মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... স্রষ্টা আছেন কি নেই, এই জটিলতম প্রশ্নে দ্বিধান্বিত হয়ে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, ক্লাস লেকচার, শিক্ষদের প্রবল নাস্তিক্যসহ এরূপ নানাবিধ বিষয়সমুহ ক্রমশই নিজের ভেতর একধরনের অবিশ্বাসের বীজ বপন করে ফেলল। প্রবল দিকভ্রান্ত আমি তখন এর কাছে যাই, ওর কাছে যাই, নানা প্রশ্নের, সন্দেহের, কৌতূহলের তৃষ্ণা মেটানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করি। কখনো কখনো কিছু জবাব মেলে, কিন্তু সেই জবাব কেন্দ্র করে আরও ১০ টা দ্বিধার জন্ম হয়।
আমি তখন শেকড়হীন পাগল প্রায়।
রাতের পর রাত ঘুমুতে পারি না, অস্থীর লাগে। আমার পুরোটা জুড়ে তখন প্রবল সংশয়, দ্বিধা, অস্থিরতা। আমি কি তাহলে নাস্তিক হয়ে যাচ্ছি! আমি কি অবিশ্বাসী হয়ে যাচ্ছি! কিন্তু আমি যে শেকড়হীন হতে চাই না, নাস্তিক হতে চাইনা। আমি বিশ্বাসী হতে চাই। কিন্তু বিশ্বাস করবার মত সেই শক্ততম, দৃঢ়তম, যৌক্তিক কোন উত্তরও যে পাই না।
কোন না কোনভাবে অন্য সকল দ্বিধার, সংশয়ের উত্তর মিললেও, আল্লাহ বা স্রষ্টার 'জন্ম কিংবা শেষ' কিভাবে? কে তাকে সৃষ্টি করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর আর মেলেনা। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।
উদ্ভ্রান্ত আমাকে লক্ষ্য করছিলেন বিভাগের এক নিভৃতচারী শিক্ষক। (সম্ভবত, বিভাগে তিনিই ছিলেন একমাত্র আস্তিক শিক্ষক) একদিন বিকেলে ডেকে নিলেন তার রুমে। পরম স্নেহে কাঁধে হাত রেখে বললেন, কি হয়েছে বল?
আমার কি হয়েছিলো জানিনা, আমি ঝর ঝর করে কেদে ফেলেছিলাম।
অকপটে আমার সব দ্বিধার কথা, সংশয়ের কথা তাকে খুলে বলেছিলাম। তিনি চুপচাপ সব শুনলেন। তারপর মৃদু হেসে, টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসের পানিটুকু আমাকে দিলেন। আমি ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি খেয়ে ফেললাম, এক নিঃশ্বাসে। স্যার আমার হাত থেকে গ্লাসটি নিলেন, গ্লাসের মুখে তখনও জমে আছে বিন্দু বিন্দু জলকণা, ভিজে আছে গ্লাসের বৃত্তাকার মুখের সবটুকু।
স্যার একটা সাদা পাতা নিয়ে সেই পাতার ওপর গ্লাসের ভেজা মুখটা উলটো করে চেপে ধরলেন। সাদা কাগজের বুকে গ্লাসের ভেজা মুখের জলের ছাপে তৈরি হোল একটি চমৎকার বৃত্ত।
স্যার এবার আমার দিকে তাকালেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, বলতো, এই বৃত্তটির শেষ কোথায় আর শুরু কোথায়?
আমি ফ্যালফ্যাল করে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর বললাম, এই বৃত্তের শেষ আর শুরু কিভাবে বলব?
স্যার বললেন, একটা সামান্য বৃত্তের শুরু কোথায় সেটা বলতে পারছনা, শেষ কোথায় তাও বলতে পারছনা, তার মানে কি বৃত্তটি নেই?
আমি অবাক হয়ে বৃত্তটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করলাম, নাহ, বৃত্তটিতো আছে, আছে, আছে.।
স্যার কিছু বললেন না, উঠে দাঁড়ালেন, তারপর জানালাটা খুলে দিলেন, বাইরে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, বিশাল নীল আকাশ।
তিনি সেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন শুন্যে। কোথায় যেন তলিয়ে গেলেন তিনি। তারপর একসময় মুখ ফেরালেন, ম্লান স্বরে বললেন, 'একটা সামান্য বৃত্তের শুরু আর শেষ কোথায় সেটা না বলতে পারলেও আমরা সেই বৃত্তটাকে অস্ব্বীকার করতে পারি না, অথচ, এই বিশাল পৃথিবী, গ্রহ নক্ষত্র, মহাশুন্য যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাকে কতো অবলীলায় অস্বীকার করি।
আমরা কতো বড় মূর্খ!' ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।