমানে দেশে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে এমন শ্রমিক ২১ দশমিক ১৮ শতাংশ। শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে মালিক পক্ষের চরম নিষ্ঠুরতার কথা। টুটুল সরদার নামে গাজীপুরের এক গার্মেন্টস কর্মী জানায়, বাজারে গেলে ভয় করে। পরিবার ছাড়া থাকি তারপরেও চলতে পারি না।
বাড়ির ছেলে-মেয়েদের জন্য টাকা পাঠাবো কি করে। এভাবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। অল্প বেতন তার ওপর সময় মতো বেতনটা দেয় না নিষ্ঠুর মালিকরা। মগবাজারের আমিনুল ইসলাম নামে এক গ্যারেজ শ্রমিক বলেন, মালিকরা বেতন দেয় না শুধু বকুনি দেয়। আর মাসিক যে বেতন দেয় তা দিয়ে পকেট খরচ চলে না।
জিনিসপত্রের যে দাম দু'বেলা দু'মুঠো খাওয়া দায় হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০০২-০৩ অর্থ বছর থেকে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। যেখানে ২০০১-০২ অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সেখানে ২০০২-০৩ অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর পরের বছর আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
অথচ এ সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ০৫ শতাংশ। এর ঠিক পরের অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। একই সময়ে কোনো মজুরি বৃদ্ধি হয়নি।
২০০৬-০৭ অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। এ সময়ে মজুরী বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর পরের বছর মজুরি বৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেলেও সেটি মূল্যস্ফীতির তুলনায় একেবারে কম। এ সময়ে মজুরী বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
অপরদিকে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৯২ শতাংশ।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় ২০০৯-১০ অর্থ বছরে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। অর্থ বছরের শেষে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩১ শতাংশে। এ সময়ে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
২০০৯-১০ অর্থবছরের জানুয়ারি মাসে খাদ্য-দ্রব্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। ফলে ২০১০-এর জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দাম ৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ বাড়লেও তখন খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ সময়ে সাধারণ মজুরী বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র দশমিক ১৬ শতাংশ। প্রস্তুতকৃত শিল্পেও মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র দশমিক ১৬ শতাংশ।
নির্মাণ শিল্পে এই মজুরী বৃদ্ধির হার আরো কম, মাত্র দশমিক ১৬ শতাংশ। কৃষিতে মজুরী বৃদ্ধির হার দশমিক ২২ শতাংশ। মৎস্য খাতে মজুরি বৃদ্ধির হার দশমিক ১৩ শতাংশ। শ্রমিকদের বিপাকে পড়ার আরো একটি কারণ হলো খাদ্য-দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ২০০৩-০৪ অর্থ বছর হতে দেখা যায় ব্যাপক খাদ্য বহির্ভূত মূল্য সূচকের তুলনায় খাদ্য দ্রব্যের ব্যাপক মূল্যস্ফীতি।
এ সময় খাদ্য-দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
রমনা থানা জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রুবেল হোসেন জানায়, যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তাতে শ্রমিকদের বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে। এজন্য মালিকদের আমাদের দিকটা বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, বিকাল ৫ টার কর্মঘণ্টা রাত বারোটায়ও শেষ হয়না। এভাবে দাসত্ব আর কত দিন চলবে? কোন মালিক আর যেন শ্রমিক নিয়োগের নামে প্রতারণা না করে।
আর কোন শ্রমিককে যেন কোন মালিক বিনা মজুরীতে কাজ করাতে না পারে। সেজন্য কঠোর আইন করুক সরকার।
এদিকে দেশের আগের তুলনায় নিয়মিত পারিশ্রমিকে নিয়োগকৃত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়োগকৃত শ্রমিকের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), লেবার ফোর্স সার্ভে, মনিটরিং অফ ইমপ্লয়মেন্ট (এমইএস)'র হিসাব অনুযায়ী নিয়মিত নিয়োগকৃত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য এখনো কৃষি, বনজ ও মৎস্য খাতই ভরসা। এখনো কৃষি খাতই দেশের অর্ধেক শ্রমিকদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে। বিবিএস'র হিসাব মতে বর্তমানে মোট ৫ দশমিক ১০ কোটি শ্রমশক্তির অর্ধেক কৃষিখাতে নিয়োজিত। এরমধ্যে কৃষিখাতে নিয়োজিত আছে ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তবে ১৯৯৫-৯৬, ১৯৯৯-২০০০, ২০০২-০৩ এবং ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় কৃষি খাতের ওপর নির্ভরতা কিছুটা কমেছে।
সে সময় কৃষি খাতের ওপর নির্ভরতা যথাক্রমে ছিল ৪৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ৫০ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশ। স্বকর্মে নিয়োজিত আছে ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ব্যাপক কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রশিক্ষণ, ভবিষ্যৎ কাজের আশা, পেটে ভাতে কোনো রকম বেঁচে থাকার জন্যই বড় একটি অংশ আজ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছে। সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম আইন (আইএলও) কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে।
কিন্তু শ্রমিকদের নায্য দাবি ৮ ঘণ্টা পরিশ্রম বাস্তবায়ন হয়নি। একই ভাবে দেশের শ্রমিক আইনেরও কোনো বাস্তবায়ন নেই। কোনো সরকারই এটা লক্ষ্য করে না। শিল্পখাতের উন্নয়ন হয়নি বলে আজ এ নির্ভরতা হয়েছে। এটি দূর করার জন্য বেশি বেশি শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
শিল্পভিত্তিক খাতওয়ারি শ্রমিকের অংশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাণিজ্য, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট খাত। এ খাতে নিয়োজিত আছে মোট শ্রমশক্তির ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে আছে ম্যানুফেকচারিং খাত। যেখানে নিয়োজিত আছে মোট শ্রমশক্তির ১৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। চতুর্থ অবস্থানে আছে পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ খাত।
যেখানে মোট শ্রমশক্তির ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা খাত। যেখানে নিয়োজিত আছে মোট শ্রমশক্তির ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এ খাতের পরেই রয়েছে পণ্য ও ব্যক্তিগত সেবাসমূহ। যেখানে নিয়োজিত আছে মোট শ্রমশক্তির ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।
এর পরে রয়েছে নির্মাণ খাত, অর্থ-ব্যবসা ও সেবা সমূহ, খনিজ ও খনন। যদিও এই খাতে পূর্বে বেশি পরিমাণ শ্রমিক নিয়োজিত ছিল। এসব খাতে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ছিল প্রায় দশমিক ৫১ শতাংশ। ২০০২-০৩ অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০০৫- ০৬ অর্থ বছরে তা আরো কমে যায়।
তখন দাঁড়ায় দশমিক ২৩ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে মোট শ্রমশক্তির দশমিক ২০ শতাংশ এ খাতে নিয়োজিত রয়েছে। একই ভাবে কমছে পণ্য ও ব্যক্তিগত সেবাসমূহ খাতে। এ খাতে ১৯৯৫-৯৬ অর্থ বছরে ছিল ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সেখানে ২০০২-০৩ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তির সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লক্ষ। তার মধ্যে পুরুষ ৩ কোটি ৮৫ লক্ষ ও নারী ১ কোটি ২৫ লক্ষ। ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে ছিল ৪ কোটি ৭৪ লক্ষ। এর মধ্যে পুরুষ ৩ কোটি ৬১ লক্ষ ও নারী ১ কোটি ১৩ লক্ষ। একই সময়ে সকর্মে নিয়োজিত ছিল ৪১ দশমিক ৯৮ শতাংশ শ্রমিক।
কিন্তু সর্বশেষ হিসাবে এর পরিমাণ কমে গেছে আরো ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বর্তমানে কমে এ খাতে শ্রমিকের হার দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ২২ শতাংশ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।