"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫ ক্রেডিটটা এবারো হাবিব ভাইকেই দিতে হয়।
যারা আমার শ্রীমংগল চা বাগানে... পোস্টটি পড়েছিলেন, তারা হয়ত বুঝতে পারবেন। হাবিব ভাই আগে অফিসের যেই ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন, সেখানকার সহকর্মীরা প্রতি বছরই অন্ততঃ একবার ভারত ভ্রমনে গিয়ে থাকেন, ৫০/৬০ জনের দল নিয়ে। দলে অফিসের সহকর্মীদের বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। ওনাদের এবারের অভিযান ছিল কাশ্মীর ! হুমম... স্বপ্নের কাশ্মীর !!!
কাশ্মীর ভ্রমনের একটা স্বপ্ন আমার মনে অনেক আগে থেকেই ছিল, আসলে ২০১১ তেই যেতে চেয়েছিলাম। হাবিব ভাই যখন বললেন, একটা দল কাশ্মীর যাচ্ছে, তুমি ওদের সাথে কথা বলে দেখতে পার।
আয়োজক ভাইয়াদের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেল, এক ভাইয়া যাচ্ছেন না, তার জায়গায় আমি যেতে পারব। পুরোটাই সড়ক পথের ভ্রমন, ১১ দিনের ট্যুর, খরচ মাত্র ২৭,৫০০ টাকা ! পুরাই পাংখা ! কলকাতা দিল্লী জম্মু হয়ে শ্রীনগর, গুলমার্গ, সোনমার্গ এবং সবশেষে পাহালগাম, এই হল আমাদের ভ্রমনের হাই লেভেল সূচী।
১০ এপ্রিল রাতে আমাদের কোলকাতাগামী বাসে ওঠার কথা। কিন্তু, যে হারে বাংলালিংক দামে হরতাল দেয়া হচ্ছিল, তাতে আমরা কোন ঝুকি নিতে রাজী হলাম না। ১০ এপ্রিল রাতে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে কোলকাতা পৌছে গেলাম।
একদিক দিয়ে ভালই হল, সারা রাত ভ্রমন করে কোলকাতা পৌছাতে দুপুর একটা/দু’টা বেজে যেত। আর প্লেনে ১ ঘন্টাতেই কর্ম সাবার !!
পরদিন সকালে উঠে চলে গেলাম ভিক্টোরিয়া প্রাসাদে। এর আগের বার যখন ভিক্টোরিয়া প্রাসাদের গিয়েছিলাম, সেদিন ছিল সাপ্তাহিক বন্ধ। প্রাসাদের ভেতরের মিউজিয়ামে গিয়ে হতাশই হলাম। ব্রিটিশ আমলের অনেক কিছু রয়েছে, কিভাবে ইংরেজরা ভারতবর্ষকে তাদের কব্জায় নিল, সেসব ইতিহাস।
কিন্তু, প্রাসাদটা বাইরে থেকে দেখে যতটা বিশাল মনে হচ্ছিল, ভেতরে তার তুলনায় অনেক ছোট জায়গায় যাদুঘর, পুরো প্রাসাদটা ভেতরে দেখতে দিলে ভাল লাগত।
ফিরে এলাম পার্ক স্ট্রিটে। বেশ গরম ছিল, আর্দ্রতা খুব বেশী। তাজা ফলের রস খেয়ে একটু প্রশান্তি লাভের চেষ্টা করলাম। নিউমার্কেটের কাছে মারকুইস স্ট্রিটে ছিল আমাদের হোটেল।
আশে পাশের দোকান পাট দেখতে দেখতে নিউ মার্কেট ছেড়ে অনেক দূর চলে গেলাম। কেসি দাসের বিখ্যাত মিষ্টি খেয়ে পরে হোটেলে ফিরলাম।
সন্ধ্যা ৬ টায় শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেসে আমাদের যাত্রা শুরু। প্রায় ৫০ জনের দল। সবাই এক বগিতেই।
ট্রেন যথা সময়েই ছেড়ে দিল। এসি কোচে খেয়ে দেয়ে নামাজ পড়ে ঘুম দিলাম। পরদিন বেলা প্রায় এগারটা নাগাদ দিল্লী পৌছেই হোটেলের দিকে ছুট। জুম্মার দিন ছিল। খুজে পেতে কাছেই এক মসজিদে জুম্মার নামায পড়ে বাসে উঠে পড়লাম।
উদ্দেশ্য দিল্লী নিজাম উদ্দীন মসজিদ, তাবলীগ জামায়াতের মারকাজ। জাস্ট একটু দেখে যাওয়ার ইচ্ছে, এত নাম শুনেছি ! আমরা ছিলাম করল বাগ এলাকায়। ১৮১ নম্বর বাসে উঠে যখন ১৫ রুপি বাস ভাড়া দিলাম, তখন বুঝেছিলাম জায়গাটা দূরেই হবে। মনে হল পুরো দিল্লী শহর ভ্রমন করছি। দিল্লীতেও ভালই গরম।
মারকাজ মসজিদের গেটের ঠিক সামনেই এক দোকানে টক দই এর লাচ্ছি বিক্রি হচ্ছিল। খেয়ে সেরকম লাগল ! আমি আবার সাথে দোকানে থাকা মিষ্টান্নও চালিয়ে দিলাম।
রাত সাড়ে আটটায় জম্মুর উদ্দেশ্য ট্রেন ছিল বিধায় আমাদের ইচ্ছে ছিল আসর পড়েই করল বাগের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ব। মারকাজ মসজিদে আসর নামাজ পড়লাম। সাথে থাকা জসিম ভাই বললেন, এখানে হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার দরগাহ আছে যার নামে এই জায়গার নাম।
ভাবলাম এতদূর যখন এসেছি, একটু দেখেই যাই। আমি জীবনে কোন মাজারে যাই নি, তাই ওখানে কি হয় তা সচক্ষে দেখিনি, শুধু শুনেছি। মাজারের দিকে যতই এগোচ্ছি, দেখি দোকানিরা ফুল, আগরবাতি এবং আরো বহু কিছু নিয়ে বসে আছে। এসব কিনে নিয়ে লোকজন যাচ্ছে মাজারে। খেয়াল করে দেখলাম, অমুসলিম মহিলারাও যাচ্ছে ফুল সাজানো ট্রে নিয়ে ! কমপ্লেক্সে ঢুকে বুঝতে পারলাম, এখানে বেশ কিছু কবর আছে।
কাছেরটায় ঢুকে পড়লাম কি হচ্ছে দেখার জন্য। আল্লাহ তুমি মাফ কর, দেখি লোকজন কবরের উপর চুমু খাচ্ছে। গেটে এক লোক খাতায় লিখে নিচ্ছেন, কার দিলের কি তামান্না ! আল্লাহ জানে সেগুলো পূরণে কি ব্যবস্থা তিনি নিবেন !
এতটুকু দেখার পর আর থাকার ইচ্ছে হল না। দ্রুত বেরিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। এসে নামলাম দিল্লী গেইটের কাছে।
আমার সাথে থাকা বাকী দু’জন কখনো এখানে আসেননি তাই। কাছে পিঠে এক জায়গায় মসজিদ পেয়ে গেলাম। মাগরিব আদায় করে সোজা অটো ধরে হোটেলে।
ট্রেন ছাড়ল জম্মুর উদ্দেশ্য। আজকে নন এসি ট্রেন, কিন্তু রাতের যাত্রা আর গরম কম থাকায় তেমন সমস্যা হয় নি।
সকাল সাতটা নাগাদ জম্মু তায়ি স্টেশনে পৌছে গেলাম। জম্মু কাশ্মীরের শীতকালীন রাজধানী। আমাদের ট্যুর অপারেটর ফারুক ভাই। ওনার লোকজন আগে থেকেই এখানে চলে এসেছে। বাস ঠিক করা আছে আর যে কয়দিন আমরা কাশ্মীরে থাকব, সে কয়দিন সব বেলার রান্না বান্নাও এরাই করবে।
পাচক এবং তার সহকারীরা কোলকাতার অধিবাসী।
সকাল আটটা নাগাদ বাস ছাড়ল। কিছুদূর যেতেই পাহাড়ী পথ শুরু হল। নাশতা এবং দুপুরের খাবার পথে বিভিন্ন হোটেলে বাস থামিয়ে করা হল। সবই নিজস্ব বাবুর্চিদের রান্না করা, তাই এই একটা জায়গায় কোন কষ্ট হল না, রান্না এক কথায় চমৎকার !
শ্রীনগরের পথে জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র
পাহাড়ী ছোট শহর...
পথের পাশে বয়ে চলা জম্মু তায়ি নদী...
শ্রীনগর যখন পৌছালাম, তখন রাত হয়ে গেছে।
হোটেল গ্রেট আকবর ! আমাদের এই ট্যুর ছিল বাজেট ট্যুর। তাই হোটেলের মানও ছিল সাধারণ। যাহোক, আমরা যেই রুম পেয়েছিলাম, সেটা ছিল মোটামুটি, টয়লেট সুবিধার ছিল না।
পরিদন পয়লা বৈশাখ ! কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর শহর ভ্রমন। লোকজনের দাবী অনুসারে সকালে খিচুরী আর মুরগির মাংশ হল।
সাথে পাপড় থাকত। জম্পেশ খাওয়া দিয়ে বের হয়ে পড়লাম। শ্রীনগরের আইন কানুন খুব কড়া। সকাল সাতটার পর শহরে বড় গাড়ীর চলাচল নিষেধ। আমাদের বাস শহরের একটু বাইরে নির্ধারিত পার্কিং এ রাখা আছে, ডাল লেকের পাশে।
ছোট কিছু গাড়ীতে করে চলে গেলাম সেখানে। রৌদ্রোজ্জল দিন। লোকজন ডাল লেকের পাশে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
মিশন কাশ্মীর সিনেমার কথা মনে আছে? এই শিকারায় চড়ে বেরিয়েছিল নায়ক নায়িকা...
লেইকে কিছু কৃত্রিম ফোয়ারা তৈরী করা হয়েছে...
ডাল লেক বিশাল বড়, প্রায় ১৮ বর্গ কিলোমিটার, প্রাকৃতিক হ্রদ। পাহাড়ের কোলে প্রাকৃতিক হ্রদ, আসলেই খুব সুন্দর।
যদিও পানিতে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ হ্রদের সৌন্দর্যহানি করছিল। বোঝা গেল, সরকারের নজর একটু কম আছে। হ্রদে বোট হাউস আছে, শিকারা আছে। শিকারা হল ছোট নৌকা, হ্রদে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। বোট হাউসে আমরা থাকিনি।
আর পানি দেখে ভাল না লাগায় আমি শিকারা ভ্রমনও করিনি... শীতে এই হ্রদ পুরোটাই বরফ হয়ে যায়।
শ্রীনগরে মুঘল সম্রাটে আয়েশ করতেন। তারা বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর বাগিচা তৈরী করেছিলেন। আসলে কাশ্মীরের আবহাওয়া খুব স্বাস্থ্যকর, বিধায় রাজা বাদশাদের এই আয়োজন। ডাল লেক থেকে বাসে করে আমরা চলে গেলাম মুঘল বাগান শালিমার দেখতে।
খুব সুন্দর বাগান, ছবিতেই দেখুন।
দূরে বরফ ঢাকা পাহাড়...
বাগানে ঘাসের মধ্যে ছোট ছোট ফুল...
মধু খেতে ব্যস্ত ভ্রমরা...
এরপর গেলাম মুঘল বাগান নিশাত ঘুরতে। প্রাকৃতিক একটি ঝর্ণাকে এরা একটু কৃত্রিমতার ছোয়া দিয়ে পুরো পার্কে বইয়ে দিয়েছে। ছবিতেই দেখুন।
রবিবার ছুটির দিন হওয়ায় কাশ্মীরি পরিবারগুলো বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে এসেছে।
নিশাত পার্ক থেকে আমরা চলে গেলাম এশিয়ার সবচেয়ে বড় টিউলিপ বাগানে। টিউলিপ ফুল খুব কম সময়ের জন্য ফোটে, এপ্রিলেই ওরা কিছুদিন থাকে। ৫০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে টিউলিপ বাগানে ঢুকলাম। ৫৬০০ ফুট উচ্চতায় জাবারওয়ান পাহাড়ের পাদদেশে এ এক অপূর্ব আয়োজন। রং বেরং এর টিউলিপ ফুটে আছে ১২ হেক্টর জায়গা জুড়ে ! মূখ্য মন্ত্রী গুলাম নবী আজাদের উদ্যোগে ২০০৬-২০০৭ সালে গড়ে ওঠে এই টিউলিপ বাগান।
টিউলিপ বাগানের এক পাশে জোহরের নামাজ আদায় করলাম। বাগানে খাবার বিক্রি হচ্চিল। একটা কাশ্মীরি বিস্কুট খেলাম, নারিকেল দিয়ে তৈরী, দারুণ লাগল। পরে আমি বাসার জন্য কিছু বিস্কুট নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের দুপুরের খাবারের আয়োজন ছিল টিউলিপ বাগানের পাশেই অবস্থিত ইন্দিরা গান্দী মেমোরিয়াল পার্কে।
পার্কটাও অসাধারণ সুন্দর। লেইক আছে, আছে দৃষ্টিনন্দন গাছ পালা। জম্পেশ একটা খাওয়া দিলাম। মন চাচ্ছিল পার্কেই একটা ঘুম দেই।
সেদিনের মত আমাদের ট্যুর শেষ।
এর পরের কর্মসূচী, সবাইকে ডাল হ্রদের ধারে এনে ছেড়ে দেয়া হল। কেউ শিকারায় চড়ল। আমরা তিনজন মিলে একটা অটো ঠিক করে চলে গেলাম লিংক রোডে, কাশ্মীরি শাল কিনতে। সময় কম, এভাবেই দিনের শেষে সারতে হবে। মাগরিব পড়ে এক দোকানে ঢুকলাম।
বিশাল সব দোকান ! ১৫০ রুপি থেকে শুরু করে দেড়/দুই লাখ রুপি পর্যন্ত শাল আছে !! প্রায় ১৩ হাজার রুপির শাল, পাঞ্চু আর টু’পিস কিনে সেদিনের মত হোটেলে ফিরলাম !!
কাল আমরা গুলমার্গ যাব। ঐ গল্প আগামী পর্বে বলব, সে পর্যন্ত সাথেই থাকুন...
আমার যত ভ্রমন ব্লগ...
In Srimongol: On a weekend at the land of tea ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।