বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মগ্রহনের খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ৪নবেম্বর ১৯৭২ সালে আমরা অনন্য শ্রেষ্ঠ যে সংবিধান অনুমোদন করেছিলাম এবং আমরা আজো ওই দিনকে সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। সবসময়ই কোন না কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সাধারণ ইচ্ছায় এযাবত পনেরবার ওই সংবিধান সংশোধিত হয়েছে, যার অধিকাংশ নানান কারণে বিতর্ক এড়াতে পারেনি, এমনকি কয়েকটি সংশোধনী বাতিল হয়েছে (পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ) সেইসব সংশোধনীর ব্যর্থতার কারণেই। কার্যত একাধিক সংশোধনী আংশিক অথবা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে গেছে। যেমন সংরক্ষিত আসনে মহিলা সংসদ সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ৫০ পর্যন্ত বাড়াতে কয়েকবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে এবং পূর্বোক্ত সংশোধনী অকার্যকর হয়েছে। সংবিধানকে আমরা যেকারণে পবিত্র বলে দাবি করি তাতে যেসব কলংক লেপন হয়েছে বা তার আদি চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে বাতিল হওয়াগুলি বাদ দিলে অষ্টম সংশোধনী তার একটি।
আনোয়ার হোসেন বনাম রাষ্ট মামলায় অষ্টম সংশোধনীও আংশিক বাতিল হয়েছে। ৯জুন ১৯৮৮ তারিখে আমাদের সংবিধানে ২ক অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের কোন ধর্ম হতে পারেনা। রাষ্ট্র কোনদিন জৈবিক ব্যক্তি নয়, ফলে তাহার কোন অভিব্যক্তিও নাই। রাষ্ট্র একি কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান।
রাষ্ট্র মোটা দাগে একটি যন্ত্রও বটে। রাষ্ট্র যেমন জায়নামাজ আমদানি করে তেমনি ব্যাঙ রফতানি করে, তুলনামুলক মদ আমদানির পরিমাণ রাষ্ট্রধর্মের দেশে কিভাবে সামাল দিয়ে চলে তা ভেবে দেখলে ভন্ডামির চেহারাটাই ফুটে ওঠে। ভাষাগত বৈচিত্র ছাড়া সকল ব্যাংক ব্যবস্থাই সুদ ভিত্তিক। এর কোনটা ইসলাম ধর্ম স্বীকার করে কি? ভোট ভুলানো রাজনীতিবিদের কাছে এটাই স্বাভাবিক। একারণেই ধর্ম চিন্তা থেকে রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা রাখা এবং রাষ্ট্র সকলের, ধর্ম যার যার নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক নিকোলাই ম্যাকিয়াভ্যালি তার প্রিন্স গ্রন্থে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষতার সূত্র উদ্ভব করেন। তারপর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা বিকশিত হয়েছে অনেকের হাতে আর গৃহীত হয়েছে অনেক রাষ্ট্রের সংবিধানে। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা মুসলিম বা মুসলমান নামে পরিচিত। সেই হিসাবে বাংলাদেশ একজন মুসলমান। ব্যকরণবিদরা রাষ্ট্রকে স্ত্রী লিঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করেন, কিন্তু এই কর্মটি যেহেতু এরশাদের মতো নারী লোভী একজন সামরিক ব্যক্তি করেছেন আবার ধর্মের আশ্রয়ে, সেই হিসাবে আমি বাংলাদেশকে পুরুষ রাষ্ট্র মনে করি।
একই সাথে বাংলাদেশের সংবিধান ও সংসদ কার্যপ্রণালীবিধি অনুযায়ী লিঙ্গান্তরের বিষয় নাই ( যেমন সংসদ নেতা মহিলা হলেও সংসদ নেত্রী হয় না, সংসদ নেতাই থাকে)। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের চেতনা কি পরিমানে বিনষ্ট হয়েছে তার হিসাব করেও লাভ নেই। ওই সময়ে আমাদের দেশের শাষক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও দল যারা পালা করে ক্ষমতায় আসা যাওয়া করে তারা কি ভূমিকা পালন করেছিল সম্প্রতি কিছু মিডিয়া তা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে কিন্তু তাতে তাদের মোটেও লজ্জা হয়নি। আমাদের এক ছাত্র নেতা ব্যঙ্গ করে বক্তব্য রাখতেন কেউ যদি তার নামের আগে মুসলমান শব্দটি লিখে দেয় তাতে বুঝা যাওয়ার কথা ওই ব্যক্তি নিশ্চয়ই পূর্বে অন্য কোন ধর্মের ছিল বর্তমানে নওমুসলিম। এটি নিতান্তই অতিউৎসাহী কান্ড।
একই রকম অতিউৎসাহী কর্ম হচ্ছে ১৯৭২ সালের মূলস্তম্ভে ফিরে গিয়ে আবার রাষ্ট্রধর্মের আলাদা বিধান চালু করা। সাথে যুক্ত হলো বিসমিল্লাহও। অথচ যারা প্রথম এই কাজটি করেছিল সর্বোচ্চ আইনে তাদের সময়ে প্রণীত হওয়া আর কোন আইনে কিন্তু তা যুক্ত করা হয়নি।
সর্বশেষ সংশোধনীটি ফিরে এসেছে আদালতের রায়ের মাধ্যমে এবং একটি বাধ্যতামূলক নির্দেশনাতে যেখানে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল তাতে পূনপ্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু আমাদের শাষক জোট নানামূখি ভনিতা করে শেষ পর্যন্ত এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাধীন ইচ্ছায় আবার রাষ্ট্র ধর্মের খোলসটি পরে নিল।
এখন কথা হচ্ছে বাংলাদেশ যেহেতেু মুসলমানিত্ব মেনে চলছে কিন্তু এই রাষ্টটি আজো কোনদিন ওই ধর্মের ভিত্তি পালন করেছে এমন কোন নমুনা তো দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তো নিশ্চয়ই নামাজ রোজা ফরজ হয়েছে। তার কোনটি কি পালন করা হচ্ছে। তবে রাষ্ট্রের কোষাগার লুণ্ঠন করে অথবা রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে একশ্রেণী হজ্ব করে থাকে সরকারীভাবে। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মুসলমান ও ইহুদিদের খতনা (পরৎপঁসপরংরড়হ) করানো হয়।
আমাদের দেশে খতনাকে সুন্নত বলা হয়, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এটি প্রথা (অস্ট্রেলিয়ান লেখক কলিন মেইন এর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন অধার্মিকের ধর্মকথা প্রবন্ধে ভবানি প্রসাদ সাহু ৯৯ পৃষ্ঠায়)। প্রথা মানা, না মানা ভিন্ন বিষয় যারা রাষ্ট্রের গায়ে ধর্মের লেবাস পড়িয়েছেন তাদের উচিত রাষ্ট্রের খতনাটি করিয়ে ফেলা। সাত থেকে ১০ বছর বয়সের মধ্যেই খতনা করানো প্রচলন চালু আছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ধর্মগ্রহনের বয়স ২৩ বছর পার হতে চলেছে। পুরো সাবালক বললে দোষ হবে বলে মনে হয়না, এদেশে আইন অনুযায়ী ২১ বছর বয়সে বিয়ের বয়স পূর্ন হয়, সেই হিসাবে বিয়ের বয়সও পার হচ্ছে অথচ খতনা করানোটাই বাকি রইল, এই মহান দায়িত্বটি তো এরশাদ সাহেব কোন কালে ক্ষমতায় এসে শেষ করতে পারবেন তা মনে হয়না তাতে এখনই যেহেতু এরশাদের প্রতিনিধিত্ব সরকারের মধ্যে বিরাজমান তার চেয়ে মোক্ষম সময় আর পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। হয়েছেও তাই।
বিশেষ করে মুসলমানদের প্রধান ধর্ম গ্রন্থ কোরান শরিফে ধর্মনিরেপেক্ষতার ইঙ্গিত রয়েছে। অথচ একশ্রেণী বিশেষ করে ফতোয়াবাজ, মৌলবাদীরা এই বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মহীনতা। যাদের জ্ঞানের সীমানা ওই পর্যায়ে নেমে আছে তারা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী কোরান পড়ে নিচের সুরা ও আয়াতগুলি পড়ে দেখতে পারেন। আশাকরি মিথ্যাচার না করলে কোরান কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করেছিল বুঝতে বাকি থাকবে না।
বালাদ ১০; দাহর ৩; কাফ ৪৫; লায়ল ১২; যুমার ৪১; বাকারা ৪, ৫, ৬২, ১৭৪, ১৯১,২১৩, ২১৭, ২৫৬, ২৭২; নিছা ১৭১; আনআম ৫২, ৬৬, ৬৯, ১০৮; নাহল ১২৩, ১২৫; ইমরান ৮৪; হামিম সাজদা ৪৩; হাজ্জ ৭৮; ইউসুফ ৩৮।
( তথ্য সূত্র: সংস্কার, বাংলাদেশে এই গ্রন্থটি নিষিদ্ধ, কিন্তু গ্রন্থটির প্রকাশনা সংস্থা ইয়ং মুসলিম সোসাইটি,,মোহাম্মদ জামিলুল বাশার সম্পাদিত ইংল্য্যান্ড থেকে প্রচারিত তাদের নিজস্ব ওয়েব সাইটে সংরক্ষিত)। এমনকি সরকারও এই বিষয়গুলি বিবেচনায় না নিয়ে সুড়সুড়ি দেওয়া অন্ধদের পথ অনুকরন করে রাষ্ট্রধর্মের অযৌক্তিক বিধান চালু করেছে। ফলত রাষ্ট্র ফিরে পেলো পাকিস্থানি ভাবধারার সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চেহারা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেদেশের সংবিধানে পরস্পর বিরোধী রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা একই সাথে চালু করে একটি লেজেগোবরে অবস্থা তৈরী হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গটি সামনে এলে পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে সামনে রেখে অস্বাভাবিক স্পর্শকাতর এক পরিস্থিতির অবতারণা করে।
যেন এ দেশ ছাড়া আর কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কস্মিনকালেও ধর্মনিরপেক্ষতা চালু হওয়া দূরে থাকুক, এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। আসলে বাস্তব পরিস্থিতি কী? বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, সর্বশেষ হিসাবমতে ১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির উল্লেখ ও ব্যাখ্যা আছে। দেশগুলো হচ্ছে: আজারবাইজান, বারকিনো ফাসো, চাদ, গায়না, কাজাখস্তান, কসোভো, কিরগিজস্তান, মালি, নাইজার, সেনেগাল, তাজাকিস্তান, তুরস্ক ও তুর্কমেনিস্তান। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশগুলোর কোনোটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অজুহাত তুলে কোনো রাষ্ট্রধর্মের বিধান রাখেনি বা সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী নিয়ে তা সংবিধানে যুক্ত করেনি। এসব দেশ ছাড়াও আরও ছয়টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আছে, যেগুলোতে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাধান্য পাওয়া কোনো ধর্ম নেই এবং যাদের লিগ্যাল সিস্টেম মোটের ওপর ধর্মনিরপেক্ষ।
দেশগুলো হচ্ছে: আলবেনিয়া, গাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, সিয়েরা লিওন, সিরিয়া ও উজবেকিস্তান। দেখা যাচ্ছে, আরব অঞ্চল ছাড়া অন্য অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বভাবজাত। আমাদেরে দেশের মুসলমানের তুলনায় তাদের ধর্ম বিশ্বাসে কোন হেরফের আছে কিনা জানিনা।
উল্লিখিত দেশগুলোর কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়ে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, চাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিঘিœত করে এমন যেকোনো কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ মাত্রার রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
গায়না ও তাজিকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সংবিধান মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রিভিশনের বিষয় হতে পারে না। মালিতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ওপর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। নাইজারে কোনো ধর্ম রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবিদার হতে পারে না; এ ছাড়া দেশটিতে ধর্মীয় ভাবযুক্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। তাজিকিস্তানের সংবিধান রাষ্ট্রধর্মের বিধান নিষিদ্ধ করেছে; আর কোনো ব্যক্তি চাইলে দেশটিতে বিনা বাধায় ধর্মহীন জীবন যাপন করতে পারে। এসব ছাড়াও উল্লিখিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৯টি দেশের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষা, আইন বা রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা যুক্ত করা আছে।
স্বাভাবিক যে এসব দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চ্যালেঞ্জবিহীন অবস্থায় নেই। চ্যালেঞ্জ থাকাটাই স্বাভাবিক। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সাংবিধানিকভাবে টিকে আছে। এতগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সম্ভব হলে বাংলাদেশের সমস্যাটা কোথায়? সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাধারী দল ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যা করল, তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রাম জোরদার হওয়া দূরে থাকুক, সামনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা কোনো ফায়দা ওঠাতে পারবে বলেও মনে হয় না। দেখা যাক, মহা সর্বনাশের জনরব থেকে তারা মুক্তি নিতে পারে কিনা যারা অন্তত ১৯৭২ সালের সংবিধানে পুরোপুরি ফিরতে না পারার কারনে আফসোস করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।