অনেক কিছু করে ফেলার শখ, কিন্তু কোন বিষয়ে নিজের প্রতিভা আছে বা আদৌ কোন বিষয়ে প্রতিভাবান কিনা, সেটাই বের করতে পারি নি এখনো। ইদানিং রাতে ভালো ঘুম হয় না। ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুম ছুটে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা লাগে। পানি খেয়ে শুয়ে পড়লেও আর ঘুম আসে না।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি কোন লাভ হয় না। আজকেও ঘুম ভেঙে গেল। হাতের কাছে পানি নেই। ডাইনিং রুমে গিয়ে পানি খেলাম। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে।
রাত বাজে ১টা ১০। রাত এখনো অনেক বাকি। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আমার রুমের বারান্দা দিয়ে বাসার সামনের রাস্তাটা দেখা যায়। আকাশে থালার মত চাঁদ উঠেছে।
জ্যোৎস্নার চাদর গায়ে দিয়ে রাস্তাটা শুয়ে আছে। রাস্তায় কেউ নেই। সেও মনে হয় ঘুমাচ্ছে। আজ সারারাতেও আর ঘুম আসবে না। রাস্তায় কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসলে কেমন হয়?
রাস্তায় আনমনে হাঁটছি।
নির্দিষ্ট কিছুই চিন্তা করছি না, আবার ছাড়া ছাড়া ভাবে অনেক কিছুই ভাবছি। সামনে এগুতেই হলুদ পাঞ্জাবি পরা এক যুবকের সাথে দেখা হয়ে গেল।
- আরে, হিমু ভাই! আপনি এখানে?
- আমি তো নির্দিষ্ট কোথাও থাকি না। এখানে থাকলে অসুবিধা কি?
- না, এমন পূর্ণিমা রাতে তো আপনার রাস্তায় থাকার কথা না। বনে গিয়ে জ্যোৎস্না গায়ে মাখার কথা।
- বাদলকে পাঠানো হয়েছে শালবনে। গর্ত খোঁড়া শেষ হলেই খবর পাঠাবে। তার আগে কিছু কাজ করতে হবে। আজকে বিশেষ একটা দিন। বিশেষ দিনে বিশেষ কিছু কাজ।
- চা খাবেন হিমু ভাই? আমাদের এখানে একটা চায়ের দোকান সারারাত খোলা থাকে।
- চা পরে খাবো। তার আগে এক জায়গায় যেতে হবে।
- আমিও আসি সাথে?
হিমু কোন জবাব দিল না। আমি তার সাথে সাথে চললাম।
- একটা প্রশ্ন করি হিমুভাই। আপনাকে যদি যেকোনো একটা অসম্ভব কাজকে সম্ভব করার ক্ষমতা দেয়া হত তাহলে কোন কাজটা করতেন?
- মারিয়া মেয়েটার নীলপদ্মগুলা ফেরত দিয়ে আসতাম। মায়া জিনিসটা অনেক ভারি। মায়া নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি ক্লান্ত।
আমরা এখন হাসপাতালের একটা রুমে।
রুমটা অন্ধকার। মিসির আলি সাহেব ঘর অন্ধকার করে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। কোন জায়গায় অভ্যস্ত হওয়ার সহজ উপায় হল একবার ভালমত দেখে নিয়ে তারপর অন্ধকারে চলাচল করার চেষ্টা করা। মনে হচ্ছে মিসির আলি সাহেবকে অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে, সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছেন।
- বুঝলে হিমু, আলসারের সমস্যাটা বেড়েছে।
মাঝে মাঝে এত ব্যাথা উঠে। চোখেও আগের মত দেখি না। বেলা বোধহয় ফুরিয়ে এল।
- বেলা ফুরিয়ে এলে সমস্যা কি? আপনার তো পৃথিবীতে তেমন কোন মায়া নেই। সংসারও তো করলেন না।
- পৃথিবীটাই বড় মায়া বুঝলে। যাহোক, আমি কিন্তু জানতাম তুমি আজকে আসবে। আমার ইএসপি ভালো না। তারপরও জানতাম। বিশেষ দিনে বিশেষ মানুষরা আসে।
হাসপাতালে সিগারেট খাওয়ার নিয়ম নেই। তারপরও হিমু একটা সিগারেট ধরিয়েছে। পৃথিবীর সব নিয়মই রাত বারটার পর শিথিল হয়ে যায়। পুরো রুমে আলোর উৎস শুধু সিগারেটের লাল আলো। হিমুর হাতের নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে অন্ধকার ক্যানভাসের উপর দাগ টেনে চলেছে।
- আপনার কি আজকে বিশেষ কিছু চিন্তা করার প্ল্যান আছে। না থাকলে চলেন এক জায়গায় যাই।
রাস্তায় এখন আমরা তিনজন। একেক করে সঙ্গী বাড়ছে। মনে হচ্ছে আরো পাওয়া যাবে।
আজকে সঙ্গী দিবস। আমার অনুমান ভুল না। একটু এগোতেই এক বিশাল বাড়ির গেটের সামনে একজনকে হেলেদুলে হাঁটতে দেখা গেল। নিষ্পাপ চেহারা। চশমা ব্যবহার করে অভ্যস্ত মনে হচ্ছে।
নাকের উপর চশমার ফ্রেমের দাগ পড়ে গেছে। চোখ দুটো এখন দেখাচ্ছে ইঁদুরের মত।
- আরে হিমু ভাই, কেমন আছেন?
- ভালো আছি, শুভ্র। কিন্তু তুমি এত রাতে বাইরে কেন? তোমার চশমা কই?
- স্বপ্নে দেখলাম যূথী মেয়েটা আমাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাকছে। তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে চশমাটা ফেলে আসছি।
এসে দেখি আপনারা। হলুদ পাঞ্জাবি দেখে আপনাকে চিনেছি। উনাদের অবশ্য এখনো চিনতে পারছি না। আপনি কি মিসির চাচা?
- হুম।
- ভালোই হয়েছে।
এমন একটা বিশেষ দিনে আপনাদের দেখা পেলাম।
- আমরা এক জায়গায় যাচ্ছি। তুমি যাবে? হিমু বলল।
- চশমাটা নিয়ে আসি।
- চশমা নেয়ার দরকার নেই।
প্রতিদিন তো পৃথিবী একরকম দেখ। আজ নাহয় একটু অন্যরকম করে দেখলে।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
- ভালো কথা, তোমার বাবা আবার রেগে যাবেন না তো?
- আরে বাবা তো দেশেই নেই।
রাস্তায় এখন আমরা চারজন।
আরেকজন বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। আরেকজন বাড়লে পাঁচজন হবে। প্রাইম নাম্বার।
আমরা এখন জাতীয় জাদুঘরের পিছনের পুকুর পাড়ে। এখানে একটা সুন্দর ঘাট আছে।
দিন হলে ঢোকা যেত না, রাত বলেই হয়ত কেউ খেয়াল করছে না। হঠাৎ হঠাৎ রাস্তা দিয়ে সাঁই করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার অকারনে হর্ন বাজাচ্ছে। এই মধ্যরাতে হর্ন বাজানোর দরকার টা কি? অবশ্য খুব একটা খারাপ লাগছে না। একটু পর দেখলাম পুকুরের পাড় ঘেঁষে কে যেন আমাদের দিকে আসছে।
পুকুরের পানিতে তার ছায়া পড়েছে। নাকি সে পানির নিচ দিয়ে আসা কোন জলপরী। কাছে আসতেই বুঝলাম মেয়েটা রূপা। তার হাতে চায়ের ফ্লাস্ক।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম আপনারা আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই আসছিলেন।
দেখে চা বানিয়ে নিয়ে এলাম।
রূপা সবাইকে চা ঢেলে দিল। মেয়েটাকে সবুজ শাড়িতে অপূর্ব লাগছে। সাদা শাড়ি হলে পরীর মত লাগত। আমরা সবাই চুপচাপ বসে আছি।
আসরে অস্বাভাবিক নীরবতা।
আমি নীরবতা ভাঙ্গার জন্য বললাম, হুমায়ূন আহমেদ সাহেব এটা কোন কাজ করেছেন? হিমুর মত ভ্যাগাবন্ডের সাথে রূপার মত একটা মেয়েকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন!
নীরবতা কমল না, বরং আরো প্রগাঢ় হল। বাতাসে পুকুরের পানিতে ঢেউ উঠেছে। তার উপর চাঁদের আলো পড়ছে। ঢেউয়ের কারনে চাঁদের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে।
আমরা সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। একটু পর মনে হল পুকুর ঘাট আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করেছে। পানির ঢেউয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে এরকম হয়। রূপা পানিতে পা ডুবিয়ে পা নাড়ছে। মনে হচ্ছে মাঝি নৌকা বাইছে।
অদৃশ্য নৌকা দুলছে। কেন দুলছে কে জানে। ভরা পূর্ণিমা ভ্রম সৃষ্টি করে। সেরকম কিছুই মনে হয়। রুপাকেও এখন আর রূপা মনে হচ্ছে না, তাকে দেখাচ্ছে শাওন আপার মত।
রূপা গান ধরল,
এই ব্যস্ত নগরের অলিগলি ধরে কোন এক জোছনা রাতে
হাঁটছিল সে নিয়ন আলোতে ক’টি নীলপদ্ম হাতে
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল ময়ূরাক্ষীর তীরে যেই
হঠাৎ দেখে শূন্য সবই কোথাও কেউ নেই
রুপা একা জানালায় এখনও জানে না সে হায়
হিমু আর কোনদিন, কোনদিন আসবে না
সব যুক্তির মায়াজাল রহস্যের সব দেয়াল
মিসির আলী আর কোনদিন, কোনদিন ভাঙবে না
পেয়ে গেছে খবর সে, তাই প্রার্থনা নিরন্তর
তুমি শান্তিতে ঘুমাও গল্পের জাদুকর!*
আশ্চর্য, রূপা মেয়েটা এত সুন্দর গান গাইতে পারে হুমায়ূন আহমেদ সাহেব কখনো বলেননি। রূপার গলা ধরে এসেছে। আমি তার দিকে তাকালাম। রূপা কাঁদছে। কান্না সংক্রামক রোগের মত।
শুভ্রও কেঁদে গাল ভিজিয়ে ফেলেছে। মিসির আলিকে দেখলাম শার্টের কোনায় চশমা মুছছেন। চশমা ঠিকই আছে, আসলে তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। আমি উঠে দাঁড়লাম। অন্যের দুঃখে শামিল হওয়ার নিয়ম আছে।
কিন্তু এরা আজকে কাঁদছে তাদের স্রষ্টাকে হারানোর দুঃখে। সময়টা তাদের একান্তে নিজেদের হয়েই কাটুক। রাস্তা পর্যন্ত এসে একবার ফিরে তাকালাম। হিমু উঠে চলে যাচ্ছে। হিমুরা কাঁদতে জানে না।
হিমুদের কাঁদতে হয় না। ।
*গল্পের জাদুকর
কথা ও শুরঃ চমক হাসান
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।