আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে মৃত শিশু আটকে রেখে অর্থ আদায়

১২৩ তোহুর আহমদ: মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টা। ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের চিকিৎসক এস এ আবেদীনের কক্ষে ৫-৬ জন মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। একজন বলছেন, ছি ডাক্তার আপনি আমার বাচ্চাটিকে এভাবে মেরে ফেললেন! বাচ্চা মারা গেছে দু’দিন আগে- তারপরও আমাদের জানালেন না। মরা বাচ্চাকে শুইয়ে রেখে আপনারা টাকা আদায় করছিলেন। ডাক্তারের কোন উত্তর নেই।

মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। ৮ দিন বয়সী একটি শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার মধ্যরাতে হৈচৈ শুরু হয় ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের ভেতরে। সেখানে গিয়ে জানা যায়, গত ২রা আগস্ট প্রসব বেদনা নিয়ে ভর্তি হন ফিরোজা বেগম। সেদিনই তার সিজার করা হয়। একটি ফুটফুটে ছেলে শিশুর জন্ম হয়।

সিজার করেন ইবনে সিনা হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক সাহিদা সুলতানা। সম্পূর্ণ সুস্থভাবে ভূমিষ্ঠ হয় শিশুটি। বিকালে ইবনে সিনা হাসপাতালের ইনচার্জ ড. এস এ আবেদীন শিশুটির পিতা ইদ্রিস শিকদারকে বলেন, আপনার বাচ্চার সামান্য শ্বাসকষ্ট আছে, তাকে এক দিন আমাদের বিশেষ কেয়ারে রাখেন। এক দিনেই এটা ঠিক হয়ে যাবে। স্বল্প শিক্ষিত ইদ্রিস বলেন, আপনারা যা ভাল মনে করেন তাই করেন।

মায়ের কাছ থেকে শিশুটিকে নিয়ে যান চিকিৎসক। পরদিন আবার চিকিৎসক ইদ্রিসকে বলেন, বাচ্চার সামান্য সমস্যা আছে। তাকে মেশিনে রাখতে হবে। প্রতিদিন মেশিনের চার্জ ১০ হাজার টাকা করে দেবেন। সন্তানকে সুস্থ করে তোলার জন্য এক কথায় রাজি হয়ে যান।

এরপর এই ওষুধ, সেই ওষুধ আনতে বলা হয়। সব কিছু ঠিক ঠিক এনে দেন পিতা। কিন্তু ৩ দিন পেরিয়ে গেলেও বাচ্চাকে মায়ের কাছে ফেরত দেন না চিকিৎসক। ইদ্রিস বলেন, যখন প্রথম দিন আমার বাচ্চাকে মেশিনে রাখতে হবে বলে একটা কাচের বাক্সে ঢোকানো হয়, তখন বাচ্চা স্বাভাবিকভাবে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছিল। এতে কাচের বাক্সের ভেতরের বিভিন্ন নল বারবার খুলে যাচ্ছিল।

এজন্য বাচ্চাকে শান্ত করতে ঘুমের ইনজেকশন দেন ডাক্তার। এরপর আর আমাকে বাচ্চা দেখতে দেয়নি ডাক্তাররা। দেখতে চাইলেই বলতো, বাচ্চা ভাল আছে, আজ-কালই রিলিজ দিবো। এভাবে দিন কাটতে থাকে। গত ৭ই আগস্ট আমি বাসায় ছিলাম।

হঠাৎ হাসপাতাল থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়। আমি হাসপাতালে গেলে রিসিপশন থেকে বলা হয়, আপনার কাছে হাসপাতালের যত পাওনা আছে সব আধা ঘণ্টার মধ্যে পরিশোধ করেন। এতে আমার সন্দেহ হয়। আমি বলি, আমার বাচ্চা আপনাদের কাছে আছে। আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি যে, এখনই টাকা দিতে হবে।

ওরা বলে, না সে কথা নয়। কর্তৃপক্ষ বলেছে, আপনাকে এখনই টাকা দিতে হবে। ইদ্রিস বলেন, যেহেতু আমার বাচ্চা ওদের কাছে ছিল, তাই ঝামেলা না করে সন্দেহ মনে চেপে রেখে আমি সব পাওনা পরিশোধ করে দিলাম। ভেতরে ভেতরে খোঁজ নিতে থাকলাম। দোতলায় গিয়ে ডা. আবেদীন ও ডা. বাবলি সুলতানাকে বললাম আমার বাচ্চা যদি খুব অসুস্থ হয়ে থাকে তো বলেন তাকে আমি অন্য কোন হাসপাতালে নিয়ে যাই।

এর মধ্যে ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে ভাল এক ডাক্তারের খোঁজ নিয়ে এলাম সেখানে আমার বাচ্চাকে ভর্তি করবো বলে। কিন্তু ডাক্তাররা আমাকে বাচ্চা নিয়ে যেতে দিলো না। রাতে এক ডাক্তার গোপনে আমাকে জানান, আমার বাচ্চা বেঁচে নেই। ইদ্রিস বলেন, আমার বাচ্চা মরে যাওয়ার পরও শুধু মেশিন ভাড়া আদায়ের জন্য তারা আমাকে কিছুই বলেনি। এমনকি যখন একজন ডাক্তার আমাকে বললেন, আপনার বাচ্চা মারা গেছে তখনও ডা. আবেদীন আমাকে বলেন আপনার বাচ্চা ভাল আছে।

কোন অসুবিধা নেই। যা ঘটেছে : মৃত শিশুটির স্বজনদের তীব্র রোষের মুখে গতকাল রাত ২টায় সব কিছু অকপটে স্বীকার করেন অভিযুক্ত ডা. এস এ আবেদীন। তিনি বলেন, বাচ্চাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসার পর আলাদা একটি বেডে রাখা হয়। পরদিন তাকে রাখা হয় ইনকিউবেটরে। মায়ের দুধ না দিয়ে তাকে বেবি ফুড দেয়া হয়।

কিন্তু বাচ্চা বেবি ফুড হজম করতে পারেনি। ফলে বাচ্চার বদহজম হয় এবং পেট ফুলে যায়। কিন্তু এটাকে আমরা তেমন গুরুত্ব দেইনি। আমরা ভেবেছিলাম একদিন না খাইয়ে রাখলে ঠিক হয়ে যাবে। এজন্য বাচ্চাকে একদিন খাবার না দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।

পরদিন হাসপাতাল থেকে ফোন করে আমাকে বলা হয় বাচ্চার পালস পাওয়া যাচ্ছে না, প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে স্যার আপনি আসেন। আমি এসে রক্তের দু’টি ভাগ, এফএফপি এবং পিসিভি আনার জন্য লিখে দিই। কিন্তু এখানে ঘটে আরেক বিপত্তি। শিশুটির বাবা ইদ্রিস বলেন, রক্ত লাগবে শুনে আমি রক্তের দাতা সংগ্রহ করি। তার কাছ থেকে রক্ত নেয় হাসপাতালের দু’জন নার্স।

তারা আমাকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে ধানমন্ডির ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে এ রক্তের টেস্ট করে নিয়ে আসুন। সে অনুযায়ী আমি রক্ত নিয়ে চলে যাই সেখানে। তারা রক্তের কি যেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাকে রক্ত ফিরিয়ে দিয়ে বলে সব হয়ে গেছে নিয়ে যান। এই রক্ত আনা নেয়া এবং পরীক্ষা করাতে প্রায় ৮ ঘণ্টা চলে যায়। রক্ত নিয়ে এলে হাসপাতালে নার্সরা তা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।

ডাক্তার নার্সদের বলেন, রক্ত ভাগ করা হয়নি। নার্সরা ফেরত এসে আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, কি করে নিয়ে এসেছেন। কিছুই হয়নি। আবার যান। এতক্ষণ নীরব বসে থাকা ডা. আবেদীন আবার মুখ খোলেন।

বলেন, এখানেই ভুল হয়ে গেছে। নার্সরা রক্ত ভাগের বিষয়টি তাদের না বোঝাতে পেরে এক ভুল করেছে। আবার ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রক্ত ভাগ করার প্রযুক্তি নেই, তারপরও তারা ক্রস ম্যাচিং করে রক্ত ফেরত দিয়েছে। এর মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে বাচ্চার। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে মেসিভ পালমোনারি হেমোরেজ হয়ে বাচ্চা মৃত্যুবরণ করেছে।

যা লিখে দিতে বাধ্য হলেন ডাক্তার: মৃত বাচ্চার স্বজনদের তীব্র রোষের মুখে অভিযুক্ত ডা. আবেদীন তার ব্যবহৃত প্যাডে লিখে দেন, আমাদের ইবনে সিনা হাসপাতাল থেকে রক্তের এফএফপি এবং পিসিভি আনতে বলা হয়েছিল। ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ দুটি করতে পারে না। এতদসত্ত্বেও তারা রক্তের ক্রস ম্যাচিং করেছে। যেটা বাচ্চাকে রক্তদানের ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। ফলে যথাসময়ে রক্ত পাওয়া যায়নি।

ইতিমধ্যে বাচ্চার রক্তক্ষরণ হয় এবং বাচ্চা মৃত্যুবরণ করে। এ ব্যাপারে ইবনে সিনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। মধ্যরাতে হাসপাতালে হৈচৈ: মৃত বাচ্চাটির ক্ষুব্ধ স্বজনদের শায়েস্তা করতে রাতেই বেশ ক’জন নিরাপত্তাকর্মীকে জড়ো করে হাসপাতালের সহকারী ম্যানেজার সুলতান মাহমুদ। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। হৈচৈ আর চিৎকারে হাসপাতালে থাকা অন্য রোগীর স্বজনরাও নিচে নেমে আসেন।

ঘটনা শুনে তারাও ডাক্তার ও হাসপাতালের কর্মচারীদের নানা প্রশ্ন করেন। পরে হাসপাতালের কর্মচারীরা গতকাল সন্ধ্যায় নেয়া ২০ হাজার টাকা ফেরত দেন। হতভাগ্য বাবা-মায়ের বক্তব্য: হতভাগ্য পিতা ইদ্রিস শিকদার তার অকালে মৃত বাচ্চাকে গতকাল সকালে নিজ হাতে কবর দিয়েছেন মোহাম্মদপুর কবরস্থানে। তিনি বলেন, ডাক্তারের অবহেলার কারণে আমার বাচ্চা মারা গেছে। কিন্তু আর কোন বাবা-মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়।

তাই আমি আইনের আশ্রয় নেবো। আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চাইবো। মা ফিরোজা বেগমের কান্নার রোল শোনা যাচ্ছিল মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিংয়ে তাদের বাসার অনেকটা দূর থেকেই। তিনি শুধু বললেন, যারা আমার বুক খালি করলো তাদের যেন আল্লাহ উপযুক্ত সাজা দেন। সুএ: Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.