ঢাকা: ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে প্রেসক্রিপশনে রোগীদের ওইসব কোম্পানির ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা-এ অভিযোগ বহুদিনের। অনৈতিকভাবে নিজেদের ওষুধ বাজারজাতকরণে ডাক্তারদের ম্যানেজ করতে হাসপাতালগুলোতে অনেক সময় রোগীর চেয়ে বেশি দেখা যায় ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের। উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানিগুলো।
তবে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে হাতে এসেছে কোম্পানি থেকে চিকিৎসকদের ঘুষ নেওয়ার দলিল। সেসব দলিলে উল্লেখ রয়েছে, কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের কোন মেডিকেল প্রোমোশোনাল অফিসারের মাধ্যমে কতো টাকা মাসোহারা দিচ্ছেন।
চিকিৎসকদের যে তালিকা বাংলানিউজের হাতে এসেছে, সেখানে রয়েছে দেশের বাঘা বাঘা চিকিৎসক ও নামিদামি ওষুধ কোম্পানির নামও।
ওষুধ কোম্পানি থেকে ঘুষ নেওয়া চিকিৎসকের তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল সোসাইটি (বিএমডিসি) ও ‘অপথোলমলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ’- এর নিবন্ধিত অনেক ডাক্তার। যাদের অনেকেই সংগঠনটির আজীবন সদস্য।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. দীপক কুমার নাগ দেশের একজন প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক। তথ্যানুযায়ী একটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি শিহাব উদ্দিনের মাধ্যমে দু’হাজার টাকা পান তিনি।
ঢাকার বিএনএসবি’র একাধিক চিকিৎসক রয়েছেন এ তালিকায়। এদের মধ্যে ওই কোম্পানির আনসার আলীর মাধ্যমে ডা. মাহফুজুর রহমান ও সহকারী সার্জন ডা. সাইফুল ইসলাম পেয়েছেন এক হাজার টাকা।
বাদল আই হসপিটালের চিফ কনসালট্যান্ট ডা. মিজানুর রহমানের কাছে দু’হাজার টাকা এবং ডা. মোবারক হোসেন খানের কাছে এক হাজার টাকা পৌঁছে দিয়েছেন ওই একই বিক্রয় প্রতিনিধি।
চক্ষু চিকিৎসায় বেশ নাম রয়েছে লায়ন চক্ষু হাসপাতালের। এই হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রিঙ্কু পালকের কাছেও আনসার আলীর মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয় দু’হাজার টাকা করে।
তথ্য প্রমাণে পাওয়া, দু’হাজার টাকা মাসোহারা নেওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে আরও রয়েছেন, মির্জাপুর টাঙ্গাইলের কুমুদিনী হাসপাতালের ডা. সঞ্জয় কুমার, টাঙ্গাইলের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. নজরুল ইসলাম, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অপথালমলোজির মেডিকেল অফিসার ডা. এস এম রহমান, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. মো. বাহাউদ্দিন মোল্লা ও টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’-এর ডা. আইয়ুব আলী।
এসব ডাক্তারদের সবার কাছেই বিক্রয় কর্মকর্তা আনসার আলী পৌঁছে দিয়েছেন দু’হাজার করে টাকা।
তৎকালীন সময়ে গাজীপুর কালিগঞ্জের জামিল আই হসপিটালের পরিচালক ও কনসালট্যান্ট ডা. রতন কুমার সেনের কাছে দুই হাজার টাকা পৌঁছে দিয়েছেন একটি কোম্পানির শিহাব উদ্দিন।
বারডেম হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার (চক্ষু) ডা. সুজিত কুমার সরকারও নিয়েছেন দু’হাজার টাকা। পৌঁছে দিয়েছেন শিহাব উদ্দিন।
নরসিংদীর লায়নস প্রোগ্রেসিভ আই হসপিটালের ডা. রিপন এবং ডা. ডলারকে দেওয়া হয় দেড় হাজার টাকা করে।
ময়মনসিংহ বিএনএসবি’র ডা. নাসিম পারভেজকে এক হাজার এবং ডা. কে ডি চক্রবর্তী ও মেডিকেল অফিসার ডা. কাজিমুল হককেও দেওয়া হতো দেড় হাজার করে টাকা।
অনুসন্ধানে পাওয়া তালিকায় আরও যাদের নাম নিয়মিত অর্থ নেওয়ার উল্লেখ রয়েছে তারা হচ্ছেন- ফ্যাশন আই হসপিটালের মেডিকেল অফিসার ডা. মুক্তাদির রহমান ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের হনুফা মেমোরিয়াল হসপিটালের ডা. এম এ জলিল।
টাঙ্গাইলের চিকিৎসক মো. নজরুল ইসলাম অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এ ধরনের অর্থ নেওয়া খুবই অন্যায়।
তবে তালিকায় নিজের নাম শুনে বলেন, ‘মিথ্যা কথা’। এরপর কেটে দেন ফোন। অন্য চিকিৎসকদের মধ্যে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে তারা কেউই অর্থ নেওয়ার কথা স্বীকার করেননি অথবা প্রশ্ন শুনেই ফোন রেখে দেন।
বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বেরিয়ে আসা আরও চার জনের হলেন-ইব্রাহিম জেনারেল হাসাপাতালের সুপারিন্ডেন্ট ও সাবেক সিভিল সার্জন ডা. আব্দুর রশিদ, রামপুরার স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের ডা. জাহানারা, জুরাইন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের ডা. রহমত উল্লাহ এবং সাভারের ইব্রাহিম জেনারেল হাসাপাতালের ডা. মাসুদুর রহমান।
এ চারজনের মধ্যে শুধু মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়।
তিনিও যথারীতি অস্বীকার করেছেন এ অভিযোগ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগতত্ত্ব) বেনজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এটি সম্পূর্ণ অবৈধ ও অনৈতিক। চিকিৎসকদের এ ধরনের উৎকোচ গ্রহণের প্রভাব পড়ে পেসক্রিপশনে। অর্থ গ্রহণ করায় কোম্পানির ওধুষ গ্রহণের পরামর্শ দেন রোগীকে। এর ফলে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত ওষুধ দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, সামান্য টাকার জন্য যারা এ মহান পেশাকে কলুষিত করবে, তাদের এ পেশা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
চিকিৎসকদের এ ধরনের অর্থ গ্রহণের অভিযোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএমএ সাধারণ সম্পাদক ও বিএমডিসি কার্যকরী পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পেলে চিকিৎসকদের বিএমডিসি থেকে নিবন্ধন বাতিল করা হবে।
সম্প্রতি আরও কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসায় তাদের বিএমডিসি’র নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বি.দ্র. বাংলানিউজের হাতে আসা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি থেকে উৎকোচ নেওয়া চিকিৎসকদের তালিকার এটি প্রথম পর্ব।
ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের ঘুষ নেওয়া আরও চিকিৎসকদের বাকি নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
আপনি বা আপনার চারপাশে চিকিৎসা সেবা পেতে হয়রানির শিকার হওয়ার কোনো অভিযোগ থাকলে জানাতে পারেন এই ঠিকানায়। অথবা ফোন করুন ০১৬৭৪১৭৪০৭০ এই নাম্বারে।
http://www.banglanews24.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।