আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরণোত্তর অঙ্গ দান।

জীবনকে ভালোবাসি, তার চেয়েও বেশী ভালোবাসি মেয়েকে। প্রথমে তিনটি ঘটনা শেয়ার করি। ঘটনা ১ – একটি ২৪/২৫ বছর বয়সের ছেলে, পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা সুবিধার না, এই আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ছেলেটিকে তার মা ও আত্বীয়স্বজন মিলে ধার কর্য করে বিদেশে পাঠান। কয়েকবছর ছেলেটি পরিবারের অবস্থা উন্নয়নে জানপ্রাণ কষ্ট করে। অনেকগুলো ভাইবোনের সংসারে তার সে চেষ্টা কিছুটা হলেও সফলতার মুখ দেখে।

সে যেখানে থাকে সেখানে পানি খুব অপ্রতুল হওয়াতে পানি কম খেত এর ফলে একসময় তার জন্ডিস দেখা যায়। মালিকপক্ষ তার সামান্য কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে, কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়না। পরবর্তীতে কাজে আগের মতো দক্ষতা দেখাতে না পারায় তাকে ঐ বিদেশী কোম্পানি থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। দেশে তার পরিবার তার পরবর্তী চিকিৎসা করতে গেলে তখন ধরা পড়ে যে জন্ডিস এর চিকিৎসা ভালমতো হয়নি তার ফলে তার কিডনি স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। তার রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা ছিল ২৫।

এই ছেলেটির সাথে আমাদের দেখা হয় বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাকে তখন ইমারজেন্সি বেসিসে হাসপাতালে ভর্তি করে নেয়া হয়। তখন তাকে প্রায় ১০/১৫ দিনের মতো হাসপাতালে থাকতে হয়। বাংলাদেশে কিডনি রোগীদের চিকিৎসা যেরকম ব্যায়বহুল তাতে তার পরিবারের জন্য ঐ ১০/১৫দিন হাসপাতালে থেকে যাবতীয় চিকিৎসার ব্যায়ভার বহন করা কতটা কষ্টসাধ্য ছিল তা ওর মায়ের বিভিন্ন সময়ে ওদের এলাকার অর্থ ও প্রভাবপ্রতিপত্তি সম্পন্ন লোকজনকে ফোন করে আর্থিক সাহায্য চাইতে দেখে বুঝতে পেরেছি। প্রাথমিক বিপদটা কাটিয়ে উঠার পর ওরা খুব দ্রুত হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছিল কারন বাড়তি একটি দিন কাটানো ওদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল।

ঘটনা ২ – এই ছেলেটির বয়স খুব বেশী হলে ১৫/১৮ বছর হবে। ওর ব্যাপারে এতো বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়নি। কারন সেলিমের ডায়ালাইসিস পিরিয়ড যখন প্রায় শেষের দিকে তখন এই ছেলেটি বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলো। ছেলেটির বাবা পেশায় কৃষক। কিভাবে তার কিডনি সমস্যা ধরা পড়ে সেটা বিস্তারিত জানা হয়নি।

তবে প্রথম যেদিন ওর ব্যাপারে জানি সেদিন ডায়ালাইসিস ইউনিটের ডক্টর ও নার্সদের কাছ থেকে জানতে পারি ছেলেটি ডায়ালাইসিসের জন্য যে ক্যাথেডার করা লাগে সেটা করাতে রাজী হচ্ছেনা ভয় পাচ্ছে বলে। ক্যাথেডার করানোটা একটু কষ্টদায়ক ও বটে। একটি রাবারের নল গলা বা পা বা তলপেটের কাছে একটি ধমনি ও শিরার সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয় যার মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের করে ডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে রক্ত পরিশোধিত করে আবার তা শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। বাচ্চা একটা ছেলে এই প্রসেসটাতে যেতেই ভয় পাচ্ছিলো। ডক্টর ও নার্সদের অনেক বোঝানোর পর সে ক্যাথেডার করাতে রাজী হয়।

ডায়ালাইসিসের সময় একধরণের ব্লাড লাইন ব্যাবহার করা হয় যার মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত টেনে মেশিনের মাধ্যমে পরিশোধন করা হয়। প্রথম প্রথম যাদের ডায়ালাইসিস করা হয় তাদের ক্ষেত্রে এই ব্লাড লাইন একবার ব্যবহার করা ভালো। ছেলেটির দরিদ্র কৃষক বাবা জানিনা সে কত টাকা নিয়ে ঢাকা শহরে ছেলের চিকিৎসা করাতে এসেছিলো। ছেলেটির ২য় দিন ডায়ালাইসিসের সময় সেলিমের ও ডায়ালাইসিসের ডেট ছিল। ঐ দিন ছেলেটিকে যখন ডায়ালাইসিসের জন্য আনা হল তখন নার্স ব্লাড লাইনের খোঁজ করতে লাগলো।

ছেলেটির বাবা বলল ঐ দিনতো কিনে আনলাম। নার্স তখন বলল ঐ দিনেরটাতো ঐ দিন ব্যাবহার করা হয়েছে আজকে নতুন লাগবে। অল্পশিক্ষিত দরিদ্র কৃষক বাবা তখন নার্সকে অনুরোধ করে বলে ওইটা আরেকবার ব্যাবহার করা যায়না? একটা ব্লাডলাইনের দাম ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা। এতো অল্প বয়সের একটা ছেলে যেখানে ডায়ালাইসিসের খরচ ঠিকমত জোগাড় করা ওর পরিবারের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে সেখানে কতদিন ওর পরিবার এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালাতে পারবে ওরা আর ওদের আল্লাহই জানেন। ঘটনা ৩ – এই ছেলেটির বয়স আনুমানিক ২৫/২৬ বছর, ওর নাম মারুফ।

নার্স মারফত জানতে পারি যে মারুফ গত ২ বছর ধরে ওখানে ডায়ালাইসিসের জন্য আসে। আমরা খুব অবাক হই এই ভেবে যে ডক্টররা যেখানে আমাদেরকে সেলিমের চিকিৎসার শুরুর দিকেই কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা চিন্তা করতে বলেন সেখানে এই ছেলেটিকে কেন বলেননি বা বললেও এই ছেলেটি কেন তা করাচ্ছেনা। এই ছেলের টাকাপয়সাজনিত কোন সমস্যা ছিলোনা। পরে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে একদিন আমি ওর সাথে কথা বলি, তখন জানতে পারি যে ও কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা ভেবেছে কিন্তু ওকে কিডনি দেয়ার মতো কেউ নেই। ওর ছোট এক বোন ও এক ভাই আছে।

বোনের বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। ভাই অনেক ছোট ও ভাইয়ের রক্তের গ্রুপ মারুফের রক্তের গ্রুপ এক না। আর বাংলাদেশ সরকারের আঈন মোতাবেক যে নয়টি ক্যাটাগরির কিডনি দাতাদের কাছ থেকে সে কিডনি নিতে পারবে তার মধ্যে কেউ নেই ওকে কিডনি দেয়ার মতো। গতকাল সেলিমকে নিয়ে ডঃ এর কাছে গিয়েছিলাম রেগুলার চেকাপের জন্য। পপুলার হাসপাতালের প্রফেসর ডঃ নিজামুদ্দিন চৌধুরী নেফ্রলজিস্ট এখন ওর কিডনি ভালো রাখার জন্য যা কিছু করা দরকার সেই অনুযায়ী সব করছেন এবং আমাদের দিয়ে করাচ্ছেন।

ওনার কাছে শুনলাম পপুলার হাসপাতালে তিনজন ক্লায়েন্ট পুরোপুরি রেডি হয়ে গিয়েছিলো ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশনের জন্য। অপারেশনের আগে কিডনি দানকারীর রেনোগ্রাম করে দেখা হয় যে তার কোন কিডনিটা বেশী কর্মক্ষম। কর্মক্ষম কিডনিকে বাদ দিয়ে অন্য কিডনিটি প্রতিস্থাপন করা হয় কিডনি গ্রহণকারীর শরীরে। ঐ পরীক্ষায় দেখা যায় যে ডোনারের একটি কিডনি কর্মক্ষম এবং অন্যটির আকার কিছুটা ছোট ও তেমন কর্মক্ষম নয়। পরে শেষ মুহূর্তে বাধ্য হয়ে ডক্টররা ঐ ক্লায়েন্টের ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশনের চিন্তা বাদ দেন।

এভাবে অন্য দুজন ক্লায়েন্টের ক্ষেত্রেও কোন একটা সমস্যা দেখা যাওয়াতে তাদের অপারেশান শেষ পর্যন্ত করা যায়নি। এখন প্রশ্ন হল আর্থিকভাবে অক্ষম বা সক্ষম এই মানুষগুলো কি করবে? অপারেশান করার যাদের সামর্থ নেই তাদের ও তাদের পরিবারের বসে বসে পরিবারের প্রিয় একজন সদস্যের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আর যারা সক্ষম তাদের এই আঈনের মারপ্যাঁচে পড়ে রক্তসম্পর্কের বাইরের কারো কাছ থেকে কিডনি না নিতে পেরে এদেরও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিই বা করার আছে। এই অসহায় মানুষগুলোর কথা ভাবতে গিয়েই আমার মনে হয়েছে আমাদের দেশে মরণোত্তর অঙ্গ দানের প্রচলন যদি থাকতো তাতে এই লোকগুলোর জন্য কিছুদিন বেশী বেঁচে থাকার সম্ভাবনা হয়তো থাকতো। বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তিদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার৷ কেননা, মৃত্যুর আগে কেউ তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের অঙ্গীকার করলেও মারা যাওয়ার পর তাঁর স্বজনরা এ ব্যাপারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আগ্রহী হননা৷ এ ছাড়া এই ব্যাপারটি নিয়ে তেমন মাথাও ঘামানো হয়না৷ তাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সুস্থ লিভার বা কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না৷ পাশাপাশি আমরা বাঙ্গালীরা খুব আবেগপ্রবণ একটা জাতী।

আমাদের বা আমাদের পরিবারের কারো মৃত্যুর পর তার শরীর নিয়ে কাটাকাটি করা হবে এই চিন্তাটাই মনে হয় আমাদের মধ্যে বেশী কাজ করে। কিন্তু মৃত মানুষটির একটি অঙ্গ ব্যাবহার করে আরেকটি মানুষ ও তার পরিবার হাসিমুখে বেঁচে থাকতে পারে এই চিন্তাটা আমাদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলেনা। মৃত মানুষটির শরীর হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই গলে মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু মরার পরে ঐ মানুষটি যদি অন্যের উপকারে আসে তাহলে তার মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যদের বাইরেও অন্য মানুষগুলো তার জন্য দোয়া করে যাবে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী অঙ্গদানের ব্যাপারে কোথাও পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তা অনুমোদনযোগ্য৷ এই নীতি সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই, তারা এ ব্যাপারেও দ্বিধায় পড়েন ।

ইসলাম ধর্মতত্ত্বের প্রফেসর সাইম ইয়েপ্রেমের ভাষায়, ‘‘সমাজ যদি মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে, বুদ্ধিদীপ্ত ধর্মবিদ ও শিক্ষাবিদরা মানুষের চোখ খুলতে পারেন, তাহলে অঙ্গদানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে৷'' সৌদি আরবে কিন্তু অঙ্গদান বেশ প্রচলিত , বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও-র তথ্য অনুযায়ী গত কয়েক বছরে দেশটিতে অঙ্গদান ও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷ বহু মানুষের জীবনও রক্ষা পাচ্ছে এতে। উন্নত দেশগুলোতে অঙ্গদান গর্বের বিষয় হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশে এ ব্যাপারটি এখনো প্রায় অজানা। তবু কিছু ব্যক্তি ইতিমধ্যে তাদের শরীর বাংলাদেশের নানা সংস্থা ও হাসপাতালকে দান করে গেছেন, যা হস্তান্তর করা হয়েছে তার মৃত্যুর পর। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে।

তবে এখানে শুধু চক্ষু দান ও প্রতিস্থাপন নিয়ে কাজ করা হয়। এক্ষেত্রে আমাদের সরকারকে ও শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমার মনে হয় সরকারের পক্ষ থেকে বা সাধারণ শিক্ষিত মানুষজন এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রচার প্রচারণা চালালে কিছু অসহায় মানুষ অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে। ওপরের ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে আবারো উপলব্ধি করলাম আল্লাহ আমাদের কত বড় ভাগ্য দিয়ে পাঠিয়েছেন দুনিয়ায়। এমন জীবন মরণ সমস্যায় আমাদের পড়তে হয়েছিলো আমাদের যে তখন আমার সবচেয়ে বড় সহায় আমার জীবনসঙ্গীকে আমি হারিয়ে ফেলি কিনা এই আশঙ্কায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে।

সেই অবস্থা থেকে পরম করুণাময় আমাদেরকে উদ্ধার করেছেন। তাঁর দরবারে হাজার কোটি শুকরিয়া জানাই। আর অনেকে সেলিমের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি সেলিম এখন ভালো আছে, নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে। অপারেশানের তিন মাস পার হয়েছে আল্লাহর রহমতে কোন সমস্যা ছাড়াই, সামনের আরও ৩টা মাস আমাদেরকে সাবধানে থাকতে হবে। দোয়া করবেন সবাই আমাদের জন্য।

*** পোস্টের প্রয়োজনে ডাক্তারি শাস্ত্রের অনেক বিষয় উল্লেখ করতে হয়েছে, সব পয়েন্ট নির্ভুল ভাবে তুলে ধরতে পেরেছি কিনা জানিনা। কোন ভুল থাকলে ডক্টর ব্লগারগণ ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বা ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.