সত্য চীরকালই সত্য। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখলেই সত্য মিথ্যে হয়ে যায়না। নারী-পুরুষ বিতর্ক সেই আদি কাল থেকে শুরু হয়ে অদ্যাবধি চলছেই। আগপিছ্ না ভেবেই অনেকে এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। সম অধিকারের দাবী আদায়ে নারীগণ আজ রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছেন।
বেশির ভাগ নারী আন্দোলনকারীই ইসলামকে নারী দাস্বত্ব প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে আখ্যায়িত করছেন। এটা যে ইসলাম বিরোধী কিছু দুস্কৃতকারীর চক্রান্ত, সেটা কেউ বুঝার চেষ্টা করছেন না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এই- ইসলামই নারী অধিকার বাস্তবায়িত করে নারীকে দুনিয়ায় সম্মানিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। অত্যান্ত বিচক্ষণতার সাথে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে পারিবারিক জীবনে মহিলাদের সম্মানীয় অধিষ্ঠানের উপরে। কারণ পারিবারিক জীবনের সৌন্দর্য্য মহিলাদের সম্মানের উপরে নির্ভরশীল।
প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বেই ইসলাম নারীকে সম অধিকার দিয়ে গেছে। আর তাই ইসলামের আলোকেই নারী-পুরুষ সমতা বিধানের জয়-জয়কার এখানে তুলে ধরা হল।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
“যে ব্যক্তি ভাল কাজ করবে, হোক সে পুরুষ কিংবা নারী, এবং সে ঈমানদার হবে, এরূপ লোক জান্নাতে দাখিল হবে, আর তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র অবিচার করা হবে না। ” (আন-নিসা ৪:১২৪)
সুতরাং এটা বলা যায় যে মহান আল্লাহ তা 'আলা আমাদের বিচার করবেন মানুষ হিসেবে। নারী বা পুরুষ হিসেবে নয়।
আমরা আজকের আধুনিক সমাজের মানুষরা যারা নিজেদের মুক্তমনা বলে দাবি করি, যারা ইসলামকে নারী উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা মনে করি, তারা যদি ইসলামকে একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখি তাহলেই উপলব্ধি করতে পারবো ইসলাম নারীকে কতটুকু মর্যাদা দিয়েছে। মর্যাদার ক্ষেত্রে কখনোই নারী পুরুষের নীচে নয়। পরষ্পর সমান। ঠিক যেমনভাবে পরমানুতে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জ সমানভাবে থাকে বলেই অনুর ভারসাম্য বজায় থাকে, তেমনিভাবে ইসলামে নারী পুরুষের মর্যাদা ও অবস্থান সমান করা হয়েছে, যাতে পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় থাকে। পজিটিভ ও নেগেটিভ যেমন দুইটি ভিন্ন সত্বা, ঠিক তেমনি নারী-পুরুষও দুইটি ভিন্ন সত্বা।
আফ্সোস, আমাদের আজকের সমাজের নারীবাদীরা আসলে "নারী ও পুরুষের সমতা"র কথা বলতে গিয়ে একটি ভুল সবসময় করে চলেছেন। সেটা হল নারী ও পুরুষকে এক করে ফেলেন। নারী আর পুরুষ কি তাহলে এক? তাহলে দুইটি আলাদা সত্বার কি দরকার ছিল?
নারী ও পুরুষ দৈহিক, মানষিক, দায়িত্বে ও কর্তব্যে আলাদা। তারা সমান কিন্তু ভিন্ন। আমাদের সবার আগে এই বিষয়টি পরিষ্কার হতে হবে।
ইসলাম বলে নারী-পুরুষ মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য, কর্মেক্ষেত্র, প্রকৃতি ইত্যাদিতে ভিন্নতা রয়েছে। ইসলাম এ কথা বলে না যে, নারীর চেয়ে পুরুষ শ্রেষ্ঠতর; বরং নারী পুরুষ একে অপরের অংশ। একই মা-বাবার সন্তান। সৎকর্মশীল নারী পুরুষ নির্বিবেশে সবাইকে আল্লাহ তায়ালা সমান মর্যাদা ও পুরুস্কার দান করেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আমি তোমাদের মধ্যে কর্মে নিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না; তোমরা একে অপরের অংশ, তাহাদেরকে (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) প্রবেশ করাব জান্নাতে যাহার পাদদেশে নদী প্রকাশিত” (সূরা আলে ইমরানঃ ১৯৬)
বরং সৎকর্মের ফলে নারীও পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে। অসৎচরিত্রের পূরুষ কোনক্রমেই একজন সৎকর্মশীল নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। কুরআন এমনটি বলেনি।
নারী -পুরুষের প্রকৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীদেরও রয়েছে অবাদ কৌতূহল। তাইতো দিনের পর দিন অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলছে নারী-পুরুষ নিয়ে।
অনেক ফলাফল ও বেরিয়ে এসেছে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে বলেছেন নারী ও পুরুষ কখনোই এক নয়, নারী-পুরুষের দ্বৈত সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। তারা দেখেছেন, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের আচরণ, চিন্তাধারা, আবেগের বহিঃপ্রকাশ সম্পূর্ণভাবে পৃথক।
নারী ও পুরুষের প্রকৃতিগত পার্থক্যগুলো বের করে আনার জন্য বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন কিছু প্রযুক্তি। ম্যাগনেটিং ইমেজিং ও পজিট্রন টমোগ্রাফি হচ্ছে ঠিক এ ধরনের দু’টি প্রযুক্তি।
এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন আমাদের মস্তিষ্ক যে তিনটি ভাগে(লোয়ার, মিডল ও আপার ) বিভক্ত, নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। বিজ্ঞানীরা নারী ও পুরুষের উপর গবেষনা করে দেখেছেন যে, লোয়ার ব্রেন ও মিডল ব্রেনের শক্তিমত্তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ প্রায় সমানভাবে দক্ষ। অপর দিকে আপার ব্রেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীরা প্রায়ই সুপার ব্রেনের সীমারেখা পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও হাতেগোনা কিছু পুরুষ মস্তিষ্কের সেই অংশে পৌঁছাতে পারে। যার সৃজনশীল ক্ষমতা অন্যান্য অংশের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি। বিজ্ঞানীরা আরো প্রমান করেছেন যে, আমাদের ব্রেনের সামনের দিকে থাকে ইমোশনাল জোন যা ছেলেদেরটা থেকে মেয়েদেরটা দ্বিগুন।
তাই মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশী সংবেদনশীল হয়।
Louan Brizendine নামক একজন নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট তাঁর রচিত The Female Brain বইটিতে লিখেছেন নারীদের প্রকৃতিগত পার্থক্যের কথা। এই বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টারে একটি বাচ্চা মেয়ের কথা আছে, ওকে ওর বাবা-মা ইউনিসেক্স খেলনা উপহার দিতেন, মেয়ে বলে বার্বি দেবো তাতো হবে না, এই ভেবে। মেয়েকে ওনারা একদম স্বাধীনভাবে সত্তা তৈরী করতে সাহায্য করবেন, যাতে কিনা সে মোল্ডেড না হয়ে যায়। তো, ওকে লাল রঙের এক খেলনা ট্রাক কিনে দিয়েছেন ওনারা।
কিছুদিন পরে মা মেয়ের ঘরে ঢুকে দেখেন, ছোট্টো বেবী ব্ল্যাংকেটে ট্রাকটাকে শুইয়ে দোল দিতে দিতে মেয়েটা বলছে- "ডোন্ট ওরি, লিটল ট্রাকি, এভরিথিং উইল বী অলরাইট। "
উপরোক্ত তথ্যগুলো সেই সব মুক্তমনা নারীবাদীদের জন্য পেশ করলাম যাদের ধারণা নারীদেরকে যুগ যুগ ধরে পুরুষরা নারী বানিয়ে রেখেছে। আর কিছু নাস্তিকদের দাবী ধর্ম পুরুষতন্ত্রের তৈরী জীবন প্রথা, যেখানে নারীদের শুধুই নারী বানিয়ে রাখা হয়েছে। প্রকারান্তরে পুরুষরা নারীদেরকে শুধু ব্যবহারই করে চলেছে। কোরআন, বাইবেল ও বেদের কিছু উক্তি উল্লেখ করে প্রমান করতে চায়, পুরুষতান্ত্রিক স্রষ্টার কাছ থেকেই নারীরা বৈষম্যের শিকার(নাউজুবিল্লাহ্)।
কোরআনের যে অংশে নারীকে পুরুষের অধীন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা এই নয় যে, পুরুষ নারীদেরকে শুধু ব্যবহার করবে। ঐ অংশের অর্থ প্রাসঙ্গিক বুঝতে হবে। কোন খন্ডিত অংশের সদ্ব্যবহার করে নারীর উপর কর্তৃত্ব করার জন্য নয়। এই অংশের দোহাই দিয়ে পুরুষ নারীদেরকে অধীন করে রেখেছে, এটা ইসলামের দোষ নয়, নারীগণ এখানে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার বলী। আর বহু বিবাহের অধিকারের যে অংশ উল্লেখ করা হয় সেটাও প্রাসঙ্গিক।
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু সামগ্রীক বিবেচনায় ইসলামে এক বিবাহকেই উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কোরআনের যে আয়াতকে বহুবিবাহের দলিল হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তা হচ্ছে-
সূরা নিসায় মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন-
যদি তোমরা আশংকা কর যে এতিমদের প্রতি ন্যায় বিচার করতে পারবে না, ৫০৮, তবে [এতিমদের মধ্যে থেকে] দুই, তিন, অথবা চার জনকে বিবাহ করবে তোমার পছন্দমত। কিন্তু যদি আশাংকা কর তুমি [তাদের সকলের] সাথে সুবিচার করতে পারবে না, তবে শুধুমাত্র একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে [বিবাহ করবে]। ইহা তোমাদের জন্য অন্যায় রোধের অধিকতর উপযুক্ত ৫০৯।
আয়াতটিতে এতিম মেয়েদের বিবাহের ব্যাপারে এখানে চার বিয়ের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। যারা চার বিয়ের পক্ষপাতি তাদের মনে রাখতে হবে, চার বিয়ের আয়াতটি নাজেল হয়েছিল ওহুদের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। শান্তির সময়ে বা সুস্থ সময়ে তা প্রযোজ্য নয়। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বহু পরিজন শাহাদাৎ লাভ করেন। বহু নারী বিধবা হন।
বহু মেয়ে এতিম হন। এই বিধবা, এতিম নারীদের সমাজে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যেই আয়াতটি নাজেল হয়েছে। এদের প্রতি আচরণ যেন মানবিক এবং ন্যায়সঙ্গত হয়, এই আয়াতটি তারই বার্তা বহন করে। সমাজে যেনো এতিম বা বিধবারা সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে তাই-ই এই ব্যবস্থা। ওহুদের যুদ্ধ গত হয়েছে, কিন্তু এর যে নীতি তা এখনও বলবৎ আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পাশ্চাত্য দেশ সমূহে সক্ষম যুব সমাজ যুদ্ধে নিহত হওয়ার ফলে দেশে বিবাহযোগ্য অবিবাহিত নারীর সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু যেহেতু তাদের ধর্মে পুরুষের এক বিয়ের রীতি, সেই কারণে বহু মেয়েকে চির জীবন কুমারী জীবন যাপন করতে হয়। যদিও এদের গ্রাচ্ছাস্বদনের অভাব ছিল না, রাষ্ট্রই তাদের সে ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু মানুষ মাত্রই কামনা বাসনা থাকবে। এই কামনা পীড়িত হয়ে বহু মেয়েকেই অবৈধ জীবন যাপন করতে হয়। মেয়েদের ঘর-সংসার করার, বা মা হওয়ার জন্মগত যে আকাঙ্খা তা পূরণ হওয়া সম্ভব ছিল না।
এরকম অবস্থাতেই শুধুমাত্র চার-বিয়ের সুফল ভোগ করা যায়।
অতীতকাল থেকেই কিছু লোক সমাজে সব সময়ই তৎপর থাকে, কোরআন-হাদিস তথা আইনের কিছু পংক্তির ফাঁক-ফোকর বের করে কিভাবে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। আইনকে বা লোকচক্ষুকে ফাঁকি দেওয়াই সর্বোচ্চ বুদ্ধিমানের কাজ নয়, আমানতকারীর বিশ্বস্ততাই আল্লাহ্র কাছে কাম্য।
“কিন্তু যদি আশাংকা কর তুমি [তাদের সকলের] সাথে সুবিচার করতে পারবে না, তবে শুধুমাত্র একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে [বিবাহ করবে]। ”
একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন বান্দার পক্ষে সম্ভব নয়, অন্য বান্দাদের প্রতি সুবিচার করা।
সুতরাং এই অর্থে চিন্তা করলে, একের অধিক বিবাহের চিন্তা করা কতটা যৌক্তিক, আপনারাই চিন্তা করুন।
আসলে সৃষ্টির শুরু থেকেই নারী-পুরুষ প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্ট আলাদা দুইটি ভিন্ন স্বত্বা। আর এই ভিন্নতার জন্যই তারা দায়িত্ব ও কর্তব্যে ভিন্ন। তাই ইসলামে নারী-পুরুষের ভিন্ন প্রেক্ষাপটগুলো স্পষ্টভাবে নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছে। এখানে নারী কেন পুরুষ যা করে তা করতে পারবেনা, এই প্রসঙ্গ তোলা অবান্তর।
সংসার ও জীবন পথে পুরুষ কর্তৃত্বের কথা? সেটাও সৃষ্টি-প্রকৃতি কর্তৃক নির্ধারিত। পৃথিবীতে উভয় লিঙ্গের যত প্রাণীকুল সৃষ্টি রয়েছে, তাদের দিকে তাকালেও পুরুষ কর্তৃত্বের নিদর্শনই পরিলক্ষীত হয়। সেটাকে সৃষ্টি বৈষম্য হিসাবে চিন্তা না করে, উভয়কে উভয় সৃষ্টির অংশ বিবেচনা করাই শ্রেয়। সেটাই প্রেম, ভালবাসা, যা জীবনের গতিপথ নির্দেশক। এমনতো নয় যে মানুষকে আল্লাহ সৃস্টি করেছেন, ছাগলকেও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।
মানুষ ছাগলের উপর কর্তৃত্ব করে ছাগলের মাংস ভক্ষণ করে, কিন্তু ছাগল মানুষের উপর কোন কর্তৃত্বও করেনা মানুষের মাংসও ছাগল ভক্ষণ করেনা। এখন সৃষ্টি কর্তার কাছে ছাগল যদি দাবী করে, হে আল্লাহ মানুষ যদি আমার উপর কর্তৃত্ব করতে পারে, আমার মাংস ভক্ষণ করতে পারে তাহলে আমি কেন পারবনা মানুষের মাংস ভক্ষণ করতে। এটা তোমার কেমন সৃষ্টি বৈষম্য? এই প্রসঙ্গ কতটা যৌক্তিক?
আমি এখন কিছু ক্ষেত্র তুলে ধরব যেখানে নারী ও পুরুষকে সমান দায়িত্ব পালন করেত হবেঃ
১। ইবাদতের ক্ষেত্রে - নারী ও পুরুষ কে সমান ধর্ম কর্ম করতে হবে। নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত সবাইকে সমানভাবে পালন করতে হবে।
সবারই আত্তার পরিশুদ্ধি সমান হতে হবে।
২। জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে - নারী এবং পুরুষ উভয়কেই সমান ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। গভীরভাবে জানতে হবে কুরআন, হাদীস। পর্যালোচনা করতে হবে এবং পার্থিব জীবনে চলার জন্যও নারী ও পুরুষ উভয়কেই গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
৩। সামাজিক কর্মকান্ডে - সমাজের অরাজকতা, কুসংস্কার, শয়তানি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে জিহাদে অংশগ্রহন করতে হবে। নারীরা ঘরে বসে থাকলে চলবেনা। সমাজের উন্নয়নমূলক সকল কাজে উভয়কেই সমানভাবে অবদান রাখতে হবে।
এগুলোই শেষ নয়।
আরো অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে।
এবার আসি যেখানে নারী ও পুরুষের দায়িত্ব কিছুটা ভিন্নঃ
১। পর্দার ক্ষেত্রে - নারী ও পুরুষ উভয়কেই পর্দা করে চলতে হবে, তবে এখানে ভিন্ন সীমারেখা রয়েছে। পুরুষের পর্দার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা আলা বলেছেন-
(হে রাসূল!) মোমেন পুরুষদের বলোঃ তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে চলে। এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহ হেফাজত তরে।
এটা তাদের আরো পবিত্র হয়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। (তাদের চরিত্র নির্মাণের জন্য) যা কিছুই তারা করে অবশ্য অবশ্যই আল্লাহ সে সব কিছু সম্পর্কেই খবর রাখবেন। (সূরা নূরঃ ৩০)
নারীর পর্দার ক্ষেত্রে কোরআনে আল্লাহতা’লা বলেছেন-
আর (হে নবী) মোমেন স্ত্রীলোকদের বলুন! তারা যেন নিজেদের চোখ অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের যথাযথ সংরক্ষণ করে। আর যেন প্রদর্শনী না করে তাদের রুপ-সৌন্দর্য ও অলংকারের। তবে এ সবের মধ্যে যা অনিবার্যভাবে প্রকাশ পেয়ে যায়।
আর তারা যেন ঝুলিয়ে দেয় তাদের ওড়না তাদের বুকের ওপর। আর তারা প্রকাশ করবে না তাদের রুপ-সৌন্দর্য তাদের ছাড়া- স্বামী অথবা তাদের পিতা অথবা তাদের স্বামীদের পিতা (শ্বশুর) অথবা তাদের পুত্র। (সূরা নূরঃ৩১)
পর্দা অর্থ নারীকে চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখা নয়; বরং পর্দা হল নারীর সম্ভ্রম রক্ষার এক মজবুত দূর্গ। নারীরা জ্বীনতত্বের আলোকে বা প্রকৃতিগতভাবেই জৈবিকভাবে পুরুষের চেয়ে অধিক সৌন্দর্যের অধিকারী। এটা অস্বীকার করা যাবেনা।
মানুষ সৌন্দর্যের পুজারী। নারী সৌন্দর্যে তাই খুব সহজেই পুরুষ আকৃষ্ট হয়। এটা প্রকৃতিরই নিয়ম। তাই নারীদের পর্দার সীমারেখা পুরুষদের চেয়ে বেশি, আর এতেই নারীর সম্মান বৃদ্ধি পায়। আমাদের বর্তমান সমাজের নারীবাদীরা এটা অস্বীকার করে অন্যভাবে ব্যবহার করার কোন উপায় নেই।
মা-বোনেরা পর্দা আরম্ভ করলে যে, স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের হীন স্বার্থ চরিতার্থে অসুবিধার সৃষ্টি হয়, সেজন্য তারা একেক সময় একেক অজুহাতে নারীকে প্রলোভন দেখিয়ে পর্দার বিধান লংঘণ করতে উসকানি দেয় এবং অবৈধ মজা লুটতে থাকে। কিন্তু বিবেকবান প্রতিটি মানুষ একথা স্বীকার করে নিবেন যে, মূল্যবান যেকোন বস্তুই সুরক্ষিত স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। নতুবা সমূহ বিপদের আশংকা সব সময়ই পিছু তাড়া করতে থাকে। এজন্যই তো মানুষ হীরা-জহরতের সংরক্ষণ পূর্ণ সতর্কতার সাথে করে থাকে। মানুষের কাছে যেমন হীরা-জহরতের মূল্য বুঝে আসার দরুন তার কদর বেড়েছে, তেমনি নারীর মূল্য আল্লাহর কাছে বহুগুণ হওয়ার কারণে, তার পূর্ণ সংরক্ষণের জন্য তিনি শরয়ী পর্দার বিধান দিয়েছেন।
২। পারিবারিক দায়িত্বে - পরিবারে সন্তান, স্বামী, অন্যান্য সদস্যদের দেখাশুনা এই দায়িত্বগুলো নারীদের, আর সবার ভরণপোষণের দায়িত্ব মূলত পুরুষদের দেওয়া হয়েছে। ইসলামে পারিবারিক জীবন এবং এই জীবনের সৌন্দর্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে পারিবারিক জীবনে মহিলাদের সম্মানীয় অধিষ্ঠানের উপরে। কারণ পারিবারিক জীবনের সৌন্দর্য্য মহিলাদের সম্মানের উপরে নির্ভরশীল।
একটি শিশুর বেড়ে উঠার জন্য যেমন খাদ্য প্রয়োজন, তেমনি মানসিক বিকাশেরও প্রয়োজন। আর মানসিক বিকাশের দায়িত্বটা মূলত মায়ের। এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে নারীদের প্রকৃতিগত পার্থক্যের কারনেই। অথচ এত বড় দায়িত্বটাকে আমাদের বর্তমান সমাজে অনেক ছোট করে দেখা হয়। তবে পরিবারের দেখাশুনা করতে গিয়ে নারীদের চার দেয়ালে বন্দী হতে বলেনি ইসলাম।
এটার পাশাপাশি নারীরা তাদের পর্দা ঠিক রেখে নিজেদের স্বাবলম্বী করার জন্য অথবা পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক কাজ করতে পারে ঘরের বাইরে। আল্লাহ কাউকেই পরনির্ভরশীল দেখতে পছন্দ করেন না। নিজ হাতে যে কাজ করে খায় তাকেই আল্লাহ বেশী পছন্দ করেন।
এবার আসুন পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতা’লা নারী-পুরুষের সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে কি বলেছেন তার বিশ্লেষণ দেখি-
সূরা- ফাতির এ আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন-
আল্লাহ্ তোমাদের ধূলি থেকে সৃষ্টি করেছেন (৩৮৮৪)। অতঃপর শুক্রবিন্দু থেকে ,তারপর তিনি তোমাদের [ নারী-পুরুষের ] যুগল করেছেন (৩৮৮৫)।
তার অজ্ঞাতে কোন নারী গর্ভ ধারণ করে না অথবা প্রসবও করে না। সংরক্ষিত ফলকে [ লিপিবদ্ধ ] ব্যতীত কোন বৃদ্ধ ব্যক্তির আয়ু বৃদ্ধি করা হয় না , অথবা আয়ু হ্রাস করা হয় না (৩৮৮৬)। এ সকলই আল্লাহ্র জন্য অতি সহজ (৩৮৮৭)।
৩৮৮৪। দেখুন মানুষের সৃষ্টি সম্বন্ধে আয়াত [ ১৮ : ৩৭ ] ও টিকা ২৩৭৯; আয়াত [ ২২ : ৫ ] ও টিকা ২৭৭৩; এবং আয়াত [ ৩০ : ২০ ] ও টিকা ৩৫২৪।
এখানে বলা হয়েছে মানুষের নশ্বর দেহ তৈরী হয়েছে অত্যন্ত মূল্যহীন এবং নগন্য বস্তু থেকে, তা শুধুমাত্র মাটি; মৃত্যুর পরে যা মাটিতে মিশে যাবে। জন্ম প্রক্রিয়াতে পুরুষ যে শুক্র নির্গত করে তা অত্যন্ত গোপনীয় এবং লজ্জাজনক। মহিলাদের বেলাতেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। যৌন রহস্যের সাথে প্রাণীর জন্মসুত্র গ্রথিত, তা এই সত্যকেই প্রমাণ করে যে, পৃথিবীতে পুরুষ বা নারী একক ভাবে কোন মহৎ কিছু সৃষ্টিতে অক্ষম। উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপরেই মানুষের দ্বারা মহৎ কিছু সৃষ্টি সম্ভব, স্ত্রী ও পুরুষ কেহই একক ভাবে স্বয়ঃসম্পূর্ণ নয়।
মানুষের সম্মান, ক্ষমতা, জ্ঞান, বুদ্ধি কোন কিছুই তার নিজস্ব নয়। সবই পরম করুণাময় আল্লাহ্র দান।
৩৮৮৫। "তারপর তোমাদের যুগল করেছেন। " এই "তারপর " শব্দটি দ্বারা সময়কে বোঝানো হয় নাই, বরং যুক্তির ধারাবাহিকতাকে প্রকাশ করা হয়েছে।
এই " তারপর" শব্দটি দ্বারা "অধিকন্তু " 'আরও ' এবং ও 'সংযোজন ' বোঝানো হয়েছে।
৩৮৮৬। যা কিছু অপ্রকাশিত, গুপ্ত, রহস্যজনক, যার রহস্য মানুষ উদ্ধার করতে পারে না, তা সবই আল্লাহ্র কাছে প্রকাশ্য। ভূত, ভবিষ্যত, বর্তমান সবই তিনি জানেন, সবই তাঁর প্রতিষ্ঠিত আইনের আওতাভুক্ত, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুই তাঁর আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে এবং তিনি সর্বজ্ঞ। পৃথিবীতে অনেক কিছু আছে যার ব্যাখ্যা মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির বাইরে।
মায়ের পেটে আমাদের জন্মলাভ আকস্মিক ঘটনা বই কিছু নয়। কেউ জন্মায় রাজার ঘরে কেউ জন্মায় দরিদ্রের হতভাগ্য সন্তান রূপে। এই জন্মের উপরে কারও হাত নাই। কিন্তু আল্লাহ্র অজ্ঞাতসারে কোনও নারী গর্ভ ধারণ করে না এবং প্রসবও করে না। জীবনের সৃষ্টি রহস্য আল্লাহ্র হাতে [ দেখুন আয়াত ৩১ : ৩৪ ও টিকা ৩৬২৫ ]।
যৌন রহস্য মানুষের অজ্ঞাত। মানুষের সন্তান পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা অসহায় শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করে এবং পূর্ণাঙ্গ যৌবন প্রাপ্ত হয়ে সংসারের উপযুক্ত হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। নারী পুরুষের যৌন আকাঙ্খা থেকে সংসারের সৃষ্টি। আর সংসার হচ্ছে মানব সন্তানের জন্য সর্বাপেক্ষা নিরাপদ আশ্রয়। যৌন রহস্যের প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহ্র কাছে।
জীবন মৃত্যুর জ্ঞান এবং এরূপ বহু কিছু আছে যার প্রকৃত কারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। কিন্তু এগুলির জ্ঞান আল্লাহ্র নিকট রক্ষিত। তিনি-ই এর প্রতিষ্ঠাতা ও বিন্যস্তকারী।
৩৮৮৭। আল্লাহ্র জ্ঞান বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে আছে।
মানুষ এই জ্ঞান আহরণ করে অত্যন্ত পরিশ্রম, ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে। কিন্তু আল্লাহ্র জ্ঞান সম্পূর্ণ আলাদা। এজন্য তাঁর কোন কষ্ট বা পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। " আল্লাহ্র জন্য তা অত্যন্ত সহজ। "
পৃথিবীতে যতগুলি অত্যাশ্চার্য রহস্য আছে তার মধ্যে নারী ও পুরুষের মিলনের রহস্য অন্যতম।
এই মিলনের ফলেই সন্তানের জন্ম। এই মিলনের ফলেই সাংসারিক বন্ধন, প্রেম, ভালোবাসা। পুরুষ তার শারীরিক শক্তির আধিক্যে, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বোধে, অহংকারে ভুলে যায় সৃষ্টির এই আশ্চর্য রহস্যে মেয়েদের ভূমিকা তাদের থেকে কোন অংশে কম নয়। তার যুগল জীবনের সুখ শান্তি তার ভবিষ্যত জীবনের বংশধর, এ সব কিছুর জন্য সে মেয়েদের ভূমিকার কাছে ঋণী। যিনি গর্ভে ধারণ করেন, তিনি অবশ্যই শ্রদ্ধার পাত্রী।
স্ত্রীর কারণেই পুরুষ পিতৃত্বের গৌরব অনুভব করে। এ কারণেই পুরুষ জাতির মেয়েদের সম্মান করা উচিত। পুরুষ ও নারীর মিলিত জীবনই হচ্ছে সংসার জীবনের মূল সেতুবন্ধ। আমাদের পরস্পরের প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ব সবই আল্লাহ্র বিধান এবং আমাদের চরিত্রের এই কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ আল্লাহ্রই দান।
খুব সহজ একটি উদাহরণ দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই।
একই ক্লাসে দুইজন যুগ্মভাবে পরীক্ষায় প্রথম হল। একজন ছেলে, একজন মেয়ে। দুইজনই সমান নম্বর পেল, ৮০ করে। শিক্ষকগণ তাই তাদের প্রাপ্ত নম্বর পর্যালোচনা করতে শুরু করলেন। মোট প্রশ্ন ১০ টি।
প্রথম প্রশ্নে ছেলেটি পেল ১০, মেয়েটি ৮। পরের প্রশ্নে মেয়েটি ৯, ছেলেটি ৭। পরের প্রশ্নে দুজনেই ৭। এভাবে ১০ টি প্রশ্ন পর্যালোচনা করার পর দেখা গেল কিছু প্রশ্নে ছেলে বেশী নম্বর পেয়েছে, আবার কিছু প্রশ্নে মেয়েটি বেশী পেয়েছে, আবার কিছু প্রশ্নে দুইজনই সমান পেয়েছে। কিন্তু মোট নম্বর দুইজনেরই সমান।
ঠিক তেমনি ভাবে আল্লাহ কিছু ক্ষেত্রে নারীকে বেশী অধিকার, কিছু ক্ষেত্রে পুরুষকে বেশী অধিকার, কিছু ক্ষেত্রে উভয়কেই সমান অধিকার দিয়েছেন।
সব মিলিয়ে নারী ও পুরুষ সমান মর্যাদাসম্পন্ন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।