আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপলব্ধি কিংবা বাইপাস করা রিয়েলিটির গল্প

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা । দীর্ঘসময় যাবত হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে আমি যে জায়গাটায় এসে থামলাম সেখানে অজস্র ঔৎসুক মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি । তারা প্রত্যেকে সমাবেতভাবে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু প্রত্যেকেই প্রচন্ডরকম একা । তাদের মধ্যে সামনে - পেছনে অনেকেই অনেকের সাথে কথা বলছে । আমি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাদের অনেকেই অপরের সাথে কথোপকথনের সময় হাসিমুখ ধরে রেখেছে ।

কিন্তু স্পষ্ট ধরতে পারি তাদের চোখ রয়েছে সেই সামনেই । সামাজিক ভব্যতার আপাত সুশীল , সহজিয়া মোড়কে কোনভাবেই আত্মকেন্দ্রিকতার পুঁজকে অস্বীকার করা যাচ্ছেনা । প্রয়োজন দেখা দিলে এরা প্রত্যেকেই হিংস্র কুকুরের মত এক অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে নিশ্চিত । দিন দশেক আগে হবে সকালে রিকশা করে গন্তব্যস্থলে যাবার সময় দুটি কুকুরকে দেখেছিলাম সামনে ছুটন্ত একটি কুকুরকে তাড়া করে বেড়াতে । সেই দৃশ্যের কথা এখন আবার মনে পড়লো ।

তাদেরকে যারা লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে তাদের আনন্দ দেখবার মত । চোখ - মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে তাদের মণি-মুক্তার মত । অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পাইনা । এই একটা মাস সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ থেকে থাকলে তাদের ছাপ্পড় ফাড়কে দেবে । প্রতিবারই দিয়ে এসেছে , প্রতিবারই দেবে ।

হাতে কচকচে টাকার নোটের ক্ষমতার সমতূল্য ক্ষমতা কিছুর হতে পারে বলে আমার জানা নেই । আমি তাদের হাস্যরত মুখ , তাদের পেছনে লম্বা লাইন ধরে দাঁড়ানো ভদ্রলোকদের দেখছি । এরা সমাজের চোখে ভদ্রলোক , প্রতিষ্ঠিত তেমনি চূড়ান্ত বিশ্লেষণে প্রায় প্রত্যেকেই বাটপার । সৎপথে উপার্জিত পয়সায় প্রতিষ্ঠিত কথাগুলো বস্তাপঁচা স্কুলের পাঠ্যবইতেই অসহ্য লাগতো নির্মম , পঙ্কিল বাস্তবের কথা নাইবা বললাম । আমার অফিসের ( এখন প্রাক্তন বলাটাই শ্রেয় হবে ) যেই সাবঅরডিনেট তাকে প্রতিদিন অন্যদের সাথে গল্প করতে দেখতাম কত রকমের ইফতারী বাসায় এনে উদরপূর্তি করেছে তা নিয়ে ।

রুচিহীন , কদর্য মানুষের অভাব নেই চারপাশে । যাই হোক আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একদঙ্গল মানুষকে পকেটে পয়সাভর্তি অবস্থায় ক্ষুধার্ত কুকুরের মত অপেক্ষা করতে দেখতে থাকি । ছোটবেলায় বাড়িতে যেই দুধওয়ালা দুধ দিতে আসতো তার মৃত্যুর পর তার বউকে পরবর্তীতে দুইবার লঙ্গরখানায় দেখেছিলাম ছোট দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে । তার চেহারায় যেই প্রগাড় বেদনা দেখতে পেয়েছিলাম এই মানুষগুলোর মধ্যে তার ছিটেফোটাও দেখতে পাচ্ছিনা । এদিকে সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছি ।

দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো উসখুস করা শুরু করেছে । প্রথমে যেই হাসিমুখ দেখেছিলাম অপরের সাথে কথোপকথনের সময়ে তা ইতোমধ্যেই মিলিয়ে গেছে । যেন কেউ সিগনাল দিলেই একে অপরে উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত সবাই । সূর্যের প্রখরতার প্রভাব প্রায় স্তিমিত । আমিও আর ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাচ্ছিনা ।

অবশেষে প্রত্যেকেই দ্রুত হাতে যার যার খাবারের আইটেম নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো । ভীড়টা হালকা হতে হতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আযানের ধ্বনি কানে ভেসে আসলে সম্বিত ফিরে পেলাম । দশ প্রকারের আইটেম নিয়ে সবাই যার যার মত দিনের সংযম ভঙ্গ করবে ভাবতে গা গুলিয়ে উঠলো । একে কিভাবে সংযম বলে জানিনা । এমনসময় দেখলাম যেই জায়গায়টায় লম্বা ভীড় সেখানে নোংরা , অবিন্যস্ত পোশাকের এক নারী চলে এসেছে ।

আমার হাতে বিশেষ কাজ নেই বাড়ি ফেরার তাড়া নেই তাই সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম । সেই দোকানের মালিকরা প্রবল তাচ্ছিল্য সহকারে কিছু উচ্ছিষ্ট খাবার নারীটির হাতে দিয়ে অশ্রাব্য কিছু ভাষা ব্যবহার করে তাকে বের করে দিলো । নারীটির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই । আমি কিছু দূরে তাকে দ্রুত পায়ে হাঁটতে দেখছি । সামনে এগিয়েও তার পাশাপাশি যেতে পারবোনা বুঝতে পেরে আমি কেবল একটু দূর থেকে সে খাবারগুলো নিয়ে কি করে দেখবো বলে মনঃস্থির করলাম ।

আমি কখনোই এসব মনোযোগ দিয়ে দেখিনি , দেখবার প্রয়োজনবোধও করিনি । কিছু দূরে ঠাঁয় দাঁড়াবার পর রোগাভোগা এক বাচ্চাকে দেখলাম দুই হাত তুলে নারীটির দিকে বসে থাকতে । এসব দৃশ্য মনে রেখাপাত করেনি কখনো । এই দৃশ্যের মধ্যেও চমৎকার কিছু থাকতে পারে স্থূল মস্তিষ্কে তা প্রবেশ করেনি । আমি প্রবল কৌতূহল নিয়ে দেখতে থাকলাম নারীটির অবয়বের দিকে ।

দেখতে পেলাম অভুক্ত বাচ্চার মুখে মায়ের খাবার তুলে দেওয়ার দৃশ্য । চাকরী হারিয়ে প্রচন্ডমাত্রায় বিপর্যস্ত মনে বাড়ি ফিরছিলাম । দৃশ্যটি দেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে দেখি বিশাল বিশাল বিল্ডিঙের ছাদগুলোতে মানুষে ভরে গিয়েছে । চাঁদ দেখার উৎসবে মেতেছে সবাই । উৎসব না স্রেফ আমুদে নির্লজ্জতা বলেই মনে হচ্ছে আজকে ।

তারা উৎসব প্রত্যক্ষ করছে আমি প্রত্যক্ষ করছি জীবন । অভুক্ত বাচ্চা সমেত নারীটির খাওয়া দেখে মনে হলো ভাগ্যিস আজকেই চাকরীটি হারিয়েছি নইলে নিজে থেকে তাদের খয়রাতি সাহায্য দিয়ে অপমান করে বসতাম । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।