একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ সম্ভবত ইরাক যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জর্জিয়া, ইউক্রেন, নেদারল্যান্ড, স্পেন, এল সালভাদর, জাপান, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, আর্মেনিয়া, মঙ্গোলিয়া, হাঙ্গেরি, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ মোট ৪১টি দেশ ইরাকে হামলা চালায়। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র তৈরি করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর হামলা করতে চান। কিন্তু বিবিসি আজ সোমবার এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, যে অজুহাতে ইরাকে হামলা চালানো হয়, তা ছিল পুরোপুরি মিথ্যা। দুজন গুপ্তচর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বোকা বানিয়েছিল।
২০০৩ সালের ২০ মার্চ থেকে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় নয় বছরব্যাপী এ যুদ্ধে ইরাক কী হারিয়েছে, তার হিসাব আজও হয়নি। কত মানুষ প্রাণ হরিয়েছে, কতজন পঙ্গু হয়েছে, কত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, কত শিশু অকালে মরে গেছে, কত হাহাকার ইরাকের দজলা-ফোরাতে ভেসে গেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে ইরাকের কয়েক হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা, পাঠাগার, জাদুঘর, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার, সৌধ ও সম্পদ।
ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি ব্যয় এক লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার (প্রায় এক কোটি ৩৩ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা)। যুদ্ধফেরত সেনাদের পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ আরও ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি ডলার (প্রায় ৩৮ লাখ ৫২১ হাজার কোটি টাকা)।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটের ‘কস্টস অব ওয়্যার’ প্রকল্প গত বৃহস্পতিবার ইরাক যুদ্ধের ব্যয় নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ইরাক থেকে যুদ্ধফেরত সেনাদের জন্য আগামী ৪০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও ছয় ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় চার কোটি ৭২ লাখ কোটি টাকা) ব্যয় করতে হবে।
প্রকল্পটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শুধু সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী যুদ্ধে মৃত ইরাকিদের সংখ্যা কমপক্ষে এক লাখ ৩৪ হাজার। তবে সঠিকভাবে হিসাব করলে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে এ সংখ্যা বেড়ে চার গুণ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, যুদ্ধকালে যেসব মৃত্যুর খবর বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, কেবল সেগুলোই গণনায় ধরা হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন মৃত্যুর খোঁজ মিলছে এবং এ জন্য সংখ্যাটি ক্রমে বড় হচ্ছে।
মিথ্যা ও হেলাফেলা
কিন্তু এমন একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মিথ্যা আর খামখেয়ালি দিয়ে। যেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইরাক আক্রমণের যৌক্তিকতা দাঁড় করানো হয়েছিল, তা ছিল দুর্বল, কখনো কখনো ভিত্তিহীন।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে বিবিসির বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্যানোরমায় ইরাক যুদ্ধে প্রতারণার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। বিবিসি জানায়, যুদ্ধ শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছিল যে ইরাকের কাছে কোনো মারণাস্ত্র নেই। কিন্তু তবু স্বল্প নির্ভরযোগ্য ও দুর্বল সূত্রের কথার ওপর ভিত্তি করে ইরাক আক্রমণ করা হয়।
ইরাক যুদ্ধের ছয় মাস আগে ২০০২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বলেছিলেন, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘(অস্ত্র বানানোর) প্রকল্প বন্ধ করা হয়নি। এটি ছিল এবং এখনো চলছে। ’ বিবিসি বলছে, যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টি যৌক্তিক করতেই টনি এ ধরনের গোয়েন্দাসূত্র ব্যবহার করেছিলেন।
ওই দিনই ইরাকের মারণাস্ত্র নিয়ে গোপন নথিপত্র প্রকাশ করে ব্রিটেন।
নথিপত্রের সঙ্গে টনি ব্লেয়ারের একটি ভূমিকাও জুড়ে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি ব্রিটেনবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন, সাদ্দামের কাছে যে মারণাস্ত্র আছে, তা ‘সন্দেহাতীত’।
নথিগুলো প্রকাশের সময় গোয়েন্দাসূত্রগুলোর সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই তোলা হয়নি। এমআইসিক্স ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে যে সংযুক্ত গোয়েন্দা কমিটি তৈরি হয়েছিল, সেটির দেওয়া তথ্য ‘এলোমেলো ও জোড়াতালি দেওয়া’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’ হলেও সেগুলো সত্য বলে গ্রহণ করা হয়েছিল।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছে থাকা তথ্যগুলো ছিল গাঁজাখুড়ি, গোঁজামিল দেওয়া ও মিথ্যাসর্বস্ব।
ওই সময় ব্রিটেনের সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল মাইক জ্যাকসন। তিনি বলেন, ‘গোয়েন্দারা কিছু বিষয় সোনা ভেবে বোকা বনেছিলেন। কারণ, যেগুলো সোনা বলে মনে হয়েছিল, তা কখনোই সোনা ছিল না। ’
যুদ্ধের পর সাদ্দামের কথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্র নিয়ে প্রথম তদন্তকারী ব্রিটিশ দলের প্রধান ছিলেন লর্ড বাটলার। তিনি বিবিসিকে বলেন, ব্লেয়ার ও তাঁর গোয়েন্দারা নিজেদের ‘ধোঁকা দিয়েছিলেন’।
মাইক জ্যাকসন ও লর্ড বাটলার অবশ্য বলছেন, টনি ব্লেয়ার মিথ্যাবাদী নন। কারণ, তিনি সত্যিই বিশ্বাস করতেন সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে।
চোরের ওপর বাটপারি
যে গুপ্তচরেরা সবচেয়ে বড় বাটপারি করেছেন, তাঁদের শিরোমণি রাফিদ আহমেদ আওয়ান আল জানাবি। তিনি সাদ্দামের পক্ষ ত্যাগ করে ব্রিটেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
রাফিদের মিথ্যাচার ও ফাঁদা গল্প গোয়েন্দাদের কাছে সত্যি বলে মনে হয়েছিল।
বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিভেদ সৃষ্টিকারী যুদ্ধ শুরুর জন্যও তিনি দায়ী। আর তিনি যা করেছেন, সেটি গোয়েন্দাবৃত্তির ইতিহাসে অন্যতম ‘চরম ব্যর্থতা’।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা রাফিদের কোড নাম দিয়েছিলেন ‘কার্ভবল’ অর্থাত্ খেলার মাঠে যে বল হঠাত্ করে বাঁক নেয়। রাফিদ এই নামের সার্থকতা ধরে রেখেছিলেন।
১৯৯৯ সালে রাসায়নিক প্রকৌশলী রাফিদ জার্মানিতে আশ্রয়প্রার্থী হন।
সে সময় তাঁর সঙ্গে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা বুন্দেসনাকরিক্টনডিন্সটের (বিএনডি) যোগাযোগ হয়। তিনি বিএনডিকে বলেন, ইরাক সরকার ভ্রাম্যমাণ জীবতাত্ত্বিক গবেষণাগার তৈরি করেছে। ট্রাকের ওপর তুলে এগুলো এদিক-সেদিক নেওয়া হয়। এগুলোর ওপর যেন কেউ হামলা করতে না পারে, সে জন্যই এসব করা হয়েছিল।
জার্মান গোয়েন্দারা রাফিদকে বিশ্বাস না করলেও মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করেন।
এমআইসিক্স অবশ্য সে সময় রাফিদকে সন্দেহ করত। কিন্তু পরে তারা রাফিদের ওপর ভরসা করতে শুরু করে। মার্কিনদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
রাফিদ পরে মিথ্যাচারের কথা স্বীকার করেন।
রাফিদের মতো আরেক গুপ্তচর ধোঁকাবাজি করেছিলেন।
তিনি ইরাকের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান মেজর মুহাম্মদ হারিজ। তিনি দাবি করেছিলেন, ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগার তৈরি তাঁরই পরিকল্পনা। এ জন্য তিনি ফরাসি গাড়ি নির্মাতা রেনোকে সাতটি ট্রাক সরবরাহ করার ফরমায়েশ দিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি জর্ডানে মার্কিন গোয়েন্দাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।
মুহাম্মদ হারিজ সম্ভবত একটি নতুন ঠিকানার খোঁজে অমন মিথ্যাচার করেছিলেন।
তবে যুদ্ধ শুরুর ১০ মাস আগে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাঁর জারিজুরি ধরে ফেলে এবং তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে।
রাফিদের সূত্রে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা আরেক গুপ্তচরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁর কোড নাম ছিল ‘রেড রিভার’। তিনি আরেক সূত্রকে উদ্ধৃত করে এমআইসিক্সকে জানান, ইরাকিরা ট্রাকের ওপর গাঁজনযন্ত্র বসিয়েছে।
গোয়েন্দারা সে তথ্য বিশ্বাস করেছিলেন, অথচ রেড রিভার কখনো বলেননি, গাঁজনযন্ত্রগুলো দিয়ে কী করা হতো।
নির্ভরযোগ্য সূত্র
তবে গোয়েন্দাদের সব সূত্র ভুল বা প্রতারক ছিল না। এমন গুপ্তচর কমপক্ষে দুজন। তাঁরা দুজনই বলেছিলেন, সাদ্দামের কাছে কোনো মারণাস্ত্র নেই। তাঁদের একজন সিআইএর চর ও ইরাকের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাজি সাব্রি।
প্যারিসে সিআইএর প্রধান বিল মারি এক আরব সাংবাদিকের সহায়তা নিয়ে নাজি সাব্রির সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এ জন্য তিনি নাজিকে আগাম দুই লাখ ডলার (প্রায় এক কোটি ৫৭ লাখ টাকা) দিয়েছিলেন।
আরেকটি সূত্র হলো, ইরাকের গোয়েন্দাপ্রধান তাহির জলিল হাব্বুশ আল তিকরিতি। এমআইসিক্সের এক কর্মকর্তা ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে জর্ডানে তাহির জলিলের সঙ্গে দেখা করেন। যুদ্ধ শুরুর দুই মাস আগে এ সাক্ষাত্ হয়।
তথ্য বিনিময়ের জন্য তাহির শর্ত দিয়েছিলেন, কোনো হামলা করা চলবে না।
তিনি বলেছিলেন, সাদ্দামের কাছে কোনো মারণাস্ত্র নেই। তবে তাঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন গোয়েন্দারা।
ইরাকে তদন্তকারী দলের প্রধান লর্ড বাটলার বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দেশকে ভুল পথে পরিচালিত করেছেন এটা বিশ্বাস করার অধিকার প্রত্যেক ব্রিটেনবাসীর আছে। তিনি জানিয়েছেন, তাহিরের দেওয়া তথ্য হাতে পাওয়ার পর তিনি সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।
আমার মনে হয়, আমাদের হিসাব-নিকাশে ভুল ছিল। যখন এ তথ্যের কথা আমরা বলেছিলাম, তখন এমআইসিক্সের বড় কর্মকর্তারা বলেছিলেন, সাদ্দাম আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য (তাহিরকে দিয়ে) ওই তথ্য আমাদের দিয়েছেন। ’
সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা বিল মারি গোয়েন্দাদের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধপূর্ব সময়ে যে ধরনের গোয়েন্দাগিরি করা যায়, আমরা সম্ভবত সেটার সেরাটাই করেছি। অনেক পরে দেখা গেছে, আমাদের তথ্যগুলো ঠিক ছিল।
কিন্তু যখন প্রয়োজন ছিল, তখন সেগুলো বাতিল বলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কোনো কাজেই লাগানো হয়নি।
সূত্র: প্রথম আলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।