আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তামিমের মুখেই মানায় (যাচাই করুন আপনি গোল্ডফিশ কিনা)

বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ প্রথম আলোতেই একবার লিখেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিশক্তি গোল্ডফিশের মতো। গোল্ডফিশ কয়েক সেকেন্ড আগের ঘটনাও মনে রাখতে পারে না। অ্যাকুরিয়ামের এক পাশ থেকে আরেক পাশে যেতে যেতে তার মনে হয়, অনন্ত সাগরে ভাসছি! হুমায়ূন আহমেদ কথাটা বলেছিলেন মানুষের রাজনৈতিক ভাবনা প্রসঙ্গে। কিন্তু ক্রিকেটের ক্ষেত্রে কি কথাটা আরও বেশি সত্য নয়? বিশেষ করে তামিম ইকবালকে ঘিরে গত কয়েক দিনে যা হলো এবং হচ্ছে, তারপর তো অবশ্যই! খুব বেশি নয়, এই ১৫ মাস পেছনে চলুন। ‘লর্ডসে সেঞ্চুরি করতে চাই’—দেশে থাকতেই ঘোষণা দিয়ে ইংল্যান্ড গেলেন তামিম।

ওখানে গিয়েও প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলেন ইচ্ছের কথা। আঙুলে চোট, তামিম তবু লর্ডসে খেলবেনই। বাবার স্বপ্ন, নিজের স্বপ্ন লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তোলা। পূরণ করতেই হবে। এবং কী অনায়াসেই না করলেন! নাকউঁচু ব্রিটিশরা প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিল।

ব্রিটিশ মিডিয়ায় বিস্ময়, ‘ছেলে বটে, বলে-কয়ে সেঞ্চুরি করে!’ আর দেশে তো ধন্যি ধন্যি! সেঞ্চুরির পর যে লাফটা দিলেন, অনার্স বোর্ডে নাম তোলার ইঙ্গিত করলেন, এসব দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া, ‘বাংলাদেশের কেউ এমন উদ্যাপন করতে পারে!’ বাংলাদেশ ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে ইংল্যান্ড এসেছিল বাংলাদেশে। মিরপুরের ওয়ানডেতে তামিম ১২০ বলে ১২৫ করার পর কেভিন পিটারসেন বলেছিলেন, ‘পারলে ম্যানচেস্টারে সেঞ্চুরি করো, বুঝব কত বড় ব্যাটসম্যান!’ তামিম পিটারসেনকে নিজের জাতটা চিনিয়েছিলেন। সেঞ্চুরির পর তাকিয়েছিলেন পিটারসেনের দিকে। কেপির দৃষ্টিতে ছিল চ্যালেঞ্জে হার মেনে নেওয়া। আমরা বলেছিলাম, ‘শাব্বাশ তামিম, বাঘের বাচ্চা!’ সেঞ্চুরি দুটি যেভাবে করেছিলেন, তা নিয়ে কত লেখা, কত কাব্য হলো! অ্যান্ডারসন-ব্রেসনান-ফিন-সোয়ানদের তুলোধুনো করে ছেড়েছিলেন।

সেটাও ইংলিশ গ্রীষ্মের শুরুতে, কন্ডিশন যখন সবচেয়ে কঠিন। ওই অ্যান্ডারসন-ব্রেসনানরা টেন্ডুলকার-লক্ষ্মণদের কীভাবে নবিশের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন, তা তো এখন আমরা দেখছিই। পরে পাকিস্তানের ইংল্যান্ড সফরের সময় নাসের হুসেইন যখন বললেন, ‘পাকিস্তান দলে তামিমের মতো একজন ব্যাটসম্যান নেই’, গর্বে আমাদের বুকের ছাতি কয়েক ফুট চওড়া হয়ে গেল। ওই ইনিংস দুটির কল্যাণে উইজডেনের ৫ বর্ষসেরার একজন হলেন তামিম। হায়, আমরা সব ভুলে গেছি! লর্ডসে ঘোষণা দিয়ে সেঞ্চুরির সময় কেউ বলেনি, ‘এত বড় বড় কথা কেন’ বা ‘কথা কম কাজ বেশি!’ তা ছাড়া ব্যাটিংয়ের মতো মাঠে আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপেও দাপুটে তামিম।

এবং যা নিয়ে এত দিন আমাদের গর্বের শেষ ছিল না। খুব বেশি দিন হয়নি, আমাদের সবচেয়ে বড় আফসোস ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নিজেদের অনেক ছোট ভেবে মাঠে নামেন। তামিম এলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী হয়ে। ব্যাটে যেমন, তেমনি প্রতিপক্ষকে ‘খুন’ করে ফেলেন শরীরী ভাষাতেও। আমরা চমত্কৃত।

হঠাত্ এক টেস্টের ব্যর্থতায় আমরা আবিষ্কার করে ফেললাম তামিম কাজের চেয়ে কথা বেশি বলেন! মনে প্রশ্ন জাগে, ওই ‘কাজ’ তামিমের চেয়ে বেশি বাংলাদেশ দলে আর কে করতে পেরেছেন? ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেই ইনিংস, দেশের বাইরে আমাদের প্রথম টেস্ট জয়ে (কিংস্টনে) দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৮ করে ম্যাচ-সেরা, ব্রিটিশ মুল্লুকে আমাদের মাথা উঁচু করে দেওয়া ইনিংস দুটো, ভারতের বিপক্ষে মিরপুরে দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮৩ বলে ১৫১, চার্লস কভেন্ট্রির ১৯৪ ম্লান করে দেওয়া ১৫৪, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই চট্টগ্রামে ৭ ছয়...চাইলে যোগ করা যায় আরও। ধরলাম সাম্প্রতিক অতীতও বাদ। নির্দিষ্ট করে যদি শুধু হারারে টেস্টের প্রসঙ্গে আসি। ম্যাচ হারার পর তামিমকে এমনভাবে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে যেন তামিম ভিটরিকে অর্ডিনারি বলেছেন বলেই বাংলাদেশ ম্যাচ হেরেছে! ক্রিকেটীয় কারণ অনুসন্ধান যতটা না হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে তামিমকে গালিগালাজ! এ কী দৈন্য আমাদের! তামিম ভিটরিকে ‘অর্ডিনারি’ বলেছিলেন চতুর্থ দিন শেষে। প্রথম ইনিংসে ভিটরির বলে আউট হয়েছিলেন, কিন্তু ওই দিন ভিটরির ২৭ বলে ৬ চারে করেছেন ৩২।

প্রথম ইনিংসে নতুন বলে ভীষণ বিপজ্জনক মনে হওয়া বোলারকে এদিন আক্রমণ থেকেই সরিয়ে দিয়েছিলেন। এখন এই বোলারকে তামিমের অর্ডিনারি মনে হতেই পারে! ৪৩ করেই হয়তো আউট হয়ে গেছেন, আউট হওয়ার ধরনটাও বাজে ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও সত্যি যে, চতুর্থ দিন শেষেও বাংলাদেশ জয়ের আশা করতে পারছিল তামিমের ঝোড়ো ইনিংসটার জন্যই। আর ‘অর্ডিনারি’ বোলারের বলে কি আউট হওয়া যাবে না? হাবিবুল বাশারের বলে বোল্ড হননি ব্রায়ান লারা! কিন্তু এতসব খুঁটিনাটি ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণে কে যাবে! একবার মওকামতো পাওয়া গেছে, ধরো এবার গলা চিপে! সবচেয়ে দুঃখজনক, জিম্বাবুয়ে যখন এই ইস্যুতে তাদের তরুণ বোলারের পাশে দাঁড়িয়েছে দারুণভাবে, আমরা তখন ওয়ানডে সিরিজের আগে আমাদের সেরা ব্যাটসম্যানকে চাপে ফেলার সব আয়োজন করে ফেলেছি। নিজেদের আমরা ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে পরিচয় দিই, দেশের ক্রিকেটের ভালো চাই।

কিন্তু আমরা তামিম-সাকিবদের ব্যর্থতার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। সুযোগ পাওয়া মাত্র পিষে ফেল! তার মানে এই নয় যে অন্যায় করলেও পিষে ফেলতে হবে। কিন্তু ভিটরি ইস্যুতে তামিমের দোষটা কোথায়! একটা যুক্তিই শুধু তামিমের বিপক্ষে আছে—সৌজন্যতাবোধ। তামিম বলেছেন, ‘আমার মনে হয়েছে ভিটরি অর্ডিনারি, মুখে অন্য রকম বলতে যাব কেন?’ কিন্তু স্রেফ সৌজন্যতার খাতিরে হয়তো ছাড় দিতে পারতেন মাত্রই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা একজনকে। তবে তামিম তো বলেছেনই, ভিটরির তরুণ নার্ভে একটু চাপ দিতে চেয়েছিলেন! গ্লেন ম্যাকগ্রা প্রতি সিরিজের আগে একজন করে ব্যাটসম্যানকে টার্গেট করতেন।

আমরা অপেক্ষা করতাম, এবার ম্যাকগ্রা কাকে টার্গেট করবেন। ড্যারিল কালিনানকে নিয়ে মাঠে আর মাঠের বাইরে শেন ওয়ার্নের ছেলেখেলা আমরা উপভোগ করতাম। প্রতি সিরিজের আগে স্টিভ ওয়াহর কথার লড়াই আমাদের কাছে মনে হতো শৌর্য। সিরিজের আগেই প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে ঘায়েল করে দেওয়া। আর আমাদের কেউ যখন এটা করতে গেল, আমাদের কাছে মনে হলো ঔদ্ধত্য, ‘ব্যাটা কথা বেশি বলে!’ প্রথম আলোর খেলার পাতায় তামিম বলেছিলেন, ‘মাইন্ড গেম খেলেছিলাম, তাতে হেরে গেছি।

’ অনলাইনে এই সংবাদের নিচে প্রায় শ-খানেক মন্তব্য ছাপা হয়েছে, যার বেশির ভাগই পড়ার অযোগ্য। কোনো ক্রিকেটীয় কথা নেই, একেকজন যেন ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটিয়েছেন। এতে কি আমাদের দৈন্য আর হীনতাই ফুটে ওঠে না! হিংসা আর পরশ্রীকাতরতা আমাদের রক্তে মিশে গেছে। আমরা বড় অদ্ভুত, জাতীয় নায়কদের চূড়ান্ত অসম্মান করতে পারলে আমরা বড় তৃপ্তি পাই। স্টিভ ওয়াহ-ম্যাকগ্রাদের প্রসঙ্গ আনায় অনেকে নিশ্চয়ই জিহবায় কামড় দিয়ে ফেলেছেন, ‘এঁদের সঙ্গে তামিমের তুলনা!’ সত্যটা হলো, অস্ট্রেলিয়ার জন্য স্টিভ বা ম্যাকগ্রা যেমন ছিলেন, একজন তামিম বাংলাদেশ দলের জন্য তার চেয়েও বেশি মূল্যবান।

তামিম প্রসঙ্গে অনেকে বীরেন্দর শেবাগকেও টেনে এনেছেন। ভুলে যাবেন না, শেবাগ ‘অর্ডিনারি’ বলেছিলেন বাংলাদেশকে। আর তামিম বলেছেন স্রেফ একজন ভিটরিকে। ব্রেন্ডন টেলর বলেছেন, তামিমের উচিত পারফরম্যান্স দিয়ে কথা বলা। সে ক্ষেত্রে, টেলরের জন্য পরামর্শ, ‘পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে মন্তব্য করুন।

’ আর আমরা? উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করব, ওয়ানডে সিরিজে তামিম-সাকিবের ব্যর্থতার জন্য! তাহলে আবারও মওকামতো পাওয়া যাবে ওঁদের। ছেলেবেলায় কেমন ছিলেন তাঁরা? বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের তারকাদের নিয়ে ধারাবাহিক মাত্র ১০ বছর বয়সেই বার্সেলোনার ফুটবল একাডেমিতে যোগ দেয় ছেলেটি। কিক নিতে শেখার পর থেকেই ফুটবলটা সে কেমন খেলত এ থেকেই অনুমান করা যায়। কিন্তু দুই মাস কাটতে না কাটতেই ‘লা মাসিয়া’ ছেড়ে যেতে হয় তাকে। কারণ তার পরিবার পাড়ি জমিয়েছিল স্পেনের জনবহুল দ্বীপ টেনেরিফে।

অবশ্য তিন বছর পরই সে ফিরে এসেছিল ‘লা মাসিয়া’য়। সেই ছেলে এখন বার্সেলোনার এক নম্বর গোলরক্ষক। বলুন তো কে? ভিক্টর ভালদেজ। (লেখাটি 'প্রথম আলো' থেকে নেয়া, লেখক আরিফুল ইসলাম লিঙ্ক )  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।