"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫ সকাল ৭ টার আগেই ব্যাগ পত্র গাড়ীর ছাদে তুলে বেড়িয়ে পড়লাম।
শ্রীনগরকে বিদায়। এবার আমরা যাব পাহালগাম। কয়েক ঘন্টার যাত্রা, কয় ঘন্টা সেটা ঠিক মনে পড়ছে না, তবে সকাল সকালই পৌছে গিয়েছিলাম। কাশ্মীর যাত্রায় এটাই আমাদের শেষ দর্শনীয় স্থান। হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম।
সদলবলে আমরা হাটা ধরলাম ঢালুর দিকে, কারণ এখানে একটা ঘর আছে যেখানে এক বিখ্যাত সিনেমার শুটিং হয়েছিল। সিনেমার নাম মনে পড়ছে না, তবে গানের কথা মনে পড়ছে, “হাম তুম এক কামরে মে বান্ধ হো”, সেই সিনেমার কামরা!
বেশ সুন্দর করেই গুছিয়ে রেখেছ। কোথাও সিনেমার শুটিং হলে এরা বেশ কদর করে বোঝা যায়, সিনেমার নামে সেই জায়গার নামও রেখে দেয়! পাহালগাম এর বুক চিরে বয়ে চলেছে লিডার নদী। নদীর ধার ধরে ঘুরে বেড়ালাম।
নদীর পাশেই একটা কৃত্রিম নালা মত বয়ে চলেছে, তার মধ্যে ট্রাউট মাছ গিজ গিজ করছে।
এটা মৎস্য বিভাগের আওতাধীন, এরা নির্দিষ্ট সময়ে মাছ বিক্রি করে। বলা বাহুল্য, ইরানে এসে আমার প্রথম খাবার ছিল এই ট্রাউট ফিস, স্থানীয় ভাষায় বলে গেজেলালা। দারুণ লেগেছে মাছটা আমার, বেশ সুস্বাদু!
দুপুরের রান্না বান্না শেষ হলে খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। পুরো ট্যুরে আমাদের ঘোরাঘুরির ব্যবস্থা ট্যুর অপারেটর ফারুক ভাই করলেও আজ তিনি সেটা আমাদের উপর ছেড়ে দিলেন। মানে মন চাইলে ঘুরো নয়ত ঘুমিয়ে থাক।
যাহোক, এখানে বেশ অনেক গুলো প্যাকেজ আছে, মানে গাড়ী নিয়ে ঘোরার প্যাকেজ। গাড়ীর কোয়ালিটি এবং স্থান ভেদে রেইট ফিক্সড। রাস্তার ধারে সরকারী ভাবেই রেইট দেয়া আছে, এটা একটা ভাল দিক। আরো আছে পনি রাইড, মানে ছোট ঘোড়ার পিঠে করে চড়া।
আমরা আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি আর সম্ভবতঃ বাইসারান, এই তিন জায়গার প্যাকেজ নিলাম কয়েক জন মিলে, একটা মারুতি গাড়ী করে।
যেসব জায়গায় গেলাম তার কিছু ছবি দেখুন বরং।
এটা হলে বেতাব ভ্যালী, বেতাব সিনেমার নামে নাম রেখেছে
পাহাড়ী পথে গাড়ী করে ঘোরাটাও আসলে আনন্দের একটা বিষয়। একটা ব্যাপারে খুব কষ্ট পেলাম এদিন, পাতলা জ্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ঠান্ডা ছিল বেশ। এই ঠান্ডার জ্বালায় মনে হচ্ছিল, কতক্ষণে হোটেলের রুমে ফিরে যাব !
আসরের ওয়াক্ত থাকতে থাকতেই ফিরে এসে হোটেলে নামায পড়ে নিলাম, আমি এবং জসিম ভাই, দু’জনে জামাত করি। হোটেলের সামনেই দেখলাম বেশ কিছু মসজিদ, মাগরিব পড়তে এক মসজিদে চলে গেলাম।
বাহ, খুব সুন্দর মসজিদ, সৌদি আরবের কথা মনে পড়ে গেল। কাশ্মীরের মসজিদগুলো একেবারে সৌদি আরবের স্ট্যান্ডার্ডে তৈরী। পুরো মসজিদে সুন্দর কার্পেট, ইলেকট্রনিক বোর্ডে নামাযের সময়। বাড়তি হল, মসজিদে ঢোকার মুখেই ফায়ার প্লেস, লোকজন সেখানে আগুন পোহাচ্ছে।
নামায শেষে মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে কথা হল।
এর মধ্যে ইমাম সাহেব সহ আমাদেরকে এক হোটেলের রেসেপশনিস্ট তার হোটেলে নিয়ে গিয়ে চা বিস্কুট খাওয়াল। তাদের খুব ইচ্ছে বাংলাদেশ যাবে, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কাশ্মীরীদের ভিসা দেয় না। হয়ত ভারত সরকারের নির্দেশেই...
রাতে ফারুক ভাই একটু ভাল খাবারের ব্যবস্থা করলেন, অনেকটা হোস্টেলের ফিস্টের মত। কারণ, ট্যুরের শেষ দিন। খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন অভিযোগ নেই, এই দিক দিয়ে খুব আরামে ছিলাম।
পরদিন ভোর পাচটায় উঠে রওনা। সূর্য ওঠার আগেই। কারণ, জম্মু পৌছে আমাদের রাতেই দিল্লীগামী ট্রেন ধরতে হবে। একেবারে সামনের সিটে বসছিলাম, জানালার ফাক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছিল, যতই জানালা লাগাই, আবার একটু ফাক হয়ে যায়। কি যে এক যন্ত্রণা ! সকালে এই অবস্থা, অথচ দুপুরের পরে যখন জম্মুর কাছাকাছি, তখন গরমে জ্যাকেট খুলেও শান্তি নেই !
আমি, আমার এক পাশে শামীম ভাই, আরেক পাশে জসিম ভাই।
এই কয়দিনের ট্যুরে শামীম ভাই এর সাথে তেমন কথা হয় নি। আজকে ভোর থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত শামীম ভাই পাশে। সারাদিন ওনার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হল। এত চমৎকার একজন মানুষ, আর এত গুছিয়ে কথা বলেন, সত্যি এই ট্যুরের একটা বিশাল অর্জন। উনি পেশায় একজন আইনজীবী এবং মূলতঃ জমি-জমা সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ।
তার কাছ বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকার এমন কিছু গল্প শুনলাম, যেন বাংলা সিনেমা! বেশ কয়েকটি অসহায় পরিবারকে গ্রামের কুচক্রী চেয়ারম্যান মেম্বারের হাত থাকে তাদের সম্পত্তি উদ্ধারে তিনি সাহায্য করেছেন, যেটা ছিল তার অফিসের কাজের বাইরে।
রাতের ট্রেন ছিল এসি। তাই জম্পেশ একটা ঘুম দিলাম। পরদিন দিল্লী পৌছে স্টেশনের বিশ্রামাগারেই ব্যাগ পত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম দিল্লী জামা মসজিদের উদ্দেশ্যে। শুক্রবার, জুম্মার দিন।
নয়া দিল্লী স্টেশন থেকে মসজিদ বেশ কাছে, ১৫/২০ মিনিট লাগে রিকশায়। নামাজ শেষে মসজিদের উলটো পাশেই বিখ্যাত করিম হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে ঢুকলাম। আমরা দু’জন, আমি আর রেদোয়ান ভাই। জসিম ভাই গিয়েছেন এপোলো হাসপাতালে তার এক আত্মীয়ের জন্য ঔষধ কিনতে। বিখ্যাত করিম হোটেল, হোটেলে যারা এসেছে তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
খাবারের দাম সেই রকম ! আমি হাফ মাটন বিরানি নিলাম, ১৮০ রুপি ছিল মনে হয় দাম। সত্যি বলতে, আমাদের দেশের বিরানীই আমার কাছে ভাল মনে হল ঐ বিখ্যাত বিরানী খাওয়ার পর। তারপরেও, করিম হোটেল বলে কথা !
হোটেলে খাওয়া শেষ করে পথে দেখি ভ্যানে করে এক লোক খারবুজা বিক্রি করছে। নিজামউদ্দীনে খেয়েছিলাম, ভাল লেগেছিল। রসালো ফল।
দিল্লীতে গরম পড়েছে সেরকম! প্রয়াত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, “বেশ্যা মাগীর চেয়েও বেশরম”! দু'কেজি খারবুজা কিনে নিলাম। পাশের আরেক বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে ঢুকে দু’জনে মিলে খারবুজা খেলাম প্রাণ ভরে।
এই সেই আমার প্রিয় খারবুজা, ৩ পিস দেশে নিয়ে এসেছিলাম...
ইরানেও খারবুজা পাওয়া যাচ্ছে, নিয়মিত ইফতারে খাই, কিন্তু ভারতের রাজস্থানের ঐ খারবুজাগুলো অনেক বেশী মজার ছিল। এরপর সে দোকানের ৪০/৪৫ রুপি প্রতি পিস মূল্যের মজাদার মিষ্টি খেতে ভুলিনি। আর পরিশেষে ঠান্ডা লাসসি, সেইরকম একটা ভোজন হল।
রাজধানী এক্সপ্রেসে কোলকাতা ফেরা। সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশের সিটে বসা কোলকাতার ছেলে রাজকুনওয়ার এর সাথে ব্যাপক আড্ডা হল। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, বিএসএফ এর কর্মকান্ড, সব কিছু নিয়েই অনেক কথা হল। ছেলেটা চমৎকার, পজিটিভ একটা ছেলে, বিচার বিশ্লেষন খুব ভাল। দিল্লীতে অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল সার্ভিসে এমবিবিএস ৩য় বর্ষে পড়ে।
আসছে ডিসেম্বরে সে আমেরিকা যাচ্ছে একটা পেপার প্রেজেন্ট করতে। মানুষের মস্তিকে ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক সিগন্যাল, এ সংক্রান্ত বিষয়ে সে রিসার্চ করেছ। মুগ্ধ হলাম, কোথায় ভারতের মেডিক্যালে পড়া ছেলেরা, আর কোথায় বাংলাদেশের ডাক্তাররা !
কোলকাতা পৌছে আর সময় নষ্ট করা নয়। দুপুরে খালেক হোটেলে ৪৫ রুপি দিয়ে যে হাফ গরুর বিরিয়ানী দিল, এককথায় অসাম ! আর পরিমান বাংলাদেশের ফুল প্লেটের সমান। গেলে মিস করবেন না।
খেয়ে দেয়ে নিউ মার্কেট এলাকায় চলে গেলাম। সাথে জসিম ভাই, উনি অনেক কেনাকাটা করলেন। আমি পুরো ট্যুর চলেছি জসিম ভাই এর টাকায়। যা কিছু টাকা ছিল তা দিয়ে বেশ কিছু চকলেট কিনলাম। জসিম ভাইকে বললাম, আপনি কিনে যদি টাকা কিছু থাকে আমাকে দিয়েন।
যেই না ওনার কাছ থেকে কিছু টাকা পেলাম, আবার চকলেট, হলদিরামের সোন পাপড়ী কেনা। ভারত থেকে কেনা এক বক্স সোন পাপড়ি তেহরানেও নিয়ে এসেছি, রোজ ইফতারে খাই...
পরদিন সকালে ভোর পাচটায় বেনাপোলের উদ্দেশ্যে রওনা। বর্ডার পার হয়ে গ্রিন লাইনের এসি বাসে ঢাকা ফেরা। রাস্তা এত চমৎকার যে ভ্রমনের কোন ক্লান্তিই গায়ে লাগে নি। খুব আরামেই চিরচেনা সেই কোলাহলের শহরে পৌছে যাওয়া, এক অনন্য সাধারণ ভ্রমনের পরিসমাপ্তি...
ভূস্বর্গ কাশ্মীরে কয়েক দিন... (পর্ব - ১)
ভূস্বর্গ কাশ্মীরে কয়েক দিন... (পর্ব - ২)
আমার যত ভ্রমন ব্লগ... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।