দাউদ হোসাইন রনি
সারাদেশ যখন শ্রেষ্ঠ সন্তান হারানোর ব্যথায় কাতর তখনও নিশাদের কোনো ভাবান্তর নেই। নিশাদ তারেক ও ক্যাথেরিন মাসুদ দম্পতির এক বছর ৩ মাস বয়সী একমাত্র সন্তান। ২১ এপ্রিল এক বছর পূর্ণ হলো তার। পুরো নাম নিশাদ বিংহ্যামপুত্র মাসুদ। এ বয়সের বাচ্চারা কারণ খুঁজে কাঁদে না, অকারণেও কাঁদে।
সারাজীবনে এর চাইতে বেশি কান্নার আর কোনো উপলক্ষ্য ওর জীবনে আসবে কি না সন্দেহ। অথচ আজ এই কান্নার দিনে ও একেবারে নিশ্চুপ। একদিন এই নিশাদও নিরবতা ভেঙে জেগে উঠবে। তথ্য আর আন্তর্জাতিক জগতে খুঁজে বেড়াবে বাবাকে। তখন তার অন্তরাত্মার কান্নার খোঁজ হয়ত কেউই রাখবে না।
অন্য আর আট-দশজন চলচ্চিত্রকারের চাইতে তারেক মাসুদ কতটা আলাদা, সেটা তার লাইফস্টাইলই বলে দেয়। জীবনের পদে পদে চিন্তা-চেতনা বদলেছেন তারেক। অনেক মত আর দর্শনের ভিড়ে খুঁজেছেন শুদ্ধতম পথ। আর তাতেই দাঁড়িয়ে গেল নিজস্ব একটা চিন্তাধারা। তারেক তার মুক্তচিন্তাকে ছড়িয়ে দিতেই চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছেন।
চলচ্চিত্র ছিল তার কাছে ইবাদতের মতো। তার মতের বিরোধিতাও করেছেন কেউ কেউ। যারা বিরোধিতা করেছেন তাদের অনেকেই এখন তারেকের জন্য হা-হুতাশ করছেন গণমাধ্যমে। জয় কিন্তু তারেক মাসুদেরই হলো।
নিশাদের মতোই অবস্থা আমাদের মুক্তবুদ্ধির চলচ্চিত্রের।
তারেককে হারিয়ে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে দেশীয় চলচ্চিত্র। তারেকের হাত ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনের শীর্ষ পর্যায়ে প্রবেশ করল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। 'আদম সুরত' দিয়ে তারেক তার আগমনী জানান দিলেন চলচ্চিত্র দুনিয়ায়। ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা ছবির পুরস্কার জিতল 'মাটির ময়না' মনোনয়ন পেল অস্কারের সেরা বিদেশী চলচ্চিত্রের ক্যাটাগরিতেও । নিউ ইয়র্ক টাইমসের চলচ্চিত্র সমালোচক এলভিস মিচেল এ ছবি সম্পর্কে বলেন, 'এ বছরের তো বটেই।
যে কোনো সময়ের সুন্দরতম ছবির অন্যতম মাটির ময়না। ' ২০০৮ সালে আমেরিকান চ্যানেল টার্নার ক্ল্যাসিক ছবি বিভাগে প্রদর্শন করে ছবিটি। অস্ট্রেলিয়ান টিভি চ্যানেল এসবিএ নিজেদের ৩০ বছর উপলক্ষ্যে সেরা ক্ল্যাসিক ছবির সম্প্রচার করে। সেখানেও প্রদর্শিত হয় ছবিটি। গত বছর নিউ ইয়র্ক স্টেট রাইটার্স ইন্সটিটিউট বিশ্বের সেরা ক্লাসিক ছবির তালিকা করে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে।
সেখানেও প্রদর্শিত হয় 'মাটির ময়না'।
তারেকের এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ চলচ্চিত্রকর্মী তৈরি হলো। তার দেখানো পথেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করলেন বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন তরুণ নির্মাতা। বিদেশি অর্থায়নে ছবি নির্মাণের পথঘাটও বাতলে দেন তারেক। অন্যদের জন্য পথচলা মসৃন করে দিলেও তারেকের শুরুটা মোটেও মসৃন ছিল না।
'মাটির ময়না' ছবিটি এদেশের সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্রই দেয়নি শুরুতে। বিদেশের মাটিতে পুরস্কার পাওয়ার পর ছাড়পত্র মেলে।
চলচ্চিত্র নিয়ে আন্দোলন করেন অনেকেই। কিন্তু তারেক মাসুদ নিজেই একটা বিপ্লব। তাই প্রথাগত আন্দোলন-সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে কেবলই কাজ করে গেছেন।
ভালো ছবি নাকি দর্শক দেখে না। ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয় প্রযোজককে। সারাদেশে প্রজেক্টর নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে ছবির প্রদর্শনী করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ভালো ছবি হলে মানুষ সেটা দেখে। বাণিজ্যের সঙ্গে শিল্পের একটা সেতু বানানোর নিরন্তর চেষ্টা ছিল তারেকের। তারেক মাসুদের বিশ্বাস ছিল, মূল ধারার ছবিকে পেছনে রেখে সামনে এগোনো যায় না।
আর তাই দেশীয় চলচ্চিত্র কাঠামো দাঁড় করানোর একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। সড়ক নামক মৃত্যু ফাঁদ সে প্রকল্পের ফলাফলটা দেখে যেতে দেয়নি তাকে। অর্ধশতক ধরে এদেশের জল-মাটি তৈরি করেছে তারেকের মতো মেধাবী মস্তিস্ক। হয়ে উঠেছেন একটা ময়না, মাটির ময়না। অথচ মুহূর্তেই ভেঙে গেল বাঙালির 'মাটির ময়না'।
কত সহজেই চলে যাওয়া শিখেছে মানুষ! প্রতিদিন কত কত মৃত্যুই তো খবরের কাগজে আসে। প্রতিটা মৃত্যুই যন্ত্রনা দেয়। কিন্তু একটা 'ময়না' চলে গেলে আরেকটা ময়না গড়তে শত বছর লেগে যায়। র্যাবের হাতে ৫ জন খুন হলো আগের দিনই। আমরা কেউ কিছু বলেছি? নিবি যখন নে, আমাদের মতো দু-চারজন অভাজনকে কি চোখে পড়ে না! কিন্তু তারেকের মতো 'ইন্ডাস্ট্রি'কে কেন? মৃত্যুও হয়ত মেধাবীদের 'মৃত্যু' উপহার দিয়ে গর্বের হাসি হাসে।
মূল লেখা এখানে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।