“আগাছা ছাড়াই, আল বাধি, জমি চষি, মই দিই,/বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পর/দিন চোখ মেলে রাখি শুকনো আকাশের দিকে। ঘাম ঢালি/খেত ভ’রে, আসলে রক্ত ঢেলে দিই/নোনা পানি রুপে; অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হ’লে/খেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন/খরা, বৃষ্টি, ও একশো একটা উপদ্রব কেটে গেলে/প্রকৃতির কৃপা হ’লে একসময় মুখ দেখতে পাই থোকা থোকা সোনালি শস্যের..”(তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষীর প্রশ্ন- হুমায়ুন আজাদ)
এই বাজারি যুগে শুধু কৃষকের রক্ত-ঘাম ঢালা শ্রম আর প্রকৃতির কৃপা হলেই চলে না, বীজ কোম্পানির উপরও নির্ভর করতে হয় ফসলের সোনা মুখ দেখতে। গত বোরো মৌসুমে ভূমিহীন কৃষক আজগর আলি ৩ একর জমি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ২৫ হাজার টাকা ধার করে দেশী উফশী জাতের বীজের তুলনায় ৮/১০ গুণ বেশি দামের চীনা হাইব্রিড ঝলক ধানের চাষ করেছিলেন। কৃষি অধিদপ্তরের স্থানীয় মাঠকর্মীদের কথা শুনে এবং স্থানীয় কেবল টিভিতে আমদানী কারক কোম্পানি এগ্রো-জি’র (http://www.agro-g.com/news_details.php?nid=9) দেয়া বিজ্ঞাপন দেখে আজগর আলী আশা করেছিলেন দেশী জাতের চেয়ে বেশি ফলন ক্ষমতার এই হাইব্রিড ঝলক ধান(এগ্রো-জি ১) পাকলে চাষের খরচ, মহাজনের ঋণের সুদ-আসল দিয়ে থুয়ে অন্তত ১০০ মণ ধান তার লাভ হিসেবে থাকবে। প্রতিমণ ৮০০ টাকা করে হলে এভাবে ৮০ হাজার টাকা তার হাতে আসার কথা।
এটাই তার সারা বছরের খোরাকী জোটাবে। কারণ আজগর আলী যে অঞ্চলের মানুষ সেই নোয়াখালির বেশির ভাগ জমিই কয়েক যুগ ধরে জলাবদ্ধতার সমস্যাক্রান্ত হওয়ায় কেবল বোরো মৌসুমেই আবাদ যোগ্য। কিন্তু আজগর আলীর মতো এরকম অসংখ্য কৃষকের চাষ করা সাধের হাইব্রিড ঝলক ধান নষ্ট হয়ে গেছে, ধান পোক্ত হওয়ার আগেই শীষ শুকিয়ে গেছে। একদিকে মহাজনের কাছ চড়া সুদে নেয়া ঋণের বোঝা আর অন্যদিকে পরিবারের খোরাকি যোগারের অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন কাটছে তাদের।
নোয়াখালি অঞ্চলের ১ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে ঝলক ধান চাষ হয় যার মধ্যে ৪৬৫ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি এবং বাদবাকি জমির ফসলও অনেকাংশে নষ্ট হয়েগেছে।
শুধু নোয়াখালি নয়, এ বছর সারাদেশে সিলেট, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা ও কুমিল্লা অঞ্চলের যেখানেই ঝলক চাষ হয়েছে, প্রায় সর্বত্রই ফসল বিপর্যয় দেখা দেয়। হাইব্রিড ঝলক বীজের সমস্যার কারণে একযোগে সারাদেশে ফসল বিপর্যয় ঘটার ক্ষতিপূরণ দাবী করে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা আন্দোলন সংগ্রাম-মানব বন্ধন-সমাবেশ-স্মরকলিপি প্রদান-নষ্ট ধান পোড়ানো কর্মসূচী পালন করলেও সরকার ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের পাশে দাড়ায় নি, বীজ কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা তো দূরের কথা চীন থেকে আমদানীকৃত WINALL HIGHTECH COMPANY’ (http://winall.globalimporter.net/)র উতপাদিত এই হাইব্রিড বীজের সমস্যার কারণেই যে এই বিপর্যয়টি ঘটেছে সেটাই আড়াল করতে চাইছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান:
ঝলক ধান বিপর্যয়ের বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধান করবার জন্য আমরা কয়েকজন গত ২৯ জুলাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা নোয়াখালিতে যাই। স্থানীয় সাংবাদিক, এনজিও কর্মকতা, রাজনৈতিক কর্মী, কৃষিবিদ, কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকতা সহ নোয়াখালি সদর এবং বেগমগঞ্জ উপজেলার কৃষকদের সাথে এ বিষয়ে আমাদের কথা হয়। ভূমিহীন কৃষক আজগর আলী, মুক্তিযোদ্ধা কৃষক এনায়েত মেম্বার কিংবা তরুণ কৃষক শিমুলের সাথে সেখানেই পরিচয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় গঠিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি)এর তদন্ত দল কিংবা বীজ কোম্পানির পক্ষ থেকে এই ফসল বিপর্যয়ের জন্য বিরুপ আবহাওয়া /হঠাত নিম্ন তাপমাত্রার কারণে নেক ব্লাষ্ট রোগ হওয়ার কথা প্রচারের ব্যাপারটি তুললে তারা পরিস্কার যুক্তি দিয়ে বলেন, একই এলাকায় পাশাপাশি জমিতে দেশীয় বিআর জাতের ধান, আরেকটি হাইব্রিড হিরা ধানের সাথে ঝলকের চাষ হয়েছে, আবহাওয়া কিংবা তাপমাত্রার কারণে হলে তাহলে অন্য জাতের ধানের কোন ক্ষতি না হলেও কেবল ঝলক ধান-ই নষ্ট হলো কেন? আর শুধু নোয়াখালি না সারাদেশে যেখানেই ঝলক চাষ হয়েছে সেখানেই একই ঘটনা ঘটেছে। ফলে তারা এ বিষয়ে নি:সন্দেহ যে সমস্যাটি বীজে-ই ছিলো। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদের বক্তব্যও অনুরুপ। তিনি মনে করেন, বীজের মধ্যে রোগের উপাদন(নেক ব্লাস্ট ছত্রাক জনিত রোগ) বা অন্য কোন দুর্বলতা সুপ্ত অবস্থায় ছিলো বলেই নেক-ব্লাষ্ট ছড়ানোর অনুকুল আবহাওয়া পাওয়া মাত্রই সারা দেশেই ঝলক ধানে রোগটি ছড়িয়েছে কিন্তু অন্য জাতের ধানের ক্ষেত্রে তেমন ঘটেনি। ফলে বীজে সমস্যা নেই বলে পার পাওয়ার কোন উপায় কোম্পানির নেই।
হয়তো এ ধরণের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই এগ্রো জি বীজের প্যাকেটের গায়ে লিখে রেখেছে: ”সীমাবদ্ধতা- বিশ্বব্যাপি বীজ ব্যাবসার প্রতিষ্ঠিত নিয়মানুযায়ী অ-মৌসুমে বীজ বপন কিংবা প্রাকৃতিক বা কৃত্রিমভাবে তৈরী অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া, মাটির গঠন দুর্বলতায় কিংবা অন্য কোন অপ্রাকৃতিক ও অস্বাভাবিক অবস্থার কারণে বিক্রীত বীজের বর্ণিত গুনাগুন ও উতপাদনশীলতার তারতম্যের ক্ষেত্রে কোন নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব নয়। ”
আবহাওয়ার বিপর্যয়ের দায় বীজ কোম্পানির না নেয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু সেক্ষেত্রে নিশ্চিত ভাবেই প্রশ্ন আসে তাহলে ঐ বীজের জন্য আদর্শ বা সহনীয় আবহাওয়া টা আসলে কি? সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন কত তাপমাত্রায়, কতটুকু বৃষ্টিপাত বা জলাবদ্ধতায় এবং কি ধরণের মাটিতে বীজটি ভালো হবে, সেটা সুনির্দিষ্ট করে না বললে কোনটা অনুকুল আবহাওয়া আর কোনটা প্রতিকুল সেটা নির্ধারিত হবে কি ভাবে? ফলে এ ধরণের ফাপা দায়মুক্তি কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বীজের প্রতিশ্রুত মান নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষতিপূরণ
ঝলক বীজের চকচকে প্যাকেটের গায়ের জ্বলজ্বল করছে লোভনীয় কিছু প্রতিশ্রুতি:
সঠিক চাষে একর প্রতি ফলন ১২০ থেকে ১৩৫ মণ।
ধান মাঝারি চিকন ও লম্বা, ভাত ঝরঝরে ও সুস্বাদু।
গাছ হেলে পড়ে না, শীষে চিটা হয় না এবং ধান ঝরে পড়ে না।
কিন্তু বেশী ফলন তো দূরের কথা, কোন ফলনই বেশির ভাগ কৃষক পায়নি ঝলক থেকে। একর প্রতি ফলন শূন্য। শীষে চিটা হয়েছে, ধান ঝরে পড়েছে। ভাত সুস্বাদু কিনা বোঝা যায় নি কিন্তু খড় গরুও খেতে চায় নি! তাহলে প্রশ্ন হলো, বীজ আমদানী ও বাজারজাত করণের বেলায় বীজ নিবন্ধন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কি করেছে? জাতীয় বীজ নীতি’র আর্টিক্যাল ৯.৬ অনুসারে বীজের মান নিশ্চত করণের জন্য লেবেলে বর্ণিত মান এবং প্যাকেটে অথবা পাত্রেস্থিত বীজের মান সমান হতে হবে। আর্টিক্যাল ৮.২ অনুসারে, কোন বীজ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমদানির আগে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ফিল্ড টেস্ট করতে হয়।
ফিল্ড টেস্ট এ প্রতিশ্রুত মান ও গুণাগুন প্রমাণিত হলেই কেবল বীজ আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। এর পর প্রতিবছর আমদানীর বেলায় বীজ বিদেশ থেকে দেশে ঢুকার সময়ই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোরেন্টাইন সেন্টার এ রেখে পরীক্ষা নীরিক্ষা করা হয় যে এতে কোন রোগজীবাণু আছে কি-না। আর্টিক্যাল ১১.৪ অনুসারে বীজ অনুমোদন সংস্থার কাজ হলো, “পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে বিক্রোয়োত্তর পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণ করা”, “উতপাদনে দুর্বলতা দেখা গেলে, রোগ ও পোকামাকড়ের সন্দেহ থাকলে জাতীয় বীজ বোর্ডকে উক্ত জাতের অনুমোদন বাতিল করার উপদেশ প্রদান” যদিও বীজ নীতি/আইনের কোথাও বলা নেই লেবেলে উল্ল্যেখিত গুনাগুনের ব্যাতিক্রম ঘটলে আমদানী কারক বা উতপাদন কারী কোম্পানির কাছ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে কি-না!
বীজের মাননিয়ন্ত্রণের জন্য বীজ নীতিতে যতটুকুই আছে, ঝলক ধানের বেলায় কি সেগুলো অনুসরণ করা হয়েছে? চীনা কোম্পানি উইনঅল হাইটেক এর উতপাদিত এগ্রোজি-১ বা ঝলক ধান এনার্জি প্যাক এর এগ্রো জি কোম্পানি কর্তৃক দেশে আমদানী করার বেলায় কি এবার সে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে? তাহলে পরীক্ষায় কোন সমস্যা ধরা পড়ল না কেন? বীজ প্যাকেটজাত করার আগে বীজ কোম্পানি কি যথাযথ ভাবে বীজ ট্রিটমেন্ট করেছিল? বিক্রোয়োত্তর পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণ করা তো দুরের কথা বিক্রির সময় ডিলাররা কৃষকদেরকে যে বীজ বিক্রির রশীদ পর্যন্ত প্রদান করেনা, তা ঠেকানোর ব্যাবস্থা কি করা হয়েছে? লক্ষ একরের বেশী জমির ফসল নষ্ট হওয়ার পরও কোম্পানির বিরুদ্ধে কি কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে? আর্টিক্যাল ১১.৪ অনুসারে বীজ অনুমোদনের বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোজা জরুরী। কারণ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বেসরকারি কিংবা বিদেশী কোম্পানির বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছে কৃষকরা। হাইব্রিড ধান ঝলকের পাশাপাশি বহুজাতিক সিনজেন্টা উতপাদিত হাইব্রিড টমোটো সুবল চাষ করেও প্রতারিত হয়েছে রাজশাহীর গোদাবাড়ির কৃষকরা।
২০১০ সালের রবি মৌসুমে রাজশাহীর গোদাবাড়ি উপজেলার সাড়ে আট হাজার কৃষক ছয় হাজার হেক্টর জমিতে সুবল জাতের টমেটো বীজ চাষ করে কোন ফলন পাননি। দেশের বিএডিসি উতপাদিত বিভিন্ন জাতের উচ্চফলন শীল বা হাই ইয়েল্ডিং ভেরাইটির ক্ষেত্রে তো এরকম বিশাল আকারের বিপর্যয় ঘটতে দেখা যায় না, তাহলে কেন বারবার হাইব্রিড বীজের বেলায় এরকম ঘটছে? আগামী বছরেও যে ঝলক বা বিজলী কিংবা হিরা বা যে কোন হাইব্রিড বীজ কিনে প্রতারিত হবে না কৃষকরা তার নিশ্চয়তা কি? শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, কৃষকের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা কিংবা বীজ অনুমোদন বাতিলের প্রস্তাব তো দূরের কথা এ বছর এগ্রো-জি কোম্পানিকে ১৫ মেট্রিকটন ঝলক বীজ আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার!
হাইব্রিড বীজ ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্ন:
দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা এবং ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমির বাস্তবতায় বরাবরই সমাধান হিসেবে সরকারি-বেসরকারি-দেশী-বিদেশী সকল পর্যায় থেকে হাইব্রিড শস্য আবাদের প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়ে থাকে। এর পেছনে যুক্তি হলো প্রতি একক জমিতে হাইব্রিড বীজে দেশীয়/উফশী জাত থেকে বেশি ধান উতপাদিত হয়। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বেশী উতপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক সন্দেহ নাই কিন্তু এই বেশি উতপাদন কৃষকের জন্য বেশী ঝুকিপূর্ণ পরিস্থিতির তৈরী করে কিনা, কৃষকের জন্য তা লাভজনক কি-না, দীর্ঘ মেয়াদে তা জমি ও পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরী করে কি করে না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা না করে কেবল বেশি উতপাদন এর হিসেব কষাটা কিন্তু মোটেই নিরাপদ নয়। স্থানীয় জাতের ধানের বদলে উচ্চ ফলনশীল বা উফশী ধানের ব্যাবহারের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বেড়েছে না কমেছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
স্থানীয় জাতের ধানের ফলন কম হলেও সার-কীটনাশক-সেচ কম লাগত কিন্তু সবুজ বিপ্লবের সময় উচু মাত্রার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যাবহার কারী উফশী ধানের চাষে আপাতত ফলন বাড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে অতিরিক্ত সারের ব্যাবহারে জমির উর্বরতা হ্রুাস, কীটনাশক ব্যাবহারে উপকারী পরাগায়ী পতঙ্গ ধ্বংস ইত্যাদি কারণে দীর্ঘ মেয়াদে জমির ক্ষতি হচ্ছে ফলে খাদ্য নিরাপত্তা উল্টো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে মতামত রয়েছে। এখন এর মধ্যে উফশীর চেয়েও বেশি সার-কীটনাশক-বালাইনাশক ব্যাবহারকারী এবং বন্ধ্যা বীজের হাইব্রিড উফশীর চেয়ে বেশি ফলন দিলেও বীজ নিরাপত্তার নিরিখে কতটা গ্রহণযোগ্য সেই প্রশ্নটা মাথায় রাখা জরুরী।
হাইব্রিডের সুবিধা: হাইব্রিড বীজের সবচেয়ে বড় সুবিধার কথা বলা হয় প্রতি একক জমিতে এর ফলন অন্য যে কোন দেশী জাতের তুলনায় বেশি। হাইব্রিড বীজ বাজারজাত কারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের পৃষ্ঠপোষকতায় করা একটি গবেষণা (Hybrid Rice Adoption in Bangladesh:A Socioeconomic Assessment of
farmers’ Experiencesby AM Muazzam Husain,Mahabub Hossain,Aldas Janaiah) থেকে এ বেশী ফলনের পরিসংখ্যানটুকু চলুন দেখে নেই:
হেক্টর প্রতি ধান উতপাদনের তুলনা:
দেখা যাচ্ছে হাইব্রিড অলোকের তুলনায় উফশী জাতের ফলন বেশী এবং হাইব্রিড সোনার বাংলার ফলন উফশীর তুলনায় ১১% থেকে ১৮% বেশী! আরেকটি বিষয় হলো, ধান থেকে চাল উতপাদনের পরিমাণ সব ক্ষেত্রেই হাইব্রিডের তুলনায় বিআর ধানের বেশী। যেমন বিআর-৬ এর ধান/চাল অনুপাত হলো ৬৮.৭৫ কিন্তু অলোকের ধান/চাল অনুপাত ৬২.৭ এবং সোনার বাংলার ৬৫%।
এবার দেখা যাক এই বাড়তি ফলনটুকু পেতে গেলে কি কি ঝুকি কৃষকের উপর বর্তায়:
হাইব্রিড ঝুকি ১: হাইব্রিড বীজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এটি বন্ধ্যা বীজ অর্থাত উতপাদিত ধান কে পুনারায় বীজ হিসেবে ব্যাবহার করা যায়না, সেক্ষেত্রে এর হাইব্রিড ভিগর(হাইব্রিড তেজ) বা হেটারোসিস নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষককে বীজের জন্য বিদেশী/বেসরকারি কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হতে হয় যেসব কোম্পানি মূল লক্ষ্য মুনাফা সর্বোচ্চকরণ। ফলে এসব কোম্পানির বীজ মনোপলির গ্যারাকলে আটকে কৃষক ক্রমশ কেজি প্রতি বীজে বাড়তি দাম দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর একটা সমাধান হতে পারে বেদেশী/বেসরকারি কোম্পানির বদলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিএডিসি কর্তৃক হাইব্রিড বীজ উতপাদন ও স্বল্প মূল্যে বাজারজাত করণ। বীজ কে ক্রমশ কর্পোরেটাইজ করার বীজ নীতি প্রণয়ন কারী এবং বিএডিসি কে ক্রমশ অকার্যকর ও সারাদেশের মোট প্রয়োজনীয় বীজের খুব সামান্য অংশ সরবরাহ করা একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে যে শাসক শ্রেণী তাদের কে যদি এই কাজটি করতে বাধ্য করা যায়ও সেক্ষেত্রেও হাইব্রিডের বাদবাদি ঝুকি গুলো থেকেই যায়।
হাইব্রিড ঝুকি ২: উফশী জাতের তুলনায় হাইব্রিড জাতের ধান চাষের খরচ বেশি। বাড়তি খরচের একটি তুলনা নীচে দেয়া হলো:
ফলে হাইব্রিডে বাড়তি ধান উতপাদিত হয় ঠিকই কিন্তু তার জন্য খরচও করতে হয় বাড়তি। বাড়তি ধান উতপাদিত করে বাজারে বিক্রয় করলে যে লাভ কৃষকের থাকে তাতে কি বাড়তি বিনিয়োগের সাপেক্ষে যথেস্ট, দেশী উফশী ধানের সাথে একটা তুলনা করা যাক।
অর্থাত দেখা যাচ্ছে হাইব্রিড ধানের বেলায় বিনিয়োগের তুলনায় লাভের পরিমাণ উফশীর চেয়ে ১০% এর বেশী কম। যত দিন যেতে থাকবে জমিতে প্রযোজ্য সার, বীজের পরিমাণ/দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকলে দেশী জাতের তুলনায় হাইব্রিডের লাভজনকতা কমতে থাকবে।
হাইব্রিড ঝুকি ৩: রোগ বালাই প্রতিরোধের ক্ষমতা স্থানীয় জাতের তুলনায় উফশী জাতের কম। হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে তা আরো কম। ফলে ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে যে হাইব্রিড পুষ্ট ও সবল দানা প্রচুর পরিমাণে উতপাদিত হবে, সে হাইব্রিড ধানই আবহাওয়া, তাপমাত্রা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সহজে খাপ খাওয়াতে না পারায় সময় সময় ফলন বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণে হাইব্রিড ধানে সহজে কাতর হওয়ার পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে ব্র্যাকের করা গবেষণাটি থেকে:
ক) উফশী ধানের বেলায় যেখানে ৭৬% ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যাবহার করতে হয়েছে, হাইব্রিড অলোক ও সোনার বাংলা ধানের বেলায় তার হার যথাক্রমে ৯৪% ও ৮৮% ক্ষেত্রে।
খ) রোগবালাই ও পতঙ্গের আক্রমণে উফশী জাতের ক্ষেত্রে ফসলের ক্ষতিপরিমাণ ২০% এর নীচে থাকলেও হাইব্রিড জাতের ফসল একবার আক্রান্ত হলে ফসলের ক্ষতির পরিমাণ গড়ে মোট ফসলের ৩০% এর বেশি দেখা গিয়েছে।
গ) উফশী জাতের তুলনায় হাইব্রিডের জন্য কীটনাশক ব্যাবহারের খরচ ৬৭% বেশী।
কোম্পানি বান্ধব রাষ্ট্র ও কৃষকের ক্ষতিপূরণের লড়াই
সকল দিক বিবেচনা করলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সাথে কৃষকের বীজ নিরাপত্তা ও বীজের অধিকারের প্রশ্নটি ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। অথচ কোম্পানি বান্ধব রাষ্ট্রের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। আমরা থাকা অবস্থাতেই নোয়াখালির মাইজদিতে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পৃষ্ঠপোষকতায় এক বীজ মেলা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে অবাধে এগ্রোজি, এসিআই কিংবা ব্র্যাকের মতো হাইব্রিড বীজ আমদানিকারক ও উতপাদনকারক কোম্পানি গুলোর বীজের বিক্রয় ও প্রদর্শনী চলছে। অবশ্য এরকমটাই তো হওয়ার কথা।
দেশী-বিদেশী কোম্পানি বান্ধব রাষ্ট্রের বীজ নীতিতে এরকমটাই বলা আছে:
# বিশেষ করে বেসরকারি বীজ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে আমদানির সুযোগ প্রদান করে উন্নতমানের বীজ ও রোপন সামগ্রী সংগ্রহ ও প্রবর্তন করা হবে। ( আর্টিক্যাল ৩.৩)
# যে সকল বীজ বেসরকারি খাতে উতপাদিত হচ্ছে সেগুলোর উতপাদন থেকে বিএডিসি ধীরে ধীরে সরে আসবে(আর্টিক্যাল ১১.২.২ এর খ)
# উপজেলা পর্যায়ে বিএডিসি’র বীজ বিক্রয়কেন্দ্রগুলো ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে বেসরকারি বীজ ডিলারগণকে সেস্থলে নিয়োজিত করা হবে। (আর্টিক্যাল ১১.২.৫)
আর এভাবে বেসরকারি খাতের পাল্লায় পড়ে ঝলক ধানের মতো ফসল বিপর্যয়ে কৃষক সর্বস্ব হারালেও তার ক্ষতিপূরণের কোন দায় রাষ্ট্র কিংবা বীজকোম্পানি কারো উপরে বর্তাবে না!
অবশ্য কৃষকরা বীজ নীতি/বীজ আইনে ক্ষতিপূরণের কোন ধারা না থাকলেও লড়াই করে ক্ষতিপূরণ আদায় করার ব্যাপারে আশাবাদি। তারা মনে করেন স্রেফ ভালো ফলনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে প্রতারণা বীজ কোম্পানি তাদের সাথে করেছে, সেই প্রতারণার অভিযোগেই বীজ কোম্পানির শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ আদায় সম্ভব। তারা বলেছেন মানব বন্ধন-সমাবেশ-স্মরকলিপি প্রদান অনেক হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঝখানে আন্দোলনে একটু ভাটা পড়লেও স্থানীয় ক্ষেতমজুর সমিতি ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের সাথে তারা কথা বলছেন সামনের আন্দোলণের ব্যাপারে। এবার “রাস্তার পাশে খাড়াই রোইদ পোয়ানো”র মানবন্ধন জাতীয় কর্মসূচীর মধ্যে তারা আর নাই, একেবারে রাস্তা অবরোধ করে রেখে ক্ষতিপূরণ আদায়ের কর্মসূচী নিতে চান তারা। আমরা কৃষকের এই ক্ষতিপূরণ আদায় ও বীজ নিরাপত্তার আন্দোলনের সাথে সংহতি জানাই।
আমাদের মতো দোকান থেকে সরু চাল কিনে খাওয়া মধ্যবিত্তের পক্ষে কৃষকের কাতারে দাড়িয়ে একমুঠো পুষ্ট বীজ, এক গন্ডা জমির সোনালি ধানের গুরুত্ব বোঝা একটু মুশকিল। কিন্তু সেইটা বোঝার চেষ্টা করা এবং বীজনিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের লড়াইয়ে কৃষকের পাশে দাড়ানোটা ভীষণ জরুরী, এবারের হাইব্রিড ঝলকের বিপর্যয়ে কয়েক হাজার টন ধান কম উতপাদনের ঘটনা সেই বার্তাই জানিয়ে যাচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।