আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভূস্বর্গ কাশ্মীরে কয়েক দিন... (পর্ব - ২)

"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫ শ্রীনগরের যেমন নিয়ম, ভোর সাড়ে পাচটায় উঠে সকাল ছয়টার মধ্যে নাশতা করে বেরিয়ে পড়া।

ছয়টার মধ্যে বেরোনোর তাৎপর্য হল, বাস আমাদের হোটেলের সামনে থেকেই আমাদের তুলতে পারবে। সাতটার মধ্যে শহর ছেড়ে বের হয়ে যেতে হব বাস নিয়ে। গুলমার্গ শ্রীনগর থেকে প্রায় এক/দেড় ঘন্টার যাত্রা। দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। ওখানকার আশে পাশের সব পাহাড় বরফে ঢাকা।

গুলমার্গের প্রধান আকর্ষন হল কেবল কার বা "গুলমার্গ গন্ডোলা"। এটা এশিয়ার মধ্যে উচ্চতম এবং দীর্ঘতম কেবল কার। গুলমার্গ গন্ডোলার দু’টো ভাগ আছে। প্রথম ভাগ জম্মু কাশ্মীর সরকারে তত্ত্বাবধানে ফরাসী কোম্পানী পমাগালস্কি তৈরী করে এবং এটি ১৯৮৮ সালে উদ্ধোধন হয়। এটি আপনাকে ২৬৫০ মিটার উচ্চতার গুলমার্গ থেকে ৩০৫০ মিটার উচ্চতার কংডুরীতে নিয়ে যাবে।

যাবার পথে আপনি উপভোগ করবেন বরফে ঢাকা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ! এই প্রথম ভাগের ভাড়া পিক সিজন (এপ্রিল থেকে) ৪০০ রুপি। কংডুরী থেকে ৩৯৫০ মিটার উচ্চতায় আফারওয়াতে নিয়ে যাবে গন্ডোলার দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশ যার ভাড়া ৬০০ রুপি। এই দ্বিতীয় পর্যায় চালু হয়েছিল ২০০৫ এ। আপনি যদি দুটো ভাগেই ভ্রমন করতে চান, তবে শুরুতেই আপনাকে মোট ১,০০০ রুপি দিয়ে দুই ভাগের টিকেট কিনতে হবে। প্রথম ভাগে উঠে সেখানে আর কোন টিকেট কাউন্টার পাবেন না দ্বিতীয় ভাগে যাওয়ার জন্য।

বাস স্ট্যান্ডে নেমে হেটে গুলমার্গ গন্ডোলা স্টেশনের পথে... গুলমার্গ গিয়ে আপনাকে প্রথমেই টিকেটের জন্য লাইন দিতে হবে। সমস্যা হল, কাউন্টার খোলে ১০ টায় কিন্তু লোকজন সেই সকাল আটটা থেকেই লাইন ধরে। গাইডদের জন্য আলাদা কাউন্টার থাকলেও ওরা সাধারণ কাউন্টারেও লাইন দেয়। এক জন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ টি টিকেট কাটতে পারে আর পাসপোর্ট দেখিয়ে সেই নামে টিকেট কাটতে হয়। আসলে ওরা আপনাকে একটা বোর্ডিং পাস দিবে।

টিকেট কাটার ঐ কিউতে ভালই হট্টগোল হয়। কেবল কারে চড়ার আগে রাস্তা থেকে গামবুট ভাড়া নিয়ে নিতে পারেন। কারণ, বরফে যখন হাটা চলা করবেন, তখন আপনার পা ভিজে যাবে না। আমি অবশ্য আমার কেডসের ওপর দিয়েই চালিয়ে দিয়েছিলাম। প্রায় ঘন্টা দেড়েক ১০ জনের টিকেটের টাকা নিয়ে আমিই লাইনে দাড়িয়েছিলাম।

কিন্তু, শেষে যখন জানা গেল পাসপোর্ট লাগবে আর আমার পাসপোর্টতো হোটেলে ব্যাগে, তখন পাসপোর্ট আছে এমন একজন কে দাড় করিয়ে দিলাম। পেয়ে গেলাম বোর্ডিং পাস... যাত্রা শুরু এখান থেকেই... কংডুরীর পথে... স্টেজ ওয়ান ল্যান্ডিং স্টেশন কংডুরীতে নেমে... কংডুরীতে উঠে দেখলাম, সেখানে স্কিইং আর স্লেজ গাড়ীর জমজমাট ব্যবস্থা ! আমি আবার স্কিইং দেখলে লোভ সামলাতে পারি না। মানালিতে করেছিলাম, সেই সুখ স্মৃতি এখনো মনে আছে। ৫৫০ রুপি চাইল কিন্তু মানালির রেফারেন্স টেনে শেষ পর্যন্ত ২৫০ রুপিতেই ঠিক করে ফেললাম। আমার যেহেতু ট্রেনিং এর দরকার নেই, তাই সেখানেও কিছু পয়সা বাচল।

আমার দেখাদেখি সহকর্মী জসিম ভাইও স্কিং এ নেমে গেলেন, প্রশিক্ষকের সাথে চলল তার সেশন। ব্যাপক মজা এই স্কিইং এ, সুযোগ পেলে অবশ্যই করবেন। প্রথমে প্রাকটিস গ্রাউন্ডে একটু স্কিং করে উপরে উঠে গেলাম, একটু লম্বা পথ স্কিইং করব। কিন্তু, ১৫ মিনিটের চর্চায় আর কি হয়। মাঝ পথে ধপ্পাস করে পড়ে গেলাম, আর আমার এক কলিগ আবার সেই পড়ে যাওয়া অংশই ভিডিও করে ফেলল !! কংডুরী থেকে কেবল কার উঠে গিয়েছে আফারওয়াত পর্যন্ত... স্কিইং শেষ করে কেবল কারের দ্বিতীয় অংশ চড়ে আফারওয়াতে চলে গেলাম।

সেখানে গিয়ে মনে হল, সত্যিই যেন স্বর্গে চলে এসেছি ! কনকনে ঠান্ডা বাতাস কিন্তু চমৎকার রদ্রৌজ্জ্বল দিন। আফারওয়াতের পথে... আফারওয়াত থেকে কিছু ভিউর ছবি দেখুন এবারঃ এখান থেকে আর দশ কিলোমিটার দূরেই ভারত-পাকিস্তান লাইন অব কন্ট্রোল ! দেখি দুজন সেনা বসে পাহাড়া দিচ্ছে। ওদের হাতে একে ৪৭ জাতীয় অস্ত্র। পাবলিক দেখি আবার ওদের সাথে গণহারে ছবি তুলছে। ইন্ডিয়ান এক মেয়ে ঐ সৈনিকের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে সেটা তাক করে ছবি তুলছে।

তা দেখে আমাদের তিন সহকর্মীর মনে হল, এ সুযোগ হাত ছাড়া করা কেন?? অস্ত্র তাক করে গুলাব সিং এর সাথে আমিও একটা ছবি তুলে নিলাম, যদিও সেটা কোথাও প্রকাশ করিনি। ছবি তোলা শেষে গুলাব সিং বলে, আস একটু গল্প করি। আমিও আড্ডা জমিয়ে দিলাম। গুলাব সিং এর বাড়ী লাক্ষনৌ। শেষটা হল, গুলাব সিং তার মোবাইল নাম্বার দিয়ে আমাকে লাক্ষনৌ যাবার আমন্ত্রন দিল, সে নিজে আমাকে লাক্ষনৌ ঘুরিয়ে দেখাবে যখন ওর ছুটি থাকবে।

গুলমার্গ থেকে ফেরার পথে অনেক আপেল বাগান চোখে পড়ল। সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। এখন ফুলের মৌসুম। সেপ্টেম্বরে ফলের মৌসুম। পথে এক দোকানে চা খাওয়ার বিরতিতে আমরা দোকানের সামনে ঘাসে আসর এর নামাজ পড়ে নিলাম।

দোকানের মালিক নিজেও বেশ দ্বীনদার লোক। আমাদের নামাজ পড়ার কথা শুনে সে দোকানের পাশেই তার বাড়ীতে ওযু করার ব্যবস্থা করে দিল। আর ফেরার সময় বেশ কিছু আখরোট উপহার হিসেবে দিয়ে দিল। বাড়ীর আঙ্গিনায় আপেল গাছ, ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে... এদিনও শ্রীনগর ফিরে আমরা আবার চলে গেলাম সেই লিঙ্ক রোডে। এক দোকানে ঢুকতেই দোকানি আমার দিকে তার নিজের জন্য কেনা একটা কোকাকোলা কোম্পানির নিম্বু (লেবু) পানির বোতল এগিয়ে দিল।

প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত ছিলাম, এত মজা লাগল বলে বোঝাতে পারব না। বুঝিনা বাংলাদেশে এই ড্রিঙ্কস নেই কেন! পরে জম্মুতে এবং দিল্লীর গরমে বেশ কয়েক বার খেয়েছি, অসাধারণ একটা ড্রিকংস ! সেই দোকান থেকে বউ এর জন্য দু’টো কাশ্মীরি টু’পিস আর অন্যান্যদের জন্য কিছু শাল কিনে হোটেলে ফেরা। পরদিন আমাদের ভ্রমন সূচী হল সোনামার্গ যাওয়া। রাত থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই সবাই সকাল ছয়টায় বেরিয়ে পড়লাম।

পথে আমরা ডাল হ্রদের পাশে অবস্থিত হযরত বাল মসজিদ দেখব। হযরত বাল মসজিদ শ্রীনগরের বিখ্যাত মসজিদ, এখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) একটি দাড়ী মোবারক সংরক্ষিত আছে। সে জন্যই এই মসজিদের নাম হযরত বাল মসজিদ। হযরত বাল মসজিদের প্রবেশ পথ... হযরত বাল মসজিদের ইতিকথা... মসজিদের ভেতরে ঢুকে দেখি দুই পুলিশ একে ৪৭ জাতীয় অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। মসজিদে অস্ত্র নিয়ে পাহারা কেন জিজ্ঞেস করতে সে অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “তোমাদের দেশে মসজিদে সসস্ত্র পাহারা থাকে না??!!” জানা গেল, কিছু দুস্কৃতিকারী একবার হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ঐ দাড়ীটি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল।

পরে সেটা উদ্ধারও হয়েছিল। এর পর থেকেই কড়া নিরাপত্তা ! বছরে এক দিন ঐ দাড়ীটি সবার দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। মসজিদ দেখে ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই সোনামার্গের যাত্রা শুরু হল। ঘন্টা খানেক চলার পর এক জায়গায় গিয়ে দেখা গেল সামনে তুষারপাত হচ্ছে। সাথে সাথেই আমাদের ড্রাইভার তার বাস ঘুরিয়ে ফেলল, Zero Tolerance আর কি !! রাস্তা সরু, সামনে যেহেতু তুষারপাত আরো ভারী হবে, সেক্ষেত্রে বাস ঘোরানোর জায়গা না পেলে আটকে যেতে হতে পারে কয়েক দিনের জন্য।

আমাদের ট্যুর অপারেটর ফারুক ভাই একবার মেয়েদের একটা গ্রুপ নিয়ে গিয়ে মানালিতে ধরা খেয়েছিলেন। ব্যপক কষ্ট হয়েছিল সবার। সেই ভীতিকর অভিজ্ঞতা আমাদের শোনালেন। তুষার পাতের কারণে আমাদের সোনামার্গের ট্যুরের অবসান ঘটলেও সেটা নিয়ে যতটা না আফসোস ছিল, আমাদের গোটা দশেক সহকর্মীর তার চেয়ে বেশী আফসোস ছিল আরেকটু সামনে গিয়ে পুরোপুরি তুষারপাতটা দেখে আসতে না পারায়... দুপুরে হোটেলে ফিরেই লাঞ্চ হল। এমন আবহাওয়াতে এক চোট ঘুমিয়ে নিতে ছাড়লাম না।

আসর পড়ে রওনা হয়ে গেলাম আবার সেই লিংক রোডের দিকে। উদ্দেশ্য দেখি এই এলাকায় আর কি আছে, আর কি কেনা যায়। বৃষ্টিস্নাত বিকেলে শ্রীনগরের পথে... একটা বেকারি পেয়ে গেলাম। ঢুকে বেশ ভাল বেকারিই মনে হল। নারিকেল দিয়ে বানানো ওদের একটা বিস্কুট আছে খুব মজার।

আরো একরকম বিস্কুট চেখে দেখলাম। বেশ ভাল। আমি ওখান থেকে প্রায় ২ কেজি বিস্কুট দেশে নিয়ে এসেছিলাম, এয়ারটাইট না থাকাতে বিস্কুটগুলো নরম হয়ে গিয়েছিল... বিস্কুট খেয়ে হেটে এগিয়ে যাচ্ছি। মেয়েদের পোষাকের এক দোকানে চোখ আটকে গেল। ঢুকে গেলাম।

দেখি দোকানে কাশ্মীরের ছাড়াও পাকিস্তানি থ্রি পিস পাওয়া যাচ্ছে। খুব সুন্দর সুন্দর থ্রি পিস আর দামও অনেক কম! দু’টো থ্রি পিস কিনে বের হতেই মাগরিবের আযান পড়ে গেল, পাশেই মসজিদ। নামায শেষ করে দেখি উর্দুতে তা’লিম হচ্ছে মসজিদে। জসিম ভাইকে বললাম, আসুন একটু উর্দুতে তা’লিম শুনে যাই। তা’লিম শুনে উঠতেই এক অন্য রকম ঘটনা ঘটল।

ট্রেডিশনাল কাশ্মীরি আলখাল্লা পরিহিত এক লোক আমাকে বলল, "“আপনাদের কারো কি ক্যামেরা হারিয়েছে?"” আমার হাত চলে গেল কোমরে বেল্টে। একি, আমার ক্যামেরাতো নেই !! ভাবলাম, হয়ত অযুখানায় পড়ে গেছে। লোকটি বলল, "আমার সাথে আসুন। " মসজিদ থেকে বের করে নিয়ে গেল। বুঝলাম, ঘটনা অন্যরকম।

ওই লোকের দোকানের সামনে কিছু ফল বিক্রেতা ফুটপাতে বসে আছে। সেখানে নিয়ে বলল, "এখানে দাড়ান। " কাকে যেন ফোন দিল ঐ লোক। পনের মিনিটের মধ্যে দু’জন কাশ্মীরী তরুণ আমার ক্যামেরা নিয়ে হাজির! আলহামদুলিল্লাহ ! আমি যখন এই পথ দিয়ে হেটে গিয়েছিলাম, আরো প্রায় ঘন্টা দেড়েক আগে, তখন বেল্টের থেকে আমার ক্যামেরা এই দোকানের সামনেই পড়ে যায়। কাশ্মীরি ছেলে দু’টো প্রায় আধা ঘন্টা ক্যামেরা নিয়ে আমার অপেক্ষায় ছিল।

আমাকে না পেয়ে তারা ঐ দোকানির কাছে ওদের মোবাইল নাম্বার দিয়ে গিয়েছে আর সাথে সাথে পত্রিকা অফিসে ফোন করেও জানিয়ে রেখেছে, যাতে কেউ খোজ করলে তাদের নাম্বার দিতে পারে। ছেলে দু’টো ছিল ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ভেতরের শেষ ছবিটা ছিল আমার সাথে থাকা জসিম ভাইয়ের... সেটা দেখে ক্যামেরার মালিককে মিলিয়ে নিতে সমস্যা হয় নি ওদের... বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে আরো অনেক খুশী হল... সততার এই অপূর্ব নিদর্শন দেখে অন্যরকম এক মুগ্ধতা আর কাশ্মিরীদের প্রতি ভালবাসা নিয়ে হোটেলের পথ ধরলাম... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।